ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
প্রকৃতির
প্রতিশোধ
দ্বিতীয় দৃশ্য রাজপথ সন্ন্যাসী এ কী ক্ষুদ্র ধরা! এ কী বদ্ধ চারি দিকে! কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি গাছপালা গৃহ চারি দিক হতে যেন আসিছে ঘেরিয়া, গায়ের উপরে যেন চাপিয়া পড়িবে! চরণ ফেলিতে যেন হতেছে সংকোচ, মনে হয় পদে পদে রহিয়াছে বাধা। এই কি নগর! এই মহা রাজধানী! চারি দিকে ছোটো ছোটো গৃহগুহাগুলি, আনাগোনা করিতেছে নরপিপীলিকা। চারি দিকে দেখা যায় দিনের আলোক, চোখেতে ঠেকিছে যেন সৃষ্টির পঞ্জর। আলোক তো কারাগার, নিষ্ঠুর কঠিন বস্তু দিয়ে ঘিরে রাখে দৃষ্টির প্রসর। পদে পদে বাধা খেয়ে মন ফিরে আসে, কোথায় দাঁড়াবে গিয়া ভাবিয়া না পায়। অন্ধকার স্বাধীনতা, শান্তি অন্ধকার, অন্ধকার মানসের বিচরণভূমি, অনন্তের প্রতিরূপ, বিশ্রামের ঠাঁই। এক মুষ্টি অন্ধকারে সৃষ্টি ঢেকে ফেলে, জগতের আদি অন্ত লুপ্ত হয়ে যায়, স্বাধীন অনন্ত প্রাণ নিমেষের মাঝে বিশ্বের বাহিরে গিয়ে ফেলে রে নিশ্বাস। পথ দিয়ে চলিতেছে এরা সব কারা! এদের চিনি নে আমি, বুঝিতে পারি নে কেন এরা করিতেছে এত কোলাহল। কী চায়? কিসের লাগি এত ব্যস্ত এরা? এক কালে বিশ্ব যেন ছিল রে বৃহৎ, তখন মানুষ ছিল মানুষের মতো, আজ যেন এরা সব ছোটো হয়ে গেছে। দেখি হেথা বসে বসে সংসারের খেলা। কৃষকগণের প্রবেশ গান হেদে গো নন্দরানী, আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও। আমরা রাখাল-বালক দাঁড়িয়ে দ্বারে, আমাদের শ্যামকে দিয়ে যাও। হেরো গো প্রভাত হল সুয্যি উঠে ফুল ফুটেছে বনে— আমরা শ্যামকে নিয়ে গোষ্ঠে যাব আজ করেছি মনে। ওগো, পীতধড়া পরিয়ে তারে কোলে নিয়ে আয়। তার হাতে দিয়ো মোহন বেণু, নূপুর দিয়ো পায়। রোদের বেলায় গাছের তলায় নাচব মোরা সবাই মিলে। বাজবে নূপুর রুনুঝুনু বাজবে বাঁশি মধুর বোলে। বনফুলে গাঁথব মালা, পরিয়ে দিব শ্যামের গলে। [প্রস্থান |
বালক-পুত্র সমেত স্ত্রীলোকের প্রবেশ
স্ত্রীলোক । ( ব্রাহ্মণ পথিকের প্রতি ) হ্যাঁগা দাদাঠাকুর, এত ব্যস্ত হয়ে
কম্নে চলেছ?
ব্রাহ্মণ। আজ শিষ্যবাড়ি চলেছি নাতনি। অনেকগুলি ঘর আজকের মধ্যে সেরে আসতে হবে,
তাই সকাল সকাল বেরিয়েছি। তুমি কোথায় যাচ্ছ গা?
স্ত্রীলোক। আমি ঠাকুরের পুজো দিতে যাব। ঘরকন্নার কাজ ফেলে এসেছি, মিনসে
আবার রাগ করবে। পথে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে যে জিগ্গেসপড়া করব তার জো নেই। বলি
দাদাঠাকুর, আমাদের ও দিকে যে এক বার পায়ের ধুলো পড়ে না!
ব্রাহ্মণ। আর ভাই, বুড়োসুড়ো হয়ে পড়েছি, তোদের এখন নবীন বয়েস, কী জানি পছন্দ
না হয়। যার দাঁত পড়ে গেছে, তার চালকড়াইভাজার দোকানে না যাওয়াই ভালো।
স্ত্রীলোক। নাও, নাও, রঙ্গ রেখে দাও।
আর এক স্ত্রীলোক। এই-যে ঠাকুর, আজকাল তুমি যে বড়ো মাগ্গি হয়েছ।
ব্রাহ্মণ। মাগ্গি আর হলেম কই। সক্কালবেলায় পথের মধ্যে তোরা পাঁচ জনে মিলে
আমাকে টানাছেঁড়া আরম্ভ করেছিস। তবু তো আমার সেকাল নেই।
প্রথমা। আমি যাই ভাই, ঘরের সমস্ত কাজ পড়ে রয়েছে।
দ্বিতীয়া। তা এস।
প্রথমা। (পুনর্বার ফিরিয়া) হ্যাঁলা অলঙ্গ, তোদের পাড়ায় সেই-যে কথাটা
শুনেছিলুম, সে কি সত্যি!
দ্বিতীয়া। সে ভাই বেস্তর কথা।
[সকলের চুপি চুপি কথোপকথন
আর-কতকগুলি পথিকের প্রবেশ
প্রথম । আমাকে অপমান! আমাকে চেনে না সে! তার কাঁধে কটা মাথা আছে দেখতে হবে!
তার ভিটেমাটি উচ্ছন্ন করে তবে ছাড়ব।
দ্বিতীয়। ঠিক কথা। তা না হলে তো সে জব্দ হবে না।
প্রথম। জব্দ বলে জব্দ! তাকে নাকের জলে চোখের জলে করব।
তৃতীয়। শাবাশ দাদা, একবার উঠেপড়ে লাগো তো।
চতুর্থ। লোকটার বড়ো বাড় বেড়েছে।
পঞ্চম। পিঁপিড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে।
দ্বিতীয়। অতি দর্পে হত লঙ্কা।
চতুর্থ। আচ্ছা, তুমি কী করবে শুনি দাদা!
দ্বিতীয়। কী না করতে পারি! গাধার উপরে চড়িয়ে মাথায় ঘোল ঢালিয়ে শহর ঘুরিয়ে
বেড়াতে পারি। তার এক গালে চুন এক গালে কালি লাগিয়ে দেশ থেকে দূর করে দিতে
পারি, তার ভিটেয় ঘুঘু চরাতে পারি।
[ক্রোধে প্রস্থান। হাসিতে হাসিতে অন্য পথিকগণের অনুগমন
প্রথম স্ত্রী। মাইরি, দাদাঠাকুর, আর হাসতে পারি নে, তোমার রঙ্গ রেখে দাও।
ওমা, বেলা হয়ে গেল। আজ আর মন্দিরে যাওয়া হল না। আবার আর-এক দিন আসতে হবে। (সক্রোধে)
পোড়ারমুখো ছেলে, তোর জন্যেই তো যাওয়া হল না, তুই আবার পথের মধ্যে খেলতে
গিয়েছিলি কোথা?
ছেলে। কেন মা, আমি তো এইখেনেই ছিলেম।
স্ত্রী । ফের আবার নেই করছিস!
[প্রহার, ক্রন্দন ও প্রস্থান
দুই জন ব্রাহ্মণ-বটুর প্রবেশ
প্রথম। মাধব শাস্ত্রীরই জয়।
দ্বিতীয়। কখনো না, জনার্দন পণ্ডিতই জয়ী।
প্রথম। শাস্ত্রী বলছেন স্থূল থেকে সূক্ষ্ম উৎপন্ন হয়েছে।
দ্বিতীয়। গুরু জনার্দন বলছেন, সূক্ষ্ম থেকে স্থূল উৎপন্ন হয়েছে।
প্রথম। সে যে অসম্ভব কথা।
দ্বিতীয়। সেই তো বেদবাক্য।
প্রথম। কেমন করে হবে! বৃক্ষ থেকে তো বীজ।
দ্বিতীয়। দূর মূর্খ, বীজ থেকেই তো বৃক্ষ।
প্রথম। আগে দিন না আগে রাত?
দ্বিতীয়। আগে রাত।
প্রথম। কেমন করে! দিন না গেলে তো রাত হবে না!
দ্বিতীয়। রাত না গেলে তো দিন হবে না।
প্রথম। (প্রণাম করিয়া) ঠাকুর, একটা সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে।
সন্ন্যাসী। কী সংশয়?
দ্বিতীয়। প্রভু, আমাদের দুই গুরুর বিচার শুনে অবধি আমরা দুই জনে মিলে তিন
দিন তিন রাত্রি অনবরত ভাবছি স্থূল হতে সূক্ষ্ম, না সূক্ষ্ম হতে স্থূল,
কিছুতেই নির্ণয় করিতে পারছি নে।
সন্ন্যাসী।
স্থূল কোথা!
স্থূল সূক্ষ্ম ভেদ কিছু নাই,
নানারূপে ব্যক্ত হয় শক্তি প্রকৃতির।
সবই সূক্ষ্ম, সবই শক্তি, স্থূল সে তো ভ্রম।
প্রথম।
আমিও তো তাই বলি। আমার মাধব গুরুও
তো তাই বলেন।
দ্বিতীয়।
আমারও তো ঐ মত। আমার জনার্দন গুরুরও তো
ওই মত।
উভয়ে।
(প্রণাম করিয়া) চললেম প্রভু।
[বিবাদ করিতে করিতে প্রস্থান
সন্ন্যাসী।
হা
রে মূর্খ, দুজনেই বুঝিল না কিছু।
এক খণ্ড কথা পেয়ে লভিল সান্ত্বনা।
জ্ঞানরত্ন খুঁজে খুঁজে খনি খুঁড়ে মর
—
মুঠো মুঠো বাক্যধুলা আঁচল পুরিয়া,
আনন্দে অধীর হয়ে ঘরে নিয়ে যায়।
এক দল মালিনীর প্রবেশ
গান
বুঝি বেলা বহে যায়,
কাননে আয়, তোরা আয়।
আলোতে ফুল উঠল ফুটে, ছায়ায় ঝরে পড়ে যায়।
সাধ ছিল রে পরিয়ে দেব মনের মতন মালা গেঁথে,
কই সে হল
মালা গাঁথা, কই সে এল হায়,
যমুনার
ঢেউ যাচ্ছে বয়ে, বেলা চলে যায়।
পথিক। কেন গো এত দুঃখ কিসের! মালা যদি থাকে তো গলাও ঢের আছে।
মালিনী। হাড়কাঠও তো কম নেই।
দ্বিতীয় মালিনী। পোড়ারমুখো মিন্সে, গোরুবাছুর নিয়েই আছে। আর,আমি যে গলা
ভেঙে মরছি, আমার দিকে এক বার তাকালেও না! (কাছে গিয়া গা ঘেঁষিয়া) মর্ মিন্সে
গায়ের উপর পড়িস কেন?
সেই লোক। গায়ে পড়ে ঝগড়া কর কেন! আমি সাত হাত তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলুম।
দ্বিতীয় মালিনী। কেনে গা! আমরা বাঘ না ভাল্লুক! না হয় একটু কাছেই আসতে! খেয়ে
তো ফেলতুম না।
[হাসিতে হাসিতে সকলের প্রস্থান
একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুকের প্রবেশ
গান
ভিক্ষে দে গো ভিক্ষে দে।
দ্বারে দ্বারে বেড়াই ঘুরে, মুখ তুলে কেউ চাইলি নে।
লক্ষ্মী তোদের সদয় হন, ধনের উপর বাড়ুক ধন—
আমি
একটি মুঠো অন্ন চাই গো, তাও কেন
পাই নে।
ওই রে সূর্য উঠল মাথায়, যে যার ঘরে চলেছে—
পিপাসাতে ফাটছে ছাতি চলতে আর যে পারি নে।
ওরে, তোদের অনেক আছে, আরো অনেক হবে—
একটি মুঠো দিবি শুধু, আর কিছু চাহি নে।
একদল সৈনিক । (ধাক্কা মারিয়া) সরে যা, সরে যা, পথ ছেড়ে দে। বেটা, চোখ নেই!
দেখছিস নে মন্ত্রীর পুত্র আসছেন!
[বাদ্য বাজাইয়া চতুর্দোলা চড়িয়া মন্ত্রিপুত্রের প্রবেশ
ও প্রস্থান
সন্ন্যাসী।
মধ্যাহ্ন আইল, অতি তীক্ষ্ম
রবিকর।
শূন্য যেন তপ্ত তাম্র-কটাহের মতো।
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিক; তপ্ত বায়ুভরে
থেকে থেকে ঘুরে ঘুরে উড়িছে বালুকা।
সকাল হইতে আছি, কী দেখিনু হেথা?
এ দীর্ঘ পরান মোর সংকুচিত ক’রে
পারি কি এদের সাথে মিশিতে আবার।
কী ঘোর স্বাধীন আমি! কী মহা আলয়।
জগতের বাধা নাই—
শূন্যে করি বাস।