ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


নলিনী


প্রথম দৃশ্য
অপরাহ্ন
কানন
নীরদ
গান
 


                    পিলু কাওয়ালি
  হা কে ব'লে দেবে
সে ভালোবাসে কি মোরে!
কভু বা সে হেসে চায়, কভু মুখ ফিরায়ে লয়,
কভু বা সে লাজে সারা, কভু বা বিষাদময়ী,
যাব কি কাছে তার শুধাব চরণ ধ'রে!

        নলিনী ও বালিকা ফুলির প্রবেশ

    নীরদ। (স্বগত) এ রকম সংশয়ে ত আর থাকা যায় না! এমন ক'রে আর কত দিন কাটবে! এত দিন অপেক্ষা ক'রে ব'সে আছি ওগো, একবার হৃদয়ের দুয়ার খোল,আমাকে এক পাশে একটু আশ্রয় দাও যে লোক এত দিন ধ'রে প্রত্যাশা ক'রে চেয়ে আছে তাকে কি একটিবার প্রাণের মধ্যে আহ্বান করবে না? আজকের কাছে গিয়ে একবার জিজ্ঞাসা ক'রে দেখব! যদি একেবারে বলে না! আচ্ছা,তাই বলুক আমার এ সুখ দুঃখের যা হয় একটা শেষ হয়ে যাক্‌! (কাছে গিয়া) নলিনী!
    নলিনী। ফুলি, ফুলি, তুই ওখানে ব'সে ব'সে কি করচিস, ফুল তুলতে হবে মনে নেই! আয়, শীগগির ক'রে আয়! ও কি করেচিস, কুঁড়িগুলো তুলেচিস কেনু আহা ওগুলি কাল কেমন ফুটত? চল্‌ ঐদিকে গোলাপ ফুটেচে যাই। আজ এখনো নবীন এল না কেন ?
    ফুলি। তিনি এখনি আসবেন।
    নীরদ। আমার কথায় কি একবার কর্ণপাতও করলে না? আমি মনে করতুম, প্রাণপণ আগ্রহকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। নলিনীর কি এতটুকুও হৃদয় নেই যে আমার অতখানি আগ্রহকে স্বচ্ছন্দে উপেক্ষা করতে পারলে? নাঃ হয়ত ফুল তুলতে অন্যমনস্ক ছিল, আমার কথা শুনতেও পায় নি! আর একবার জিজ্ঞাসা ক'রে দেখি। নলিনী!
    নলিনী। ফুলি, কাল এই বেলফুলের গাছগুলোতে মেলাই কুঁড়ি দেখেছিলেম, আজ ত তার একটিও দেখচি নে! চল্‌ দেখি, ঐদিকে যদি ফুল পাই ত তুলে নিয়ে আসি! (অন্তরালে) দেখ্‌ ফুলি নীরদ আজ কেন অমন বিষণ্ণ হয়ে আছেন তুই একবার জিজ্ঞাসা ক'রে আয় না! তুই ওঁর কাছে গিয়ে একটু গান-টান গেয়ে শোনালে উনি ভাল থাকেন। তাই তুই যা,আমি ফুল তুলে নিয়ে যাচ্চি।
    ফুলি। কাকা, তোমার কি হয়েচে !
    নীরদ। কি আর হবে ফুলি!
    ফুলি। তবে তুমি অমন ক'রে আছ কেন কাকা?
    নীরদ। (কোলে টানিয়া লইয়া) কিছুই হয় নি বাছা!
    ফুলি। কাকা, তুমি গান শুনবে?
    নীরদ। না রে, এখন গান শুনতে বড় ইচ্ছে করচে না!
    ফুলি। তবে তুমি ফুল নেবে?
    নীরদ। আমাকে ফুল কে দেবে ফুলি?
    ফুলি। কেন, নলিনী ঐখেনে ফুল তুলচে, ঐদিকে ঢের ফুটেচে ঐখেনে চল না কেন? (নলিনীর কাছে টানিয়া লইয়া গিয়া ) কাকাকে কতকগুলি ফুল দাও না ভাই, উনি ফুল চাচ্চেন !
    নলিনী। তুই কি চোকে দেখতে পাস নে? দেখ দেখি গাছের তলায় কি ক'রে দিলি? অমন সুন্দর বকুলগুলি সব মাড়িয়ে দিয়েচিস! হ্যাঁ হ্যাঁ, ফুলি, আমরা যে সে দিন সেই ঝোপের মধ্যে পাখীর বাসায় সেই পাখীর ছানাগুলিকে দেখেছিলুম, আজ তাদের চোক ফুটেচে, তারা কেমন পিট্‌পিট্‌ ক'রে চাচ্চে! তাদের মা খাবার আনতে গেছে, এই বেলা আয়, আমরা তাদের একটি একটি ক'রে ঘাসের ধান খাওয়াই গে!
    ফুলি। কোথায় সে, কোথায় সে, চল না। ( উভয়ের দ্রুত গমন )
    নলিনী। (কিছু দূর গিয়া ফুলির প্রতি) ঐ যা, তোর কাকাকে ফুল দিয়ে আসতে ভুলে গেচি! তুই ছুটে যা, এই ফুল দুটি তাঁকে দিয়ে আয় গে। আমার নাম করিস নে যেন!
    ফুলি। (নীরদের কাছে আসিয়া ) এই নাও কাকা, ফুল এনেছি।
    নীরদ। (চুম্বন করিয়া ) আমি ভেবেছিলেম আমাকে কেউ ফুল দেবে না। শেষ কালে তোর কাছ থেকে পেলেম!
    নলিনী। (দুর হইতে) ফুলি, তুই আবার গেলি কোথায়? ঝট্‌ ক'রে আয় না, বেলা ব'য়ে যায়।
    ফুলি। এই যাই। (ছুটিয়া যাওন )
    নীরদ। (স্বগত ) এ যেন রূপের ঝড়ের মত, যেখেন দিয়ে বয়ে যায় সেখেনে তোলপাড় ক'রে দেয়। এতটা আমি ভালবাসি নে! আমার প্রাণ শ্রান্ত পাখীটির মত একটি গাছের ছায়া চায়, প্রচ্ছন্ন সুখের কুলায় চায়। আমি ত এত অধীরতা সইতে পারি নে, একটুখানি বিরাম, একটুখানি শান্তি কোথায় পাব? (নলিনীর কাছে গিয়া ) নলিনী, তুমি আমার একটি কথার উত্তর দেবে না?

                 নতশিরা নলিনীর স্তব্ধভাবে আঁচলের ফুল-গণনা
    কখন তুমি আমার সঙ্গে একটি কথা কও নি আজ তোমাকে বেশী কিছু বলতে হবে না, একবার কেবল আমার নামটি ধ'রে ডাক, তোমার মুখে একবার কেবল আমার নামটি শোনবার সাধ হয়েছে। আমার এইটুকু সাধও কি মিটবে না? না হয় একবার বল যে, না! বল যে, মিটবে না! বল যে,তোমাকে আমার ভাল লাগে না, তুমি কেন আমার কাছে কাছে ঘুরে বেড়াও! আমার এই দুর্ব্বল ক্ষীণ আশাটুকুকে আর কত দিন বাঁচিয়ে রাখব? তোমার একটি কঠিন কথায় তাকে একেবারে বধ ক'রে ফেল, আমার যা হবার হোক ।
    (নলিনীর আঁচল শিথিল হইয়া ফুলগুলি সব পড়িয়া গেল ও নলিনী মাটিতে বসিয়া ধীরে ধীরে একে একে কুড়াইতে লাগিল ।)
    নীরদ। তাও বলবে না! (নিশ্বাস ফেলিয়া দূরে গমন )
    ফুলি। (ছুটিয়া নলিনীর কাছে আসিয়া ) দেখ'সে, নেবুগাছে একটা মৌচাক দেখতে পেয়েছি ! ও কি ভাই, তুমি মুখ ঢেকে অমন ক'রে ব'সে আছ কেন? ও কি তুমি কাঁদচ কেন ভাই?
    নলিনী। (তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া হাসিয়া উঠিয়া ) কই, কাঁদচি কই?
    ফুলি। আমি মনে করেছিলুম,তুমি কাঁদচ!

                       নবীনের প্রবেশ
    নলিনী। ঐ যে নবীন এয়েচে, চল্‌ ওর কাছে যাই! (কাছে আসিয়া) আজ যে তুমি এত দেরি ক'রে এলে?
    নবীন। (হাসিয়া) একটুখানি তিরস্কার পাবার ইচ্ছে হয়েছিল। আমি দেরি ক'রে এলে তোমারও যে দেরি মনে হয় এটা মাঝে মাঝে শুনতে ভাল লাগে।
    নলিনী। বটে! তিরস্কারের সুখটা একবার দেখিয়ে দেব। দে ত ফুলি,ওর গায়ে একটা কাঁটা ফুটিয়ে দে ত।
    নবীন। ও যন্ত্রণাটা ভাই এক রকম সওয়া আছে। ওতে আর বেশী কি হ'ল? ওটা ত আমার দৈনিক পাওনা! যতগুলি কাঁটা এইখেনে ফুটিয়েছ, সবগুলি যত্ন ক'রে প্রাণের ভিতরে বিঁধিয়ে রেখেচি তার একটিও ওপ্‌ড়ায় নি, আর যায়গা কোথায়?
    নলিনী। ও বড্ড কথা কচ্চে ফুলি দে ত ওকে সেই গানটা শুনিয়ে ।

                ফুলির গান
                পিলু
ও কেন ভালবাসা জানাতে আসে
          ওলো সজনি!
হাসি খেলি রে মনের সুখে,
ও কেন সাথে ফেরে আঁধারমুখে
          দিন রজনী!
     নবীন। আমারও ভাই একটা গান আছে,কিন্তু গলা নেই। কি দুঃখ! প্রাণের মধ্যে গান আকুল হয়ে উঠেচে, কেবল গলা নেই ব'লে কেউ একদণ্ড মন দিয়ে শুনবে না! কিন্তু গলাটাই কি সব হ'ল? গানটা কি কিছু নয়? গানটা শুনতেই হবে।
 
           কালাংড়া
ভালবাসিলে যদি সে ভাল না বাসে
         কেন সে দেখা দিল!
মধু অধরের মধুর হাসি
        প্রাণে কেন বরষিল!
দাঁড়িয়েছিলেম পথের ধারে,
সহসা দেখিলেম তারে
নয়ন দুটি তুলে কেন
মুখের পানে চেয়ে গেল!

    নলিনী। আর ভাল লাগচে না। (স্বগত) মিছিমিছি কথা কাটাকাটি ক'রে আর পারি নে। একটু একলা হ'লে বাঁচি। ( ফুলির প্রতি ) আয় ফুলি,আমরা একটু বেড়িয়ে আসি গে

                                                                                  [প্রস্থান

    নীরদ। এমন প্রশান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় অমনতর চপলতা কি কিছুমাত্র শোভা পায়! সন্ধ্যার এমন শান্তিময় স্তদ্ধতার সঙ্গে ঐ গান বাজনা হাসি তামাসা কি কিছুমাত্র মিশ খায়? একটু হৃদয় থাকলে কি এমন সময়ে এমনতর চপলতা প্রকাশ করতে পারত? আমোদ প্রমোদের কি একটুও বিরাম নেই? দিনের আলো যখন নিবে এসেচে, পাখীগুলি তাদের নীড়ে তাদের একমাত্র সঙ্গিনীদের কাছে ফিরে এসেছে, দূরে কুঁড়েঘরগুলিতে সন্ধের প্রদীপ জ্বলচে তখন কি ঐ চপলার এক মুহূর্ত্তের তরেও আর একটি হৃদয়ের জন্যে প্রাণ কাঁদে না ? এক মুহূর্ত্তের জন্যও কি ইচ্ছে যায় না এই কোলাহলশূন্য জগতের মধ্যে আর একটি প্রেমপূর্ণ হৃদয় নিয়ে দুজনে স্তব্ধ হয়ে দুজনের পানে চেয়ে থাকি । গভীর শান্তিপূর্ণ সেই সন্ধ্যা-আকাশে দুটিমাত্র স্তব্ধ হৃদয় স্তব্ধ আনন্দে বিরাজ করি। দুটি সন্ধ্যাতারার মত আলোয় আলোয় কথা হয় ! হায় এ কি কল্পনা ! এ কি দুরাশা !

                         নবীনের প্রবেশ

    নবীন। এ কি ভাই, তুমি যে একলা এখানে ব'সে আছ? আমাদের সঙ্গে যে যোগ দাও নি?
    নীরদ। এমন মধুর সন্ধে বেলায় কেমন ক'রে যে তুমি ঐ মূর্ত্তিমতী চপলতার সঙ্গে আমোদ ক'রে বেড়াচ্ছিলে আমি তাই ব'সে ভাবছিলুম। সন্ধের কি একটা পবিত্রতা নেই? ঐ সময়ে হৃদয়হীন চটুলতা দেখলে কি তার সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছে করে?
    নবীন। তোমরা কবি মানুষ, তোমাদের কথা আমরা ঠিক বুঝতে পারি নে। আমার ত খুব ভাল লাগছিল। আর তোমাদের কবিত্বের চোখেই বা ভাল লাগবে না কেন তাও আমি ঠিক বুঝতে পারি নে! সরলা বালিকা, মনে কোন চিন্তা নেই, প্রাণের স্ফূর্ত্তিতে সন্ধ্যার কোলে খেলিয়ে বেড়াচ্চে এই বা দেখতে খারাপ লাগবে কেন ?
    নীরদ। তা ঠিক বলেচ ! (কিছুক্ষণ ভাবিয়া) কিন্তু যার কোন চিন্তা নেই, সে মন কি মন? যে হৃদয় আর কোন হৃদয়ের জন্যে ভাবে না, আপনাকে নিয়েই আপনি সন্তুষ্ট আছে, তাকে কি স্বার্থপর বলব না!
    নবীন। তুমি নিজে স্বার্থপর ব'লেই তাকে স্বার্থপর বলচ! যে হৃদয় তোমার হৃদয়ের জন্যে ভাবে না তার আনন্দ তার হাসি তোমার ভাল লাগে না, এর চেয়ে স্বার্থপরতা আর কি আছে! আমি ত, ভাই, সে ধাতের লোক নই। সে আমাকে হৃদয় দিক আর নাই দিক আমার তাতে কি আসে যায়? আমি তার যতটুকু মধুর তা উপভোগ করব না কেন? তার মিষ্টি হাসি মিষ্টি কথা পেতে আপত্তি কি আছে!
    নীরদ। স্বার্থপরতা? ঠিক কথাই বটে। এত দিনে আমার মনের ভাব ঠিক বুঝতে পারলুম। ঐ সরলা বালা আমোদ করে বেড়াচ্চে তাতে আমার মনে মনে তিরস্কার করবার কি অধিকার আছে। আমি কোথাকার কে! আমি অনবরত তাকে অপরাধী করি কেন !

                    নলিনীর প্রবেশ
    নলিনী, আমাকে মার্জ্জনা কর।
    নবীন। (তাড়াতাড়ি) আবার ও সব কথা কেন? বড় বড় হৃদয়ের কথা ব'লে বালিকার সরল মনকে ভারাগ্রস্ত করবার দরকার কি? (হাসিয়া নলিনীর প্রতি) নলিনী, আজ বিদায় হবার আগে একটি ফুল চাই!
    নলিনী। বাগানে ত অনেক ফুল ফুটেচে, যত খুশি তুলে নাও না!
    নবীন। ফুলগুলিকে আগে তোমার হাসি দিয়ে হাসিয়ে দাও, তোমার স্পর্শ দিয়ে বাঁচিয়ে দাও। ফুলের মধ্যে আগে তোমার রূপের ছায়া পড়ুক, তোমার স্মৃতি জড়িয়ে যাক তার পরে তাকে ঘরে নিয়ে যাব।
    নলিনী। (হাসিয়া) বড্‌ড তোমার মুখ ফুটেচে দেখচি! দিনে দুপুরে কবিতা বলতে আরম্ভ করেচ!
    নবীন। আমি কি সাধে বলচি! তুমি যে জোর করে আমাকে কবিতা বলাচ্চ। তোমার ঐ দৃষ্টির পরেশ-পাথরে আমার ভাবগুলি একেবারে সোনা-বাঁধানো হয়ে বেরিয়ে আসচে।
    নলিনী। তুমি ও কি হেঁয়ালি বলচ আমি কিছুই বুঝতে পারচি নে।
    নীরদ। আমি ত নবীনের মত এ রকম ক'রে কথা কইতে পারি নে। আর মিছিমিছি এ রকম উত্তর প্রত্যুত্তর ক'রে যে কি সুখ আমি কিছুই ত বুঝতে পারি নে! কিন্তু আমার সুখ হয় না ব'লে কি আর কারও সুখ হবে না? আমি কি কেবল একলা ব'সে ব'সে পরের সুখ দেখে তাদের তিরস্কার করতে থাকব, এই আমার কাজ হয়েচে? যে যাতে সুখী হয় হোক না,আমার তাতে কি? আমার যদি তাতে সুখ না হয়,আমি অন্যত্র চ'লে যাই।
    নবীন। (নলিনীর প্রতি) দেখতে দেখতে তোমার হাসিটি মিলিয়ে এল কেন ভাই? কি যেন একটা কালো জিনিষ প্রাণের ভিতর নুকিয়ে রেখেচ, সেটা হাসি দিয়ে ঢেকে রেখেচ, কিন্তু হাসি যে আর থাকে না। আমি ত বলি প্রকাশ করা ভাল! (কোন উত্তর না পাইয়া ) তুমি বিরক্ত হয়েচ! না? মনের ভিতর একজন লোক হঠাৎ উঁকি মারতে এলে বড় ভাল লাগে না বটে! কিন্তু একটু বিরক্ত হ'লে তোমাকে বড় সুন্দর দেখায়! সেই জন্যে তোমাকে মাঝে মাঝে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে!
    নলিনী। ( হাসিয়া ) বটে! তোমার যে বড্‌ড জাঁক হয়েচে দেখচি! তুমি কি মনে কর তুমিও আমাকে বিরক্ত করতে, কষ্ট দিতে পার ! সেও অনেক ভাগ্যের কথা ! কিন্তু সে ক্ষমতাটুকুও তোমার নেই।
    নবীন। ( সহাস্যে ) আমার ভুল হয়েছিল ।
    নীরদ। নবীনের সঙ্গেই নলিনীর ঠিক মিলেচে! এ আমার জন্যে হয় নি! আমি এদের কিছুই বুঝতে পারি নে। এদের হাসি এদের কথা আমার প্রাণের সঙ্গে কিছুই মেলে না! তবে কেন আমি এদের মধ্যে একজন বেগানা লোকের মত বসে থাকি! আমি পর, আমার এখেনে কোন অধিকার নেই! এদের অন্তঃপুরের মধ্যে আমি কেন? আমার এখান থেকে যাওয়াই ভাল! আমি চলে গেলে কি এদের একটুও কষ্ট হবে না? একবারও কি মনে করবে না, আহা, সে কোথায় গেল? না না আমি গেলে হয়ত এরা আরাম বোধ করবে! এখানে আর থাকব না। আজই বিদেশে যাব! এত দিনের পরে আমি বুঝতে পেরেচি যে আমিই স্বার্থপর। কিন্তু আর নয়।
    ফুলি। ( আসিয়া ) ( নলিনীর প্রতি ) মা তোমাদের ডাকতে পাঠালেন ।
    নলিনী। তবে যাই ।                    [ প্রস্থান
    নবীন। আমিও তবে বিদায় হই।    [ প্রস্থান
    নীরদ। (ফুলিকে ধরিয়া ) আয় ফুলি,একবার আমার কোলে আয়! আমার বুকে আয়!
    ফুলি। ও কি কাকা, তোমার চোখে জল কেন?
    নীরদ। ও থাক্‌ । জল একটু পড়ুক। (কিছুক্ষণ পরে ) অন্ধকার হয়ে এল, এখন তবে বাড়ি যা ।
    ফুলি। তুমি বাড়ি যাবে না কাকা?
    নীরদ। না বাছা!
    ফুলি। তুমি তবে কোথায় যাবে?
    নীরদ।  আমি আর এক জায়গায় চল্লেম। নলিনীর সঙ্গে তুই বাড়ি যা!           [প্রস্থান
    নলিনী। (আসিয়া) তোর কাকা তোকে কি বলছিলেন ফুলি?
    ফুলি। কিছুই না!
    নলিনী। আমার কথা কি কিছু বলছিলেন?
    ফুলি। না।
    নলিনী। আয় বাড়ি আয়।
    ফুলি। কিন্তু কাকা কাঁদছিলেন কেন?
    নলিনী। কি, তিনি কাঁদছিলেন?
    ফুলি। হাঁ।
    নলিনী। কেন কাঁদছিলেন ফুলি?
    ফুলি। আমি ত জানি নে !
    নলিনী। তোকে কিছুই বলেন নি?
    ফুলি। না।
    নলিনী। কিছুই বলেন নি?
    ফুলি। না।
    নলিনী। তবে সেই গানটা গা !

          বেহাগড়া  কাওয়ালি

     মনে রয়ে গেল মনের কথা
    শুধু চোখের জল, প্রাণের ব্যথা !
মনে করি দুটি কথা বলে যাই,
কেন মুখের পানে চেয়ে চলে যাই,
সে যদি চাহে মরি যে তাহে
     কেন মুদে আসে আঁখির পাতা!
ম্লান মুখে সখি সে যে চলে যায়,
ও তারে ফিরায়ে ডেকে নিয়ে আয়,
বুঝিল না সে যে কেঁদে গেল
     ধূলায় লুটাইল হৃদয়লতা !
                                  [গাইতে গাইতে প্রস্থান