ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
নলিনী
তৃতীয় দৃশ্য
বিদেশ
নীরদ নীরজা
উদ্যান
নীরদ।
(স্বগত) এত দিন এলুম, মনে করেছিলুম একখানা চিঠিও পাওয়া যাবে। "কেমন আছ" একবার জিগেস
করতেও কি নেই? স্ত্রীলোকের কঠোর হৃদয় কি ভয়ানক দৃশ্য!
নীরজা।
(কাছে আসিয়া) এমন ক'রে চুপ ক'রে আছ কেন নীরদ?
নীরদ।
আহা, কি সুধাময় স্বর! কে বলে স্ত্রীলোকের প্রাণ কঠিন? মমতাময়ি, এত সুধা তোমাদের
প্রাণে কোথায় থাকে? আমি কি চুপ ক'রে আছি! আর থাকব না। বল কি করতে হবে। এস, আমারা
দুজনে মিলে গান গাই।
নীরজা।
না নীরদ, আমার জন্যে তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোমাকে বিমর্ষ দেখলে আমার কষ্ট হয়
ব'লে যে তুমি প্রফুল্লতার ভাণ করবে সে আমার পক্ষে দ্বিগুণ কষ্টকর! একবার তোমার
দুঃখে আমাকে দুঃখ করতে দাও, মিছে হাসির চেয়ে সে ভাল ।
নীরদ। ঠিক বলেছ নীরজা! দিনরাত্রি কি প্রমোদের চপলতা ভাল লাগে?
এমন সময় কি আসে না যখন স্তব্ধ হয়ে ব'সে দুটিতে মিলে সন্ধেবেলায় নিরিবিলি দুজনের
দুঃখে দুঃখে কোলাকুলি হয় ? দুজনের বিষণ্ণ মুখে দুজনে চেয়ে থাকে? দুজনের চোখের জলের
মিলন হয়ে হৃদয়ের পবিত্র গঙ্গা যমুনার সঙ্গম হয়? এই লও নীরজা,আমার এই বিষণ্ণ প্রাণ
তোমার হাতে দিলেম , একে তোমার ওই অতি কোমল মমতার মধ্যে ঢেকে রাখ, দাও এর চোখের জল
মুছিয়ে দাও। তুমি মমতা করেই ভাল থাক, তুমি স্নেহ দিতেই ভালবাস– দাও, আরও স্নেহ দাও, আরও মমতা কর। আমি
চুপ ক'রে তোমার ঐ মধুর করুণা উপভোগ করি ।
নীরজা। আমাকে অমন করে তুমি বলো না– তোমার কথা শুনে আমার চোখে আরও জল আসে! আমি তোমার কি
করতে পারি? আমি কি করলে তোমার একটুও শান্তি হয়? আমার কাছে অমন ক'রে চেয়ো না! আমার
কি আছে, কি দেব, কিছু যেন ভেবে পাই নে ।
নীরদ।
(স্বগত) এই মমতার কিছু অংশও যদি তার থাকত! এত কাল যে আমি ছায়ার মত তার কাছে কাছে
ছিলুম, আমাকে ভাল নাই বাসুক, একটুকু মায়াও কি আমার উপর জড়ায় নি, যে একখানি চিঠি
লিখে আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কেমন আছ? আজও সে তার বাগানে তেমনি ক'রে হেসে খেলে
বেড়াচ্চে? আমি চ'লে এসেচি ব'লে তার জগতের একটি তিলও শূন্য হয় নি? কেনই বা হবে?
নিষ্ঠুর মমতাহীন জড়প্রকৃতির এই রকমই ত নিয়ম! আমি চ'লে এসেচি ব'লে কি তার বাগানে
একটি বেল ফুলও কম ফুটবে? একটি পাখীও কম ক'রে গাবে? কিন্তু তাই ব'লে কি রমণীর প্রাণও
সেই রকম ?
নীরজা।
নীরদ, তোমার মনের দুঃখ আমার কাছে প্রকাশ ক'রে কি তোমার একটওু শান্তি হয় না। আমাকে
কি তুমি ততটুকুও ভালবাস না? তবে আজ কেন তুমি আমাকে কিছু বলচ না? কেন আপনার দুঃখ
নিয়ে আপনি বসে আছ?
নীরদ।
নীরজা, তুমি কি মনে করচ, আমি নলিনীকে ভালবেসে কষ্ট পাচ্চি ? তা মনেও ক'রো না । তাকে
আমি ভালবাসব কি ক'রে ? তাতে আমাতে যে আকাশ পাতাল প্রভেদ ।
নীরজা।
কিন্তু,কেনই বা তাকে না ভালবাসবে? হয়ত সে ভালবাসার যোগ্য।
নীরদ।
না নীরজা, আমি তাকে ভালবাসি নে। আমি তোমাকে বার বার ক'রে বলচি,আমি তাকে ভালবাসি নে। এক কালে ভালবাসি ব'লে ভ্রম হয়েছিল । কিন্তু সে ভ্রম একেবারে গিয়েছে। কেনই বা আমি
তাকে ভাল-বাসব? সে কি আমাকে মমতা করতে পারে? সে কি আমার প্রাণের কথা বুঝতে পারে?
তার কি হৃদয় আছে? সে কেবল হাসতেই জানে,সে কি পরের জন্যে কখনও কেঁদেচে?
নীরজা।
কিন্তু সত্যি কথা বলি নীরদ, তোমরা পুরুষ মানুষেরা আমাদের ঠিক বুঝতে পার না। তুমি হয়ত
জান না তার প্রাণের মধ্যে কি আছে! হয়ত সে তোমাকে ভালবাসে।
নীরদ।
তা হবে। হয়ত তার প্রাণের কথা আমি ঠিক জানি নে। কিন্তু এ প্রতারণায় তার আবশ্যক কি
ছিল? যখন তার মুখে কেবলমাত্র একটি কথা শোনবার জন্য আমার সমস্ত প্রাণের আশা একেবারে
উন্মুখ হয়েছিল, তখন সে কেন মুখ ফিরিয়ে অন্যমনস্কের মত ফুল কুড়োতে লাগল? আমার কথার
কি একটি উত্তরও সে দিতে পারত না?
নীরজা।
কেমন ক'রে দেবে বল? ক্ষুদ্র বালিকা সে, সে কি ভাষা জানে যে তার প্রাণের সব কথা বলতে
পারে? সে হয়ত ভাবলে, আমার মনের কথা আমি কিছুই ভাল ক'রে বলতে পারব না, সেই জন্যেই
তুমি যদি আমার কথা ঠিক না বুঝতে পার, যদি দৈবাৎ আমার একটি কথাও অবিশ্বাস কর, তা হলে
সে কি যন্ত্রণা ! কি লজ্জা !
নীরদ।
কিন্তু আমি কি তার ভাবেও কিছু বুঝতে পারতুম না !
নীরজা।
তোমরা পুরুষেরা যখন একবার নিজের হৃদয়ের কথা ভাব, তখন পরের হৃদয়ের দিকে একবার চেয়ে
দেখতে পার না। নিজের সুখ দুঃখের সঙ্গে যতটুকু যোগ সেইটুকুই দেখতে পাও,তার সুখ দুঃখ
চোখে পড়েও না । সে যে কি দুঃখে চ'লে যায়,তা তোমরা দেখ না–
তোমরা কেবল ভাব আমার
সঙ্গে কথা কইলে না,আমার কাছ থেকে চলে গেল ।
নীরদ।
তা হবে! আমরা স্বার্থপর, সেই জন্যেই আমরা অন্ধ। কিন্তু ও কথা আর কেন ? ও-সব কথা
আমি মন থেকে একেবারে তাড়িয়ে দিয়েছি। আর ত আমি তাকে ভালবাসি নে; ভালবাসতে পারিও না !
তবে ও কথা থাক্ । আর একটা কথা বলা যাক। দেখ নীরজা, যদিও আমাদের বিবাহের দিন কাছে
এসেচে, তবু মনে হচ্চে যেন এখনো কত দিন বাকী আছে! সময় যেন আর কাটচে না!
নীরজা।
( নীরদের হাত ধরিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া ) নীরদ, আমার চোখে জল আসচে,কিছু মনে করো না।
বিবাহের দিন ত কাছে আসচে, এই সময় একবার মনে ক'রে দেখ আমরা কি করচি– কোথায় যাচ্চি।
দেখো ভাই, আমাদের এ বাসরঘর শ্মশানের উপর গড়া নয়ত! তার চেয়ে এস, এইখান থেকেই আমাদের
ছাড়াছাড়ি হোক। তুমি এক দিকে যাও, আমি এক দিকে যাই। আমাদের সমুখে সংশয়ের সমুদ্র, কি
হ'তে পারে কে জানে ! আমরা দুজনে মিলে এই সমুদ্রের উপকূল পর্য্যন্ত এসেচি, আর এক পা
এগিয়ে কাজ নেই । এইখানেই এস আমরা ফিরে যাই, যে যার দেশে চ'লে যাই । দুদিনের জন্যে
দেখা হয়েচে, তোমাকে আমি ভালবেসেছি– কিন্তু তাই ব'লে এই আঁধার সমুদ্রে আমার ভারে
তোমাকে ডোবাই কেন ?
নীরদ।
এ কি অশুভ কথা নীরজা? এ কি অমঙ্গল! কেঁদ না নীরজা! তোমার অশ্রুজল আজকের শোভা পায় না
নীরজা!
নীরজা।
কে জানে ভাই! আমার মনে আজ কেন এমন আশঙ্কা হচ্চে? আমার প্রাণের ভিতর থেকে যেন কেঁদে
উঠচে! আমাকে মাপ কর। ঈশ্বর জানেন আমি নিজের জন্যে কিছুই ভাবছি নে; আমার মনে হচ্চে এ
বিবাহে তুমি সুখী হতে পারবে না ।
নীরদ। নীরজা, তবে তুমি আজ আমাকে এই অন্ধকারের মধ্যে পরিত্যাগ করতে চাও ? তুমি ছাড়া
আর কোথাও আমার আশ্রয় নেই– কেউ আমাকে মমতা করে না, কেউ আমাকে তার হৃদয়ের মধ্যে
একটুখানি স্থান দেয় না– কেউ আমার মনের ব্যথা শোনে না, আমার প্রাণের কথা বোঝে না,
তুমি আমাকে ছেড়ে চ'লে যাবে ? তা হলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব ?
নীরজা। না না–
অমি কি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি? যা হবার তা হবে, আমি তোমার সাথের সাথী রইলেম–
ডুবি ত দুজনে মিলে ডুবব। যদি এমন দিন আসে তুমি আমাকে ভালবাসতে না পার, তোমার সঙ্গে
আমার যদি বিচ্ছেদ হয় ত
–
নীরদ। ও কি কথা নীরজা? ও কথা মনেও আনতে নেই ! দুঃখ এসে যাদের মিলন ক'রে দেয়, চোখের
জলের মুক্ত'র মালা যারা বদল করেচে, তাদের সে মিলন পবিত্র
– জন্মে জন্মে তাদের আর
বিচ্ছেদ হয় না । হাসি খেলার চপলতার মধ্যে আমাদের মিলন হয় নি, আমাদের ভয় কিসের?
নীরজা।
নীরদ , দেখি তোমার হাতখানি, তোমাকে একবার স্পর্শ ক'রে দেখি, ভাল ক'রে ধ'রে রাখি,
কেউ যেন ছিঁড়ে না নেয় !
নীরদ।
এই নাও আমার হাত । আজ থেকে তবে আর আমরা বিচ্ছিন্ন হব না ? আজ থেকে তবে সুদীর্ঘ
জীবনের পথে আমরা দুজনে মিলে যাত্রা করলেম ?
নীরজা।
হাঁ প্রিয়তম !
নীরদ।
আজ থেকে তবে তুমি আমার বিষাদের সঙ্গিনী হ'লে,অশ্রুজলের সাথী হ'লে ?
নীরজা।
হাঁ প্রিয়তম !
নীরদ।
আমার বিষাদের গোধূলির মধ্যে তুমি সন্ধের তারাটির মত ফুটে থাকবে । তোমাকে আমি কখন
হারাব না– চোখে চোখে রেখে দেব !