ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


প্রকৃতির প্রতিশোধ


                         
তৃতীয় দৃশ্য
                         অপরাহ্ন । পথ

প্রথম পথিক। পান্থগণ, সরে যাও। হেরো, আসিতেছে
                 ধর্মভ্রষ্ট অনাচারী রঘুর দুহিতা।

                    বালিকার প্রবেশ

প্রথম পথিক। ছুঁস নে ছুঁস নে মোরে

দ্বিতীয় পথিক।
     সরে যা অশুচি।
তৃতীয় পথিক।
   হতভাগী জানিস নে রাজপথ দিয়ে
                      আনাগোনা করে যত নগরের লোক—
                     ম্লেচ্ছকন্যা, তুই কেন চলিস এ পথে!

                          বালিকার পথপার্শ্বে বৃক্ষতলে সরিয়া যাওন
একজন বৃদ্ধা। কে তুমি গা, কার বাছা, চোখে অশ্রুজল,
                   ভিখারিনী বেশে কেন রয়েছে দাঁড়ায়ে
                   এক পাশে?

                 কাঁদিয়া উঠিয়া

বালিকা।
        জননী গো আমি অনাথিনী।
বৃদ্ধা।
       আহা মরে যাই!
পথিকগণ।
       ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ওর

               কে গো তুমি, জান না কি অনাচারী রঘু,
              তাহারি দুহিতা ও যে!
বৃদ্ধা।
             ছি ছি ছি, কী ঘৃণা।!
                            [প্রস্থান

           দেবীমন্দিরের কাছে গিয়া

বালিকা।
        জগৎ-জননী মাগো, তুমিও কি মোরে
                   নেবে না? তুমিও কি, মা ত্যেজিবে অনাথে?
                   ঘৃণায় সবাই যারে দেয় দূর করে
                   সে কি, মা, তোমারো কোলে পায় না আশ্রয়?
মন্দিররক্ষক।
  দূর হ ! দূর হ তুই অনার্যা অশুচি!
                   কী সাহসে এসেছিস মন্দিরের মাঝে!

                        জননী ও দুহিতার প্রবেশ

জননী।
      আরতির বেলা হল, আয় বাছা আয়।
                আয় রে আয় রে মোর বুক-চেরা ধন।
                মন্দিরের দীপ হতে কাজল পরাব,
                অকল্যাণ যত কিছু যাবে দূর হয়ে।
কন্যা।
       ও কে ও মা!
জননী।
           ও কেউ না, সরে আয় বাছা।!
                          [প্রস্থান

বালিকা।
     এ কি কেউ না মা! এ কি নিতান্ত অনাথা!
                এর কি মা ছিল না গো! ও মা, কোথা তুমি!

                       সন্ন্যাসীকে দেখিয়া
                  প্রভু, কাছে যাব আমি?
সন্ন্যাসী।
      এসো বৎসে, এসো।
বালিকা।
      অনার্যা অশুচি আমি।
                        হাসিয়া
সন্ন্যাসী।
     সকলেই তাই।
                সেই শুচি ধুয়েছে যে সংসারের ধুলা।
                দূরে দাঁড়াইয়া কেন! ভয় নাই বাছা।
                       চমকিয়া
বালিকা।
    ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, আমি রঘুর দুহিতা।
সন্ন্যাসী।
    নাম কি তোমার বৎসে?
বালিকা।
   কেমনে বলিব?
               কে আমারে নাম ধরে ডাকিবে প্রভু গো,
                বাল্যে পিতৃমাতৃহীনা আমি।
সন্ন্যাসী।
         বোসো হেথা।
                  কাঁদিয়া উঠিয়া
বালিকা।
    প্রভু, প্রভু, দয়াময়, তুমি পিতা মাতা,
               একবার কাছে তুমি ডেকেছ যখন
               আর মোরে দূর করে দিয়ো না কখনো।
সন্ন্যাসী।
     মুছ অশ্রুজল বৎসে, আমি যে সন্ন্যাসী।
                নাইকো কাহারো ' পরে ঘৃণা-অনুরাগ।
                যে আসে আসুক কাছে, যায় যাক দূরে,
                জেনো বৎসে, মোর কাছে সকলি সমান।
বালিকা।
     আমি, প্রভু, দেব নর সবারি তাড়িত,
                মোর কেহ নাই

সন্ন্যাসী।
           আমারো তো কেহ নাই।
               দেব নর সকলেরে দিয়েছি তাড়ায়ে।
বালিকা।
   তোমার কি মাতা নাই?
সন্ন্যাসী।
    নাই।
বালিকা।
    পিতা নাই?
সন্ন্যাসী।
    নাই বৎসে।
বালিকা।
         সখা কেহ নাই?
সন্ন্যাসী।
             কেহ নাই।
বালিকা।
     আমি তবে কাছে রব, ত্যেজিবে না মোরে?
সন্ন্যাসী।
     তুমি না ত্যেজিলে মোরে আমি ত্যেজিব না।
বালিকা।
     যখন সবাই এসে কহিবে তোমারে—
                রঘুর দুহিতা, ওরে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না,
                অনার্য অশুচি ও যে ম্লেচ্ছ ধর্মহীন

               তখনো কি ত্যেজিবে না? রাখিবে কি কাছে?
সন্ন্যাসী।
    ভয় নাই, চল্‌ বৎসে, তোর গৃহ যেথা।           [প্রস্থান


                চতুর্থ দৃশ্য
          পথপার্শ্বে বালিকার ভগ্নকুটির
বালিকা। পিতা!
সন্ন্যাসী।
      আহা ,পিতা বলে কে ডাকিলি ওরে!
            সহসা শুনিয়া যেন চমকি উঠিনু।
বালিকা। কী শিক্ষা দিতেছ প্রভু, বুঝিতে পারি নে।
            শুধু বলে দাও মোরে আশ্রয় কোথায়।
            কে আমারে ডেকে নেবে, কাছে করে নেবে,
            মুখ তুলে মুখপানে কে চাহিবে মোর?
সন্ন্যাসী। আশ্রয় কোথায় পাবি এ সংসারমাঝে!
            এ জগৎ অন্ধকারে প্রকাণ্ড গহ্বর—
            আশ্রয় আশ্রয় বলে শত লক্ষ প্রাণী
            বিকট গ্রাসের মাঝে ধেয়ে পড়ে গিয়া,
            বিশাল জঠরকুণ্ডে কোথা পায় লোপ।
            মিথ্যা রাক্ষসীরা মিলে বাঁধিয়াছে হাট,
            মধুর দুর্ভিক্ষরাশি রেখেছে সাজায়ে,
            তাই চারি দিক হতে আসিছে অতিথি।
            যত খায় ক্ষুধা জ্বলে, বাড়ে অভিলাষ,
            অবশেষে সাধ যায় রাক্ষসের মতো
            জগৎ মুঠায় করে মুখেতে পুরিতে।
            হেথা হতে চলে আয় — চলে আয় তোরা।
বালিকা। এখানে তো সকলেই সুখে আছে পিতা।
            দূরেতে দাঁড়িয়ে আমি চেয়ে চেয়ে দেখি!
সন্ন্যাসী। হায় হায়, ইহাদের বুঝাব কেমনে!
            সুখ দুঃখ সে তো, বাছা জগতের পীড়া!
            জগৎ জীবন্ত মৃত্যু — অনন্ত যন্ত্রণা!
            মরণ মরিতে চায় মরিছে না তবু—
            চিরদিন মৃত্যুরূপে রয়েছে বাঁচিয়া।
            জগৎ মৃত্যুর নদী চিরকাল ধরে
           পড়িছে সমুদ্রমাঝে, ফুরায় না তবু —
           প্রতি ঢেউ, প্রতি তৃণ, প্রতি জলকণা
           কিছুই থাকে না, তবু সে থাকে সমান!
           বিশ্ব মহা মৃতদেহ, তারি কীট তোরা
           মরণেরে খেয়ে খেয়ে রয়েছিস বেঁচে—
           দু-দণ্ড ফুরায়ে যাবে কিলিবিলি করি,
           আবার মৃতের মাঝে রহিবি মরিয়া।
বালিকা। কী কথা বলিছ পিতা ভয় হয় শুনে।
           পথে এক জন ভিক্ষুক পথিকের প্রবেশ
পথিক । আশ্রয় কোথায় পাব? আশ্রয় কোথায়?
           সন্ন্যাসী। আশ্রয় কোথাও নাই — কে চাহে আশ্রয়?
           আশ্রয় কেবল আছে আপনার মাঝে।
           আমি ছাড়া যাহা-কিছু সকলি সংশয়।
           আপনারে খুঁজে লও, ধরো তারে বুকে,
           নহিলে ডুবিতে হবে সংশয়পাথারে।
পথিক। আশ্রয় কে দেবে মোরে? আশ্রয় কোথায়?
সন্ন্যাসী। আশ্রয় কোথাও নাইকে চাহে আশ্রয়?
            আশ্রয় কেবল আছে আপনার মাঝে।
            আমি ছাড়া যাহা-কিছু সকলি সংশয়।
            আপনারে খুঁজে লও তারে বুকে,
            নাহিলে ডুবিতে হবে সংশয়পাথারে।

পথিক। আশ্রয় কে দেবে মোরে? আশ্রয় কোথায়?
                বাহিরে আসিয়া
বালিকা। আহা, কে গো, আসিবে কি এ মোর কুটিরে?
            কাল প্রাতে চলে যেয়ো শ্রান্তি দূর করে।
           একপাশে পর্ণশয্যা রেখেছি বিছায়ে,
           এনে দেব ফলমূল নির্ঝরের জল।
পথিক। কে তুমি গো?
বালিকা।
          তোমাদেরি একজন আমি।
পথিক।
  পিতার কী নাম তব? কে তুমি বালিকা?
বালিকা। পরিচয় না পেলে কি আসিবে না ঘরে?
            তবে শুন পরিচয় — রঘু পিতা মম,
            অনার্যা অশুচি আমি, বিশ্বের ঘৃণিত।
                       চমকিয়া
পথিক। রঘুর দুহিতা তুমি? সুখে থাকো বাছা!
কাজ আছে অন্যত্তরে, ত্বরা যেতে হবে।
                            [প্রস্থান

একটা খাট মাথায় হাসিতে হাসিতে পথে এক দল লোকের প্রবেশ

সকলে মিলিয়া। হরিবোল— হরিবোল!
প্রথম। বেটা এখনো জাগল না রে।
দ্বিতীয়। বিষম ভারী।
এক জন পথিক। কে হে, কাকে নিয়ে যাও।
তৃতীয়। বিন্দে তাঁতি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিল, বেটাকে খাটসুদ্ধ উঠিয়ে এনেছি।
সকলে। হরিবোল— হরিবোল!
দ্বিতীয়। আর ভাই বইতে পারি নে, একবার ঝাঁকা দাও, শালা জেগে উঠুক।
বিন্দে। (সহসা জাগিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ উঁ উঁ!
তৃতীয়। ওরে, শব্দ করে কে রে।
বিন্দে। ওগো, ওগো, এ কী! আমি কোথায় যাচ্ছি!
সকলে। (খাট নামাইয়া) চুপ কর্ বেটা!
দ্বিতীয়। শালা মরে গিয়েও কথা কয়!
চতুর্থ। তুই যে মরেছিস রে! হাত-পাগুলো সিধে করে চিত হয়ে পড়ে থাক্‌।
বিন্দে। আমি মরি নি, আমি ঘুমোচ্ছিলুম।
পঞ্চম। মরেছিস তোর হুঁশ নেই, তুই তর্ক করতে বসলি! এমনি বেটার বুদ্ধি বটে!
ষষ্ঠ। ওর কথা শোন কেন! বিপদে পড়ে এখন মিথ্যে কথা বলছে।
সপ্তম। মিছে দেরি কর কেন? ও কি আর কবুল করবে? চলো ওকে পুড়িয়ে নিয়ে আসি গে।
বিন্দে। দোহাই বাবা, আমি মরি নি। তোদের পায়ে পড়ি বাবা, আমি মরি নি।
প্রথম। আচ্ছা, আগে প্রমাণ কর্ তুই মরিস নি।
বিন্দে। হাঁ, আমি প্রমাণ করে দেব, আমার স্ত্রীর হাতে শাঁখা আছে দেখবে চলো।
দ্বিতীয়। না, তা না, ওকে মার্, দেখি ওর লাগে কি না।
তৃতীয়। (মারিয়া) লাগছে?
বিন্দে। উঃ!
চতুর্থ। এটা কেমন লাগল?
বিন্দে। ও বাবা!
পঞ্চম। এটা কেমন?
বিন্দে। তুমি আমার ধর্মবাপ।
               [সহসা ছুটিয়া পলায়ন ও হাসিতে হাসিতে সকলের অনুগমন

সন্ন্যাসী। আহা শ্রান্তদেহে বালা ঘুমিয়ে পড়েছে!
            ভুলে গেছে সংসারের অনাদর-জ্বালা।
            কঠিন মাটিতে শুয়ে শিরে হাত দিয়ে
            ঘুমের মায়ের কোলে রয়েছে আরামে।
            যেন এই বালিকার ছোটো হাত দুটি
            হৃদয়েরে অতি ধীর করিছে বেষ্টন।
            পালা, পালা, এইবেলা, পালা এইবেলা।
            ঘুমিয়েছে, এইবেলা ওঠ্‌ রে সন্ন্যাসী!
            পলায়ন! পলায়ন! ছি ছি পলায়ন!
            অবহেলা করি আমি বিশ্বজগতেরে,
            বালিকা দেখিয়া শেষে পলাইতে হবে!
            কখনো না, পালাব না, রহিব এমনি।
            প্রকৃতি, এই কি তোর মায়াফাঁদ যত!
            এ ঊর্ণাজালে তো শুধু পতঙ্গেরা পড়ে।

                        চমকিয়া জাগিয়া

বালিকা। প্রভু চলে গেছ তুমি! গেছ কি ফেলিয়া!
সন্ন্যাসী। কেন যাব! কার ভয়ে পলাইব আমি!
            ছায়ার মতন তোরে রাখিব কাছেতে,
            তবুও রহিব আমি দূর হতে দূরে।
বালিকা। ওই শোনো, রাজপথে মহা কোলাহল।
সন্ন্যাসী। কোলাহল-মাঝে আমি রচিব নির্জন,
            নগরে পথের মাঝে তপোবন মোর,
            পাতিব প্রলয়াসন সৃষ্টির হৃদয়ে।
            একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোকের প্রবেশ

প্রথমা স্ত্রী। (কোনো পুরুষের প্রতি) যাও, যাও, আর মুখের ভালোবাসা দেখাতে হবে না!
প্রথম পুরুষ। কেন, কী অপরাধ করলুম?
স্ত্রী। জানি গো জানি, তোমরা পুরুষ-মানুষ, তোমাদের পাষাণ প্রাণ।
প্রথম পুরুষ। আচ্ছা, আমাদের পাষাণ প্রাণই যদি হবে, তবে ফুলশরকে কেন ডরাই? (অন্য সকলের প্রতি) কী বল ভাই? যদি পাষাণই হবে তবে কি আর ফুলশরের আঁচড় লাগে!
দ্বিতীয় পুরুষ। বাহবা, বেশ বলেছ।
তৃতীয় পুরুষ। শাবাশ, খুড়ো, শাবাশ।
চতুর্থ পুরুষ। (স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন! এখন জবাব দাও।
প্রথম পুরুষ। না, তাই বলছি। তোমরা তো দশ জন আছ, তোমরাই বিচার করে বলো-না কেন, যদি পাষাণ প্রাণই হবে,তবে—
পঞ্চম পুরুষ। ঠিক কথা বলেছ। তুমি না হলে আমাদের মুখরক্ষা করত কে।
ষষ্ঠ পুরুষ। খুড়ো এক-একটা কথা বড়ো সরেস বলে।
সপ্তম পুরুষ। হাঁঃ আমিও অমন বলতে পারতুম। ও কি আর নিজে বলে? কোন্‌ এক পুঁথি থেকে পড়ে বলছে।
অষ্টম পুরুষ। (আসিয়া)। কী হে কী কথাটা হচ্ছে? কী কথাটা হচ্ছে?
প্রথম পুরুষ। শোনো, তোমায় বুঝিয়ে বলি। এই উনি বলছিলেন, তোমরা পুরুষ-মানুষ, তোমাদের পাষাণ প্রাণ। তাইতে আমি বললেম, আচ্ছা যদি পাষাণ প্রাণই হবে, তবে ফুলশরের আঁচড় লাগবে কী করে? বুঝেছ ভাবখানা? অর্থাৎ যদি—
অষ্টম পুরুষ। আমাকে আর বোঝাতে হবে না দাদা। আমি আর বুঝি নি! আজ বাইশ বৎসর ধরে আমি নিজ শহরে গুড়ের কারবার করে আসছি আর একটা মানে বুঝতে পারব না এ কোন্‌ কথা।
প্রথম পুরুষ। (স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন, এখন একটা জবাব দাও।

                        সকল স্ত্রীলোক মিলিয়া গান

             কথা কোস নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে।
             কে জানে ও কেমন করে মন কেড়েছে।
             শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি,
             গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে।

                    একজন পুরুষের গান

             প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে,
             রাঙা চরণতলে নেচে নেচে।
             ঢিপঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা,
             কানের কাছে কচ‍্কচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে।

দ্বিতীয় পুরুষ। বাহবা দাদা, বেশ গেয়েছ।
তৃতীয় পুরুষ। বেশ, বেশ, সাবাশ।
সপ্তম পুরুষ। আরে দূর, ওকে কি আর গান বলে। গাইত বটে নিতাই; যে হাঁ, শুনে চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়ত।
       [প্রস্থান