ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


নলিনী


চতুর্থ দৃশ্য

দেশ
নীরদ নীরজা


     নীরদ। এই ত আবার সেই দেশে ফিরে এলুম। মনে করি নি আর কখনো ফিরব। তোমাকে যদি না পেতুম তবে আর দেশে ফিরতুম না ।
    নীরজা। এমন সুন্দর দেশ আমি কোথাও দেখি নি । এ যেন আমার সব স্বপ্নের মত মনে হচ্চে। এত পাখী, এত শোভা আর কোথায় আছে।
    নীরদ। কিন্তু নীরজা, এদেশে কেবল শোভাই আছে, এদেশে হৃদয় নেই।
    নীরজা। তা হতেই পারে না। এত সৌন্দর্য্যের মধ্যে হৃদয় নেই এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না!
    নীরদ। সৌন্দর্য্যকে দেখবামাত্রই লোকে তাকে বিশ্বাস ক'রে ফেলে এই জন্যেই ত পৃথিবীতে এত দুঃখ-যন্ত্রণা ! সে কথা যাক নলিনীদের বাড়ীতে আজ বসন্ত-উৎসব আমাদের নিমন্ত্রণ হয়েচে, একটু শীগগির শীগগির যেতে হবে ।
    নীরজা। আমার একটি কথা রাখবে? আমি বলি ভাই, সেখানে আমাদের না যাওয়াই ভাল ।
    নীরদ। কেন ?
    নীরজা। কেন, তা জানি নে, কিন্তু কে জানে,আমার মনে হচ্চে সেখানে আজ না গেলেই ভাল!
    নীরদ। নীরজা, তুমি কি আমার ভালবাসার প্রতি সন্দেহ কর ?
    নীরজা। প্রিয়তম, এ প্রশ্ন যদি তোমার মনে এসে থাকে তবে থাক্‌ তবে আর আমি অধিক কিছু বলব না তুমি চল !
    নীরদ। আমি ত যাওয়াই ভাল বিবেচনা করি ! আজ আমার কি গর্ব্বের দিন ! তোমাকে সঙ্গে ক'রে যখন নিয়ে যাব, নলিনী দেখবে আমাকে ভালবাসবারও এক জন লোক আছে ।        [ উভয়ের প্রস্থান


পঞ্চম দৃশ্য

নলিনীর উদ্যানে বসন্ত-উৎসব
নীরদ নীরজা
 


    নীরদ। আমরা বড় সকাল সকাল এসেছি। এখনো এক জনো লোক আসে নি । (স্বগত) সেই ত সব তেমনিই রয়েচে ! সেই সব মনে পড়চে ! এই বকুলের তলায় ফুলগুলির উপর সে খেলা ক'রে বেড়াত ! সূর্য্যের আলো তার সঙ্গে সঙ্গে যেন নৃত্য করত! তার হাসিতে গানেতে,তার সেই সরল প্রাণের আনন্দ-হিল্লোলে গাছের কুঁড়িগুলি যেন ফুটে উঠত। আমি কি ঘোর স্বার্থপর ! সে হাসি, সে গান আমার কেন ভাল লাগত না। সেই জীবন্ত সৌন্দর্য্যরাশি আমি কেন উপভোগ করতে পারতুম না। এক দিন মনে আছে সকাল বেলায় ঐ কামিনী গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সুকুমার হাতটি বাড়িয়ে সে অন্যমনস্কে কামিনী ফুল তুলছিল, আমি পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ চমকে উঠে তার আঁচল থেকে ফুলগুলি প'ড়ে গেল, তার সেই চকিত নেত্র তার সেই লজ্জাবনত মুখখানি আমি যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি ! আহা, তাকে আর একবার তেমনি ক'রে দেখতে ইচ্ছে করচে ! এই পরিচিত গাছপালাগুলির মধ্যে সূর্য্যালোকে সে তেমনি ক'রে বেড়াক, আমি এইখেনে চুপ করে ব'সে ব'সে তাই দেখি। আমি তাকে আর ভালবাসি নে বটে, কিন্তু তাই ব'লে তার যতটুকু সুন্দর তা আমার ভাল না লাগবে কেন? আহা, সে পুরাণো দিনগুলি কোথায় গেল?
    নীরজা। এ বাগানটি কি সুন্দর !
    নীরদ। তুমি কেবল এর সৌন্দর্য্য দেখছ আমি আরো অনেক দেখতে পাচ্চি। এই বাগানের প্রত্যেক গাছের ছায়ায় প্রত্যেক লতাকুঞ্জে আমার জীবনের এক একটি দিন, এক একটি মুহুর্ত বসে রয়েচে ! বাগানের চার দিকে তারা সব ঘিরে রয়েচে! তারা কি আমাকে দেখে আজ চিনতে পারচে? অপরিচিত লোকের মত আমাকে তারা কি আজ কৌতূহলদৃষ্টিতে চেয়ে দেখচে! এমন এক কাল গিয়েচে, যখন প্রতিদিন আমি এই বাগানে আসতুম, গাছপালাগুলি প্রতিদিন আমার জন্যে যেন অপেক্ষা ক'রে থাকত, আমি এলে আমাকে যেন এস এস ব'লে ডাকত। আজ কি তারা আর আমাকে সে রকম ক'রে ডাকচে? তারা হয়ত বলচে, তুমি কে এখেনে এলে? ও কি নীরজা, তোমার মুখখানি অমন মলিন হয়ে এল কেন ?
    নীরজা। প্রিয়তম, তোমার সেই পুরণো দিনগুলির মধ্যে আমি ত একেবারেই ছিলুম না ! এমন এক দিন ছিল যখন তুমি আমাকে একেবারেই জানতে না, একেবারেই আমি তোমার পর ছিলুম তখন যদি কেউ গল্পচ্ছলে আমার কথা তোমার কাছে বলত তুমি হয়ত একটিবার মন দিয়ে শুনতে না, যদি কেউ বলত আমি ম'রে গেছি, তোমার চোখে একটি ফোঁটা জল পড়ত না! এককালে- যে আমি তোমার কেউই ছিলুম না এ মনে করলে কেমন প্রাণে ব্যথা বাজে ! অনন্তকাল হ'তে আমাদের মিলন হয় নি কেন?
    নীরদ। কেন হয় নি নীরজা ? এই মধুর গাছপালাগুলি তোমার স্মৃতির সঙ্গে কেন জড়িয়ে যায় নি ? আর এক জনের কথা কেন মনে পড়ে? আহা,যদি সেই জীবনের প্রভাতকালে তোমার ঐ প্রশান্ত মুখখানি দেখতে পেতেম ! তোমার এই উদার মমতা, গভীর প্রেম, অতলস্পর্শ হৃদয়
    নীরজা। থাক্‌ থাক্‌ ওসব কথা থাক্‌ ঐ বুঝি সব গ্রামের লোকেরা আসচে! ঐ শোন বাঁশি বেজে উঠেচে ! তবে বুঝি উৎসব আরম্ভ হ'ল ! এখন আর আমাদের এ মলিন মুখ শোভা পায় না ! এস আমরাও এ উৎসবে যোগ দিই ।
    নীরদ। হাঁ চল। একটা গান গাই। আমার বড় ইচ্ছে এখনি একবার নলিনী এসে তোমাকে দেখে ! তোমার সঙ্গে তার কতখানি প্রভেদ ! সে গাছের ফুল, আর তুমি গাছের ছায়া ! সে দু দণ্ডের শোভা, আর তুমি চিরকালের আশ্রয় ।
    নীরজা। দেখ দেখ, ছায়ার মত শীর্ণ মলিন ও রমণী কে ?
    নীরদ। ( চমকিয়া ) তাই ত, ও কে ?
                        দূরে নলিনীর প্রবেশ

    নীরদ। এ কি নলিনী, না নলিনীর স্বপ্ন ?
    নীরজা। ( নলিনীর কাছে গিয়া ) তুমি কাদের বাছা গা ? আজ এ উৎসবের দিনে তোমার মুখখানি অমন মলিন কেন ?
    নলিনী। আমি নলিনী ।
    নীরজা। ( সচকিতে ) তোমার নাম নলিনী ?
    নলিনী। হাঁ ।
    নীরজা। ( স্বগত ) আহা, এর মুখখানি কি হয়ে গেছে !  নলিনী, আমি তোর মনের দুঃখ বুঝেছি ! তাঁকে একবার এর কাছে ডেকে নিয়ে আসি !
                    ফুলির প্রবেশ
    ফুলি। ( দ্রুতবেগে আসিয়া ) কাকা, কাকা !
    নীরদ। ( বুকে টানিয়া লইয়া ) মা আমার , বাছা আমার !
    ফুলি। এত দিন কোথায় ছিলে কাকা ?
    নীরদ। সে কথা আর জিজ্ঞাসা করিস নে ফুলি ! আবার আমি তোদের কাছে এসেছি, আর আমি তোদের ছেড়ে কোথাও যাব না !
    ফুলি। কাকা, একবার দিদির কাছে চল !
    নীরদ। কেন ফুলি ?
    ফুলি। একবার দেখ'সে দিদি কি হয়ে গেছে !

                    নবীনের প্রবেশ
    নবীন। এই যে নীরদ, এসেছ ? আমরা সব স্বার্থপর কি অন্ধ হয়েই ছিলেম নীরদ ! একবার নলিনীর কাছে চল ।
    নীরদ। কেন নবীন !
    নবীন। একবার তার সঙ্গে একটি কথা কও'সে ! তোমার একটি কথা শোনবার জন্য সে আজ কত দিন ধ'রে অপেক্ষা ক'রে আছে ! কত দিন কত মাস ধরে জানলার কাছে বসে সে পথের পানে চেয়ে আছে, তোমার দেখা পায় নি ! তার সে খেলাধূলা কিছুই নেই, একেবারে ছায়ার মত হয়ে গেছে ! কত দিন পরে আজ আবার সে এই বাগানে এয়েছে, কিন্তু তার সেই হাসিটি কোথায় রেখে এল ? এ বাগানের মধ্যে তার অমন করুণ ম্লান মুখ কি চোখে দেখা যায় ! এই বাগানেই তোমার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল, এই বাগানেই বুঝি শেষ দেখা হবে !
                  (তাড়াতাড়ি নলিনীর কাছে আসিয়া)

    নীরদ। নলিনী !
            (নলিনী অতি ধীরে ধীরে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল)
    নীরদ। নলিনী !
    নলিনী। ( ধীরে ) কি নীরদ !
    নীরদ। (নলিনীর হাত ধরিয়া) আর কিছু দিন আগে কেন আমার সঙ্গে কথা কইলে না নলিনী ! আর কিছু দিন আগে কেন ঐ সুধামাখা স্বরে আমার নাম ধ'রে ডাক নি! আজ আজ এই অসময়ে কেন ডাকলে ? নলিনী নলিনী
                      (নলিনীর মূর্চ্ছিত হইয়া পতন)
    নীরজা। এ কি হ'ল, এ কি হ'ল !
    ফুলি। ( তাড়াতাড়ি ) দিদি দিদি ! কাকা, দিদির কি হ'ল?
                        ( নীরজা: নলিনীর মাথা কোলে রাখিয়া বাতাস-করণ
                                  নলিনীর মূর্চ্ছাভঙ্গ )
    নীরজা। আমি তোর দিদি হই বোন আর বেশী দিন তোকে দুঃখ পেতে হবে না, আমি তোদের মিলন করিয়ে দেব ।
    নলিনী। ( নীরজার মুখের দিকে চাহিয়া ) তুমি কে গা, তুমি কাঁদচ কেন ?
    নীরজা। আমি তোর দিদি হই বোন !


ষষ্ঠ দৃশ্য

মুমূর্ষু নীরজা । পার্শ্বে নীরদ
নবীন
 

    নীরজা। একবার নলিনীকে ডেকে দাও । বুঝি সময় চ'লে গেল ।
                                                                            [ নবীনের প্রস্থান
    আমি চল্লেম ভাই আমার সঙ্গে কেন তোমার দেখা হ'ল? আমি হতভাগিনী কেন তোমাদের মাঝখানে এলেম ? প্রিয়তম, আমি যেন চিরকাল তোমার দুঃখের স্মৃতির মত জেগে না থাকি! আমাকে ভুলে যেয়ো।
                                            নলিনীকে লইয়া নবীনের প্রবেশ
    নলিনী, বোন আমার ,তোদের আজ মিলন হোক,আমি দেখে যাই । ( পরস্পরের হাতে হাত সমর্পণ ) (নলিনীকে চুম্বন করিয়া ঈষৎ হাসিয়া ) তবে আমি চল্লেম বোন !
    নলিনী। ( নীরজাকে আলিঙ্গন করিয়া |) দিদি তুই আমার আগে চ'লে গেলি ? আমিও আর বেশী দিন থাকব না, আমিও শীগ্‌গির তোর কাছে যাচ্চি!