ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


প্রকৃতির প্রতিশোধ


                
পঞ্চম দৃশ্য
                 গুহাদ্বারে
বালিকা। না পিতা, ও-সব কথা বলো না আমারে—
            শুনে ভয় করে শুধু , বুঝিতে পারি নে।
সন্ন্যাসী। তবে থাক্‌, তবে তুই কাছে আয় মোর,
            দেখি তোর অতিমৃদু স্পর্শ সুকোমল।
            আহা, তোর স্পর্শ মোর ধ্যানের মতন—
            সীমা হতে নিয়ে যায় অসীমের দ্বারে।
            এ কি মায়া? এ কি স্বপ্ন? এ কি মোহঘোর?
            জগৎ কি মায়া করে ছায়া হয়ে গিয়ে
            করিছে প্রাণের কাছে অনন্তের ভান?

                      দূরে সরিয়া

            বালিকা, এ সব কথা না শুনিবি যদি
            সন্ন্যাসীর কাছে তবে এলি কী আশায়?
বালিকা। আমি শুধু কাছে কাছে রহিব তোমার,
            মুখপানে চেয়ে রব বসি পদতলে।
            নগরের পথে যবে হইবে বাহির
           ওই হাত ধরে আমি যাব সাথে সাথে।
সন্ন্যাসী। পিঞ্জরের ছোটো পাখি আহা ক্ষীণ অতি,
           এরে কেন নিয়ে যাই অনন্তের মাঝে!
           ডানা দিয়ে মুখ ঢেকে ভয়ে হল সারা,
           আমার বুকের কাছে লুকাইতে চায়!
           আহা, তবে নেবে আয়। থাক্‌ মুখ ঢেকে।
           বুকের মাঝেতে তবে থাক্‌ লুকাইয়া।
           এ কি স্নেহ? আমি কি রে স্নেহ করি এরে?
           না না। স্নেহ কোথা মোর! কোথা দ্বেষ ঘৃণা!
           কাছে যদি আসে কেহ তাড়াব না তারে,
           দূরে যদি থাকে কেহ ডাকিব না কাছে।

                          প্রকাশ্যে

           বাছা, এ আঁধারে তুই কেমনে রহিবি?
           তোরা সব ছোটো ছোটো আলোকের প্রাণী।
           কুটির রয়েছে তোর নগরের মাঝে,
           সেথা আছে লোকজন, গাছপালা, পাখি—
           হেথায় কে আছে তোর!
বালিকা।                     তুমি আছ পিতা।
           যে স্নেহ দিয়েছ তুমি তাই নিয়ে রব।
                       হাসিয়া । স্বগত
সন্ন্যাসী। বালিকা কি মনে করে স্নেহ করি ওরে?
           হায় হায়, এ কী ভ্রম! জানে না সরলা
           নিষ্কলঙ্ক এ হৃদয় স্নেহরেখাহীন।
           তাই মনে করে যদি সুখে থাকে থাক্‌।
           মোহ নিয়ে ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকে এরা।
                       প্রকাশ্যে
          যাই বৎসে, গুহামাঝে করি গে প্রবেশ,
         এক বার বসি গিয়ে সমাধি-আসনে।
বালিকা। ফিরিবে কখন পিতা?
সন্ন্যাসী।                    কেমনে বলিব!
          ধ্যানে মগ্ন, নাহি থাকে সময়ের জ্ঞান।   [প্রস্থান


                   
ষষ্ঠ দৃশ্য
                
অপরাহ্ন
               গুহাদ্বারে সন্ন্যাসীর প্রবেশ
বালিকা। এলে তুমি এতক্ষণে, বসে আছি হেথা—
            পিতা, আমি তোমা তরে গিয়েছিনু বনে,
            এনেছি আঁচল ভরে ফলফুল তুলে।
            দেখো চেয়ে কী সুন্দর রাঙা দুটি ফুল।

                           হাসিয়া
সন্ন্যাসী। দিতে চাস যদি বাছা, দে তবে যা খুশি।
           মোর কাছে কিছু নাই সুন্দর কুৎসিত।
           এক মুঠা ফুল যদি ভালো লাগে তোর
           এক মুঠা ধুলা সেও কী করিল দোষ?
           ভালো মন্দ কেন লাগে? সবই অর্থহীন।
           আজ বৎসে, সারাদিন কাটালি কী করে?
বালিকা। ওই দেখো—চুপি চুপি এস এই দিকে।
           সারাদিন মোর সাথে খেলা করে করে
           সাঁঝেতে লতাটি মোর ঘুমিয়ে পড়েছে।
           নুইয়ে পড়েছে ভুঁয়ে কচি ডালগুলি,
           পাতাগুলি মুদে গেছে জড়াজড়ি করে।
           এস পিতা, এইখানে বসো এর কাছে —
           ধীরে ধীরে গায়ে দাও হাতটি বুলিয়ে।
                          স্বগত

সন্ন্যাসী। এ কী রে মদিরা আমি করিতেছি পান।
            এ কী মধু অচেতনা পশিছে হৃদয়ে!
            এ কী রে স্বপন-ঘোরে ছাইছে নয়ন!
            আবেশে পরানে আসে গোধূলি ঘনায়ে।
            পড়িছে জ্ঞানের চোখে মেঘ-আবরণ।
            ধীরে ধীরে মোহময় মরণের ছায়া
            কেন রে আমারে যেন আচ্ছন্ন করিছে।

                    সহসা ফুল ফল ছিঁড়িয়া ফেলিয়া,
                           ভূমিতে পদাঘাত করিয়া

           দূর হোক — এ সকল কিছু ভালো নয় —
           বালিকা, বালিকা তোর এ কী ছেলেখেলা।
           আমি যে সন্ন্যাসী যোগী মুক্ত নির্বিকার,
           সংসারের গ্রন্থিহীন, স্বাধীন সবল,
           এ ধুলায় ঢাকিবি কি আমার নয়ন?

                      কিয়ৎক্ষণ থামিয়া

          বাছা রে, অমন করে চাহিয়া কেন রে!
          কেন রে নয়ন ছুটি করে ছল ছল।
          জানিস নে তুই, মোরা সন্ন্যাসী বিরাগী,
          আমাদের এ-সকল ভালো নাহি লাগে।
          ছিছি, জনমিল প্রাণে এ কী এ বিকার!
          সহসা কেন রে এত করিল চঞ্চল!
          কোথা লুকাইয়া ছিল হৃদয়ের মাঝে
          ক্ষুদ্র রোষ, অগ্নিজিহ্ব নরকের কীট!
          কোন্‌ অন্ধকার হতে উঠিল ফুঁসিয়া!
          এতদিন অনাহারে এখনো মরে নি!
          হৃদয়ে লুকানো আছে এ কী বিভীষিকা!
          কোথা যে কে আছে গুপ্ত কিছু তো জানি নে।
          হৃদয়শ্মশান মাঝে মৃতপ্রাণী যত
          প্রাণ পেয়ে নাচিতেছে কঙ্কালের নাচ,
         কেমনে নিশ্চিন্ত হয়ে রহি আমি আর!

                    প্রকাশ্যে

          দাও বৎসে, এনে দাও ফলফুল তব,
         দেখাও কোথায় বাছা লতাটি তোমার —
          না, না, আমি চলিলাম নগরে ভ্রমিতে।
          দু দণ্ড বসিয়া থাকো, আসিব এখনি।    [প্রস্থান


                   
সপ্তম দৃশ্য
                 পর্বতশিখরে সন্ন্যাসী
           পর্বতপথে দুই জন স্ত্রীলোকের প্রবেশ

                       গান
               বনে এমন ফুল ফুটেছে,
           মান করে থাকা আজ কি সাজে!
           মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
               চলো চলো কুঞ্জমাঝে।
           আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু, মুহুর‍্মুহু,
           আজ কাননে ঐ বাঁশি বাজে।
              মান করে থাকা আজ কি সাজে!
           আজ মধুরে মিশাবি মধু, পরান-বঁধু
              চাঁদের আলোয় ঐ বিরাজে।
              মান করে থাকা আজ কি সাজে!

সন্ন্যাসী। সহসা পড়িল চোখে এ কী মায়াঘোর!
            জগতেরে কেন আজ মনোহর হেরি!
            পশ্চিমে কনকসন্ধ্যা সমুদ্রের মাঝে
            সুধীরে নীলের কোলে যেতেছে মিলায়ে।
            নিম্নে বনভূমিমাঝে ঘনায় আঁধার,
            সন্ধ্যার সুবর্ণছায়া উপরে পড়েছে।
            চারি দিকে শান্তিময়ী স্তব্ধতার মাঝে
            সিন্ধু শুধু গাহিতেছে অবিশ্রাম গান।
            বামে দূরে দেখা যায় শৈলপদতলে
            শ্যামল তরুর মাঝে নগরের গৃহ।
            কোলাহল থেমে গেছে, পথ জনহীন
            দীপ জ্বলে উঠিতেছে দু-একটি ক’রে—
            সন্ধ্যার আরতি হয়, শঙ্খঘণ্টা বাজে।
            প্রকৃতি, এমন তোরে দেখি নি কখনো—
            এমন মধুর যদি মায়ামূর্তি তোর,
            দূর হতে বসে বসে দেখি-না চাহিয়া!
            হেথায় বসি-না কেন রাজার মতন,
            জগতের রঙ্গভূমি সম্মুখে আমার!
            আমি আজি প্রভু তোর, তুই দাসী মোর,
            মায়াবিনী দেখা তোর মায়াঅভিনয়,
            দেখা তোর জগতের মহা ইন্দ্রজাল।
            খেলা কর্ সমুখেতে চন্দ্রসূর্য নিয়ে,
            নীলাকাশ রাজছত্র ধর্ মোর শিরে,
            সমস্ত জগৎ দিয়ে কর্ মোরে পূজা।
            উঠুক রে দিবানিশি সপ্তলোক হতে
            বিচিত্র রাগিণীময়ী মায়াময়ী গাথা।

                 আর এক দল পথিকের প্রবেশ

                           গান
                     মরি লো মরি,
              আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে!
              ভেবেছিলেম ঘরে রব কোথাও যাব না—
              ওই যে, বাহিরে বাজিল বাঁশি বলো কী করি?
              শুনেছি কোন্‌ কুঞ্জবনে যমুনাতীরে,
              সাঁঝের বেলা বাজে বাঁশি ধীর সমীরে—
                  ওগো তোরা জানিস যদি
                       আমায় পথ বলে দে।
                          আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে!
                      দেখি গে তার মুখের হাসি,
            তারে   ফুলের মালা পরিয়ে আসি,
            তারে   বলে আসি তোমার বাঁশি
                        আমার     প্রাণে বেজেছে।
                              আমায়    বাঁশিতে ডেকেছে কে!

সন্ন্যাসী। জগৎ সম্মুখে মোর সমুদ্রের মতো,
            আমি তীরে বসে আছি পর্বতশিখরে—
            তরঙ্গেতে গ্রহতারা হতেছে আকুল,
            ভাসিতেছে কোটি প্রাণী জীর্ণ কাষ্ঠ ধরি।
            আমি শুধু শুনিতেছি কলধ্বনি তার,
            আমি শুধু দেখিতেছি তরঙ্গের খেলা।
            কিরণকুন্তলজাল এলায়ে চৌদিকে
            রুদ্র তালে নৃত্য করে এ মহাপ্রকৃতি।
            আলোক আঁধার ছায়া, জীবন মরণ,
            রাত্রি দিন, আশা ভয়, উত্থান পতন,
            এ কেবল তালে তালে পদক্ষেপ তার।
            শত গ্রহ, শত তারা, শত কোটি প্রাণী
            প্রতি পদক্ষেপে তার জন্মিছে মরিছে।
            আমি তো ওদের মাঝে কেহ নই আর,
            তবে কেন এই নৃত্য দেখি- না বসিয়া!

                     একজন পথিক
                          গান
           যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে।
                  বিভূতিভূষিত শুভ্র দেহ,
                     নাচিছ দিক্‌বসনে।
     মহা আনন্দে পুলককায় গঙ্গা উথলি ছলি যায়,
                 ভালে শিশুশশী হাসিয়া চায়,
                    জটাজুট ছায় গগনে।         [প্রস্থান