ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
প্রকৃতির প্রতিশোধ
দেবীমন্দিরের কাছে গিয়া
বালিকা।
জগৎ-জননী মাগো, তুমিও কি মোরে
নেবে না? তুমিও কি, মা ত্যেজিবে অনাথে?
ঘৃণায় সবাই যারে দেয় দূর করে
সে কি, মা, তোমারো কোলে পায় না আশ্রয়?
মন্দিররক্ষক।
দূর হ ! দূর হ তুই অনার্যা অশুচি!
কী সাহসে এসেছিস মন্দিরের মাঝে!
জননী ও দুহিতার প্রবেশ
জননী।
আরতির বেলা হল,
আয় বাছা আয়।
আয় রে আয় রে মোর বুক-চেরা ধন।
মন্দিরের দীপ হতে কাজল পরাব,
অকল্যাণ যত কিছু যাবে দূর হয়ে।
কন্যা।
ও কে ও
মা!
জননী।
ও কেউ না, সরে আয় বাছা।!
[প্রস্থান
বালিকা।
এ কি কেউ না মা! এ কি
নিতান্ত অনাথা!
এর কি মা ছিল না গো! ও মা, কোথা তুমি!
সন্ন্যাসীকে দেখিয়া
প্রভু, কাছে যাব আমি?
সন্ন্যাসী।
এসো বৎসে, এসো।
বালিকা।
অনার্যা অশুচি
আমি।
হাসিয়া
সন্ন্যাসী।
সকলেই তাই।
সেই শুচি ধুয়েছে যে সংসারের ধুলা।
দূরে দাঁড়াইয়া কেন! ভয় নাই বাছা।
চমকিয়া
বালিকা।
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, আমি
রঘুর দুহিতা।
সন্ন্যাসী।
নাম কি তোমার বৎসে?
বালিকা।
কেমনে বলিব?
কে আমারে নাম ধরে ডাকিবে প্রভু গো,
বাল্যে পিতৃমাতৃহীনা আমি।
সন্ন্যাসী।
বোসো হেথা।
কাঁদিয়া উঠিয়া
বালিকা।
প্রভু, প্রভু, দয়াময়, তুমি
পিতা মাতা,
একবার কাছে তুমি ডেকেছ যখন
আর মোরে দূর করে দিয়ো না কখনো।
সন্ন্যাসী।
মুছ অশ্রুজল বৎসে, আমি
যে সন্ন্যাসী।
নাইকো কাহারো ' পরে ঘৃণা-অনুরাগ।
যে আসে আসুক কাছে, যায় যাক দূরে,
জেনো বৎসে, মোর কাছে সকলি সমান।
বালিকা।
আমি, প্রভু, দেব নর
সবারি তাড়িত,
মোর কেহ নাই—
সন্ন্যাসী।
আমারো তো কেহ নাই।
দেব নর সকলেরে দিয়েছি তাড়ায়ে।
বালিকা।
তোমার কি মাতা নাই?
সন্ন্যাসী।
নাই।
বালিকা।
পিতা নাই?
সন্ন্যাসী।
নাই বৎসে।
বালিকা।
সখা কেহ নাই?
সন্ন্যাসী।
কেহ নাই।
বালিকা।
আমি তবে কাছে রব,
ত্যেজিবে না মোরে?
সন্ন্যাসী।
তুমি না ত্যেজিলে মোরে
আমি ত্যেজিব না।
বালিকা।
যখন সবাই এসে কহিবে
তোমারে—
রঘুর দুহিতা, ওরে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না,
অনার্য অশুচি ও যে ম্লেচ্ছ ধর্মহীন—
তখনো কি ত্যেজিবে না? রাখিবে কি কাছে?
সন্ন্যাসী।
ভয় নাই, চল্ বৎসে, তোর গৃহ
যেথা।
[প্রস্থান
চতুর্থ দৃশ্য
সন্ন্যাসী। আহা শ্রান্তদেহে বালা ঘুমিয়ে পড়েছে!
ভুলে গেছে সংসারের অনাদর-জ্বালা।
কঠিন মাটিতে শুয়ে শিরে হাত দিয়ে
ঘুমের মায়ের কোলে রয়েছে আরামে।
যেন এই বালিকার ছোটো হাত দুটি
হৃদয়েরে অতি ধীর করিছে বেষ্টন।
পালা, পালা, এইবেলা, পালা এইবেলা।
ঘুমিয়েছে, এইবেলা ওঠ্ রে সন্ন্যাসী!
পলায়ন! পলায়ন! ছি ছি পলায়ন!
অবহেলা করি আমি বিশ্বজগতেরে,
বালিকা দেখিয়া শেষে পলাইতে হবে!
কখনো না, পালাব না, রহিব এমনি।
প্রকৃতি, এই কি তোর মায়াফাঁদ যত!
এ ঊর্ণাজালে তো শুধু পতঙ্গেরা পড়ে।
চমকিয়া জাগিয়া
বালিকা। প্রভু চলে গেছ তুমি! গেছ কি ফেলিয়া!
সন্ন্যাসী। কেন যাব! কার ভয়ে পলাইব আমি!
ছায়ার মতন তোরে রাখিব কাছেতে,
তবুও রহিব আমি দূর হতে দূরে।
বালিকা। ওই শোনো, রাজপথে মহা কোলাহল।
সন্ন্যাসী। কোলাহল-মাঝে আমি রচিব নির্জন,
নগরে পথের মাঝে তপোবন মোর,
পাতিব প্রলয়াসন সৃষ্টির হৃদয়ে।
একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোকের প্রবেশ
প্রথমা স্ত্রী। (কোনো পুরুষের প্রতি) যাও, যাও, আর মুখের ভালোবাসা দেখাতে
হবে না!
প্রথম পুরুষ। কেন, কী অপরাধ করলুম?
স্ত্রী। জানি গো জানি, তোমরা পুরুষ-মানুষ, তোমাদের পাষাণ প্রাণ।
প্রথম পুরুষ। আচ্ছা, আমাদের পাষাণ প্রাণই যদি হবে, তবে ফুলশরকে কেন ডরাই? (অন্য
সকলের প্রতি) কী বল ভাই? যদি পাষাণই হবে তবে কি আর ফুলশরের আঁচড় লাগে!
দ্বিতীয় পুরুষ। বাহবা, বেশ বলেছ।
তৃতীয় পুরুষ। শাবাশ, খুড়ো, শাবাশ।
চতুর্থ পুরুষ। (স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন! এখন জবাব দাও।
প্রথম পুরুষ। না, তাই বলছি। তোমরা তো দশ জন আছ, তোমরাই বিচার করে বলো-না
কেন, যদি পাষাণ প্রাণই হবে,তবে—
পঞ্চম পুরুষ। ঠিক কথা বলেছ। তুমি না হলে আমাদের মুখরক্ষা করত কে।
ষষ্ঠ পুরুষ। খুড়ো এক-একটা কথা বড়ো সরেস বলে।
সপ্তম পুরুষ। হাঁঃ আমিও অমন বলতে পারতুম। ও কি আর নিজে বলে? কোন্ এক পুঁথি
থেকে পড়ে বলছে।
অষ্টম পুরুষ। (আসিয়া)। কী হে কী কথাটা হচ্ছে? কী কথাটা হচ্ছে?
প্রথম পুরুষ। শোনো, তোমায় বুঝিয়ে বলি। এই উনি বলছিলেন, তোমরা পুরুষ-মানুষ,
তোমাদের পাষাণ প্রাণ। তাইতে আমি বললেম, আচ্ছা যদি পাষাণ প্রাণই হবে, তবে
ফুলশরের আঁচড় লাগবে কী করে? বুঝেছ ভাবখানা? অর্থাৎ যদি—
অষ্টম পুরুষ। আমাকে আর বোঝাতে হবে না দাদা। আমি আর বুঝি নি! আজ বাইশ বৎসর
ধরে আমি নিজ শহরে গুড়ের কারবার করে আসছি আর একটা মানে বুঝতে পারব না এ কোন্
কথা।
প্রথম পুরুষ। (স্ত্রীলোকের প্রতি) কেমন, এখন একটা জবাব দাও।
সকল স্ত্রীলোক মিলিয়া গান
কথা কোস নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে।
কে জানে ও কেমন করে মন কেড়েছে।
শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি,
গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে।
একজন পুরুষের গান
প্রিয়ে, তোমার ঢেঁকি হলে যেতেম বেঁচে,
রাঙা চরণতলে নেচে নেচে।
ঢিপঢিপিয়ে যেতেম মারা, মাথা খুঁড়ে হতেম সারা,
কানের কাছে কচ্কচিয়ে মানটি তোমার নিতেম যেচে।
দ্বিতীয় পুরুষ। বাহবা দাদা, বেশ গেয়েছ।
তৃতীয় পুরুষ। বেশ, বেশ, সাবাশ।
সপ্তম পুরুষ। আরে দূর, ওকে কি আর গান বলে। গাইত বটে নিতাই; যে হাঁ, শুনে
চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়ত।
[প্রস্থান