ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


প্রকৃতির প্রতিশোধ

                     অষ্টম দৃশ্য
                       গুহাদ্বারে
                   সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী। আয় তোরা, কাছে আয় কে আসিবি আয়—
           সকলি সুন্দর হেরি এ বিশ্বজগতে।
বালিকা। আমিও কি কাছে যাব! ডাকো পিতা ডাক!,
           কী দোষ করিয়াছিনু বলো বুঝাইয়া!
সন্ন্যাসী। কিছু ভয় করিস নে, কোনো দোষ নেই —
           তোরে ফেলে আর কভু যাব না বালিকা।

                       গুহার কাছে গিয়া

           এ কী অন্ধকার হেথা ! এ কী বদ্ধ গুহা!
           আয়, বাছা, মোরা দোঁহে বাহিরেতে যাই
           চাঁদের আলোতে গিয়ে বসি একবার।

                       বাহিরে আসিয়া

          আহা এ কী সুমধুর! এ কী শান্তি-সুধা!
          কী আরামে গাছগুলি রয়েছে দাঁড়ায়ে!
          মনে সাধ যায় ঐ তরু হয়ে গিয়ে
          চন্দ্রালোকে দাঁড়াইয়া স্তব্ধ হয়ে থাকি।
          ধীরে ধীরে কত কী যে মনে আসিতেছে।
          অতীতের অতি দূর ফুলবন হতে
          বায়ু যেন বহে আসে নিশ্বাসের মতো,
          সাথে লয়ে পল্লবের মর্মরবিলাপ,
          মিলিত জড়িত শত পুষ্পগন্ধরাশি।
          এমনি জোছনা-রাত্রে কোন্‌খানে ছিনু,
          কারা যেন চারি পাশে বসে ছিল মোর!
          তোরি মতো দু-একটি মধুমাখা মুখ
          চাঁদের আলোতে মিশে পড়িতেছে মনে।
          আর না রে, আর না রে, আর ফিরিব না।
          তোদের অনেক দূরে ফেলিয়া এসেছি।
          অনন্তের পারাবারে ভাসায়েছি তরী,
          মাঝে মাঝে অতি দূরে রেখা দেখা যায়—
          তোদের সে মেঘময় মায়াদ্বীপগুলি।
          সেথা হতে কারা তোরা বাঁশিটি বাজায়ে
          আজিও ডাকিস মোরে! আমি ফিরিব না।
          বন্দী করে রেখেছিলি মায়ামুগ্ধ করে,
          পালায়ে এসেছি আমি, হয়েছি স্বাধীন।
          তীরে বসে গা তোদের মায়াগানগুলি —
          অনন্তের পানে আমি চলেছি ভাসিয়া।
          বাছা, তুই কাছে আয়, দেখি তোরে আমি,
         মুখেতে পড়েছে তোর চাঁদের কিরণ।

                   কাছে আসিয়া
বালিকা। গান পড়িতেছে মনে গাই বসে পিতা!

                        গান
               মেঘেরা চলে চলে যায়,
               চাঁদেরে ডাকে ‘আয় আয়’।
        ঘুমঘোরে বলে চাঁদ, ‘কোথায় — কোথায়!’
              না জানি কোথা চলিয়াছে,
             কী জানি কী সে সেথা আছে,
        আকাশের মাঝে চাঁদ চারি দিকে চায়।
             সুদূরে — অতি — অতি দূরে,
             বুঝি রে কোন্‌ সুরপুরে
        তারাগুলি ঘিরে বসে বাঁশরি বাজায়।
             মেঘেরা তাই হেসে হেসে
             আকাশে চলে ভেসে ভেসে
       নুকিয়ে চাঁদের হাসি চুরি করে যায়।

সন্ন্যাসী। এ কী রে চলেছি কোথা, এসেছি কোথায়?
            বুঝি আর আপনারে পারি নে রাখিতে।
            বুঝি মরি, ডুবি, বুঝি লুপ্ত হয়ে যাই।
            ওরে কোন্‌ অতলেতে যেতেছি তলায়ে,
            সর্বাঙ্গে চাপিছে ভার আঁখি মুদে আসে।
            চৌদিকে কী যেন তোরে আসিছে ঘিরিয়া!
            কোথায় রাখিলি তোর পালাবার পথ!
            ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে রে যেতেছিস চলি,
            সহসা চরণে কোথা লাগিবে আঘাত,
            বিনাশের মাঝখানে উঠিবি জাগিয়া।
            এখনি ছিঁড়িয়া ফেল্‌ স্বপনের মায়া।
            চল্‌ তোর নিজ রাজ্যে অনন্ত আঁধারে।
            যত চন্দ্র সূর্য সেথা ডুবে নিবে যাবে।
            ক্ষুদ্র এ আলোতে এসে হনু দিশেহারা,
            আঁধার দেয় না কভু পথ ভুলাইয়া।

                   
নবম দৃশ্য
                      গুহায় সন্ন্যাসী
সন্ন্যাসী। আহা এ কী শান্তি, এ কী গভীর বিরাম!
            অন্তর বাহির যাবে, যাবে দেশ কাল—
            'আছি' মাত্র রবে শুধু, আর কিছু নয়।

                  দীপ হস্তে বালিকার প্রবেশ

বালিকা। দুই দিন দুই রাত্রি চলে গেছে পিতা,
           গুহার দুয়ারে আমি বসিয়া রয়েছি,
           তাই আজ এক বার এসেছি দেখিতে।
           একটিও জনপ্রাণী আসে নি হেথায়,
           দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত্রি গিয়েছে কাটিয়া,
           কেন হেথা অন্ধকারে একা বসে আছ!
           কতক্ষণ বসে বসে শুনিনু সহসা
           তুমি যেন স্নেহবাক্যে ডাকিছ আমারে।
           নিতান্ত একেলা তুমি রয়েছ যে পিতা—
           তাই আর পারিনু না, আসিলাম কাছে।
           ও কী প্রভু, কথা কেন কহিছ না তুমি!
           ও কী ভাবে চেয়ে আছ মোর মুখপানে!
           ভালো লাগিছে না পিতা? যাব তবে চলে?
সন্ন্যাসী। না না, এলি যদি, তবে যাস নে চলিয়া।
           আমি তো ডাকি নি তোরে, নিজে এসেছিস!
           একটুকু দাঁড়া, তোরে দেখি ভালো করে।
           সংসারের পরপারে ছিলেম যে আমি,
           সহসা জগৎ হতে কে তোরে পাঠালে?
           সেথা হতে সাথে করে কেন নিয়ে এলি
           দিবালোক, পুষ্পগন্ধ, স্নিগ্ধ সমীরণ!
           কিবা তোর সুধাকণ্ঠ, স্নেহমাখা স্বর!
           মরি কী অমিয়াময়ী লাবণ্যপ্রতিমা!
           সরলতাময় তোর মুখখানি দেখে
           জগতের 'পরে মোর হতেছে বিশ্বাস।
           তুই কি রে মিথ্যা মায়া, দু দণ্ডের ভ্রম!
           জগতের কাছে তুই ফুটেছিস ফুল
           জগৎ কি তোরি মতো এত সত্য হবে!
           চল্‌ বাছা গুহা হতে বাহিরেতে যাই।
           সমুদ্রের এক পারে রয়েছে জগৎ,
           সমুদ্রের পরপারে আমি বসে আছি,
           মাঝেতে রহিলি তুই সোনার তরণী —
           জগৎ-অতীত এই পারাবার হতে
           মাঝে মাঝে নিয়ে যাবি জগতের কূলে।    [প্রস্থান

                   
দশম দৃশ্য
                     গুহার বাহিরে
সন্ন্যাসী। আহা এ কী চারিদিকে প্রভাতবিকাশ!
           এ জগৎ মিথ্যা নয়, বুঝি সত্য হবে,
           মিথ্যা হয়ে প্রকাশিছে আমাদের চোখে।
           অসীম হতেছে ব্যক্ত সীমারূপ ধরি।
           যাহা-কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, অনন্ত সকলি!
           বালুকার কণা সেও অসীম অপার,
           তারি মধ্যে বাঁধা আছে অনন্ত আকাশ —
           কে আছে কে পারে তারে আয়ত্ত করিতে?
           বড়ো ছোটো কিছু নাই, সকলি মহৎ।
           আঁখি মুদে জগতেরে বাহিরে ফেলিয়া
           অসীমের অন্বেষণে কোথা গিয়েছিনু!
           সীমা তো কোথাও নাই — সীমা সে তো ভ্রম।
           ভালো করে পড়িব এ জগতের লেখা,
           শুধু এ অক্ষর দেখে করিব না ঘৃণা।
           লোক হতে লোকান্তরে ভ্রমিতে ভ্রমিতে,
           একে একে জগতের পৃষ্ঠা উলটিয়া,
           ক্রমে যুগে যুগে হবে জ্ঞানের বিস্তার।
           বিশ্বের যথার্থ রূপ কে পায় দেখিতে!
           আঁখি মেলি চারি দিকে করিবে ভ্রমণ,
           ভালোবেসে চাহিব এ জগতের পানে,
           তবে তো দেখিতে পাব স্বরূপ ইহার।

                 দুই জন পথিকের প্রবেশ
প্রথম। আর কতদূরে যাবি, ফিরে যা রে ভাই।
          আয় ভাই, এইখানে কোলাকুলি করি।
দ্বিতীয়। কে জানে আবার কবে দেখা হবে ফিরে।
প্রথম। আবার আসিব ফিরে যত শীঘ্র পারি।
দ্বিতীয়। যাবে যদি, এক বার দাঁড়াও হেথায়।
           এক বার ফিরে চাও নগরের পানে।
           ওই দেখো দূরে ওই গৃহটি তোমার—
           চারি দিকে রহিয়াছে লতিকার বেড়া,
           ওই সে অশোক গাছ বামে উঠিয়াছে,
           ওই তরুতলে বসে আমরা দুজনে
           কত রাত্রি জোছনাতে কথা কহিয়াছি।
প্রথম।  দুদিনের এ বিরহ ত্বরায় ফুরাবে,
          আনন্দের মাঝে পুন হইবে মিলন।
দ্বিতীয়। মনে যেন রেখো, সখা সুদূর প্রবাসে—
          পুরাতন এ বন্ধুরে ভুলিয়ো না যেন।
          দেবতা রাখুন সুখে আর কী কহিব।    [প্রস্থান
সন্ন্যাসী। আহা, যেতে যেতে দোঁহে চায় ফিরে ফিরে,
            অশ্রুজলে ভালো করে দেখিতে না পায়।
            বিপুল জগৎ-মাঝে দিগন্তের পানে
            সখা ওর কোথা গেল, কে জানে কোথায়!
            এ কী সংশয়ের দেশে রয়েছি আমরা,
           চোখের আড়ালে হেথা সবি অনিশ্চয়।
           বারেক যে কাছ হতে দূরে চলে গেল
           হয়তো সে কাছে ফিরে আর আসিবে না।
           তাই সদা চোখে চোখে রেখে দিতে চাই,
           তাই সদা টেনে নিই বুকের মাঝেতে।
           কোথা কে অদৃশ্য হয় চারি দিক হতে,
           যাহা-কিছু বাকি থাকে ভয়ে তাহাদের
           আরো যেন দৃঢ় করে ধরি জড়াইয়া।
           সবাই চলিয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন দিশে,
           অসীম জগতে মোরা কে কোথায় থাকি,
           মাঝে লোক-লোকান্তের ব্যবধান পড়ে।
           তবু কি গলায় দিবি মোহের বন্ধন!
           সুখ দুঃখ নিয়ে তবু করিবি কি খেলা!
           যে রবে না তবু তারে রাখিবারে চাস!
           ওরে, আমি প্রতিদিন দেখিতেছি, যেন
           কে আমারে অবিরত আনিতেছে টেনে।
           প্রতিদিন যেন আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া
           জগৎ-চক্রের মাঝে যেতেছি পড়িতে —
           চারিদিকে জড়াইছে অশ্রুর বাঁধন,
           প্রতিদিন কমিতেছে চরণের বল।
           যাক্‌ ছিঁড়ে! গেল ছিঁড়ে! চল্‌ ছুটে চল্‌!
           চল্‌ দূরে — যত দূরে চলে রে চরণ।
           কে ও আসে অশ্রুনেত্রে শূন্যগুহা-মাঝে,
           কে ও রে পশ্চাতে ডাকে 'পিতা পিতা' ব'লে!
           ছিঁড়ে ফেল্‌ ,ভেঙে ফেল্‌ চরণের বাধা —
           হেথা হতে চল্‌ ছুটে, আর দেরি নয়।