ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


নলিনী


দ্বিতীয় দৃশ্য
 


                                                গৃহ

    নবীন। নীরদ বিদেশে যাবার পর থেকে নলিনীর এ কি হ'ল? সে উল্লাস নেই, সে হাসি নেই। বাগানে তার আর দেখা পাই নে। দিনরাত ঘরের মধ্যেই একলা ব'সে থাকে। নলিনী নীরদকেই বাস্তবিক ভালবাসত! এইটে আর আগে বুঝতে পারি নি! এমনি অন্ধ হয়েছিলেম । নীরদের সমুখে সে যেন নিজের প্রেমের ভারে নিজে ঢাকা পড়ে যেত! তাকে ঠিক দেখা যেত না। নীরদের সমুখে সে এমনি অভিভূত হয়ে পড়ত যে আমাদের কাছে পেলে সে যেন আশ্রয় পেত, সে যেন আমাদের পাশে আপনাকে আড়াল করে তাড়াতাড়ি আত্মসম্বরণ করতে চেষ্টা করত । নীরদের পূর্ণদৃষ্টি সূর্যালোকে পাছে তার প্রাণের সমস্তটা একেবারে দেখা যায় এই ভয়ে সে নীরদের সমুখে অস্থির হয়ে পড়ত; কি ভুলই করেছি! যাই, তাকে একবার খুঁজে আসি গে! আজ তার সে করুণ মুখখানি দেখলে বড় মায়া করে। তার মুখের সেই সরল হাসিখানি যেন নিরাশ্রয় হয়ে আমার চোখের সমুখে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্চে! আবার কবে সে হাসবে?                [ প্রস্থান

        নলিনীর গৃহে প্রবেশ ও জানালার কাছে উপবেশন

    নলিনী। (স্বগত) আমাকে একবার ব'লেও গেলে না? আমি তাঁর কি করেছিলেম? আমাকে যদি তিনি ভালবাসতেন তবে কি একবার ব'লে যেতেন না ?
                 ফুলির প্রবেশ
    ফুলি। বাগানে বেড়াতে যাবে না ?
    নলিনী। আজকের থাক্‌ ফুলি, আর এক দিন যাব ।
    ফুলি। তোর কি হয়েচে দিদি, তুই অমন ক'রে থাকিস কেন !
    নলিনী। কিছু হয় নি বোন, আমার এই রকমই স্বভাব ।
    ফুলি। আগে ত তুই অমন ছিলি নে !
    নলিনী। কি জানি আমার কি বদল হয়েছে !
    ফুলি। আচ্ছা দিদি, কাকাকে আর দেখতে পাই নে কেন? কাকা কোথায় চ'লে গেছেন?
    নলিনী। (ফুলিকে কোলে লইয়া ,কাঁদিয়া উঠিয়া) তুই বল্‌ না তিনি কোথায় চলে গেছেন ! যাবার সময় তিনি ত কেবল তোকেই ব'লে গেছেন ! আমাদের কাউকে কিছু ব'লে যান নি !
    ফুলি। (অবাক্‌ হইয়া) কই, আমাকে ত কিছু বলেন নি!
    নলিনী। তোকে তিনি বড় ভালবাসতেন। না ফুলি? আমাদের সকলের চেয়ে তোকে তিনি বেশী ভালবাসতেন!
    ফুলি। তুমি কাঁদচ কেন দিদি? কাকা হয়ত শীগগির ফিরে আসবেন।
    নলিনী। শীগগির কি আসবেন ? তুই কি করে জানলি ?
    ফুলি। কেনই বা আসবেন না ?
    নলিনী। ফুলি, তুই আমার জন্য এক ছড়া মালা গেঁথে নিয়ে আয়গে ! আমি একটু একলা ব'সে থাকি ।
    ফুলি।  আচ্ছা ।    [ প্রস্থান

                 নবীনের প্রবেশ
    নবীন। নলিনী, তুমি কি সমস্ত দিন এই রকম জানালার কাছে ব'সে ব'সেই কাটাবে?
    নলিনী। আমার আর কাজ কি আছে? এইখানটিতে ব'সে থাকতে আমার ভাল লাগে।
    নবীন। আগেকার মত আজ একবার বাগানে বেড়াই গে চল না ।
    নলিনী। না, বাগানে আর বেড়াব না!
    নবীন। নলিনী, কি করলে তোমার মন ভাল থাকে আমাকে বল। আমার যথাসাধ্য আমি করব।
    নলিনী। এইখেনে আমি একটুখানি একলা ব'সে থাকতে চাই। তা হ'লেই আমি ভাল থাকব ।
    নবীন। আচ্ছা।   [ প্রস্থান

              এক প্রতিবেশিনীর প্রবেশ
    প্র। তার কি হ'ল বল্‌ দেখি বোন্‌ঝি, আর যে বড় আমাদের ও দিকে যাস নে ।
    নলিনী। কি বলব মাসী, শরীরটা বড় ভাল নেই।
    প্র। আহা,তাই ত লো, তোর মুখখানি বড় শুকিয়ে গেছে! চোখের গোড়ায় কালী পড়ে গেছে ! মুখে হাসিটি নেই! তা, এমন ক'রে ব'সে আছিস কেন লো! আমার সঙ্গে আয়, দুজনে একবার পাড়ায় বেড়িয়ে আসি গে।
    নলিনী। আজকের থাক্‌ মাসী!
    প্র। কেনে লা! আমার দিদির বাড়ি নতুন বৌ এসেচে, তাকে একবার দেখবি চ।
    নলিনী। আর এক দিন দেখব এখন মাসী, আজকের থাক্‌। আজ আমি বড় ভাল নেই।
    প্র। আহা, থাক্‌ তবে। যে শরীর হয়ে গেছে,বাতাসের ভর সয় কি না সয়! আজ তবে আসি মা, ঘরকন্নার কাজ পড়ে রয়েচে।   [প্রস্থান

                      ফুলির প্রবেশ
    ফুলি। মা বলেচেন, সারাদিন তুমি ঘরে ব'সে আছ, আজ একটিবার আমাদের বাড়িতে চল ।
    নলিনী। না বোন,আজকের আমি পারব না !
    ফুলি। তবে তুমি বাগানে চল। একলা মালা গাঁথতে আমার ভাল লাগচে না। একবারটি চল না বাগানে!
    নলিনী। তোর পায়ে পড়ি ফুলি, আমাকে আর বাগানে যেতে বলিস নে, আমাকে একটু একলা থাকতে দে!
    ফুলি। আমাদের সেই মাধবীলতাটি শুকিয়ে এসেচে, তাতে একটু জল দিবি নে?
    নলিনী। না।
    ফুলি। আমাদের সেই পোষ-মানা পাখীর ছানাটি আজকের একটু একটু উড়ে বেড়াচ্চে, তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করচে না ?
    নলিনী। না ফুলি !
    ফুলি। তবে আমি যাই, মালা গাঁথি গে, কিন্তু তোকে মালা দেব না!          [প্রস্থান