ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


প্রকৃতির প্রতিশোধ

                    একাদশ দৃশ্য
                        পথে সন্ন্যাসী
সন্ন্যাসী। এসেছি অনেক দূরে — আর ভয় নাই।
            পায়েতে জড়াল লতা, ছিন্ন হয়ে গেল।
            সেই মুখ বার বার জাগিতেছে মনে।
            সে যেন করুণ মুখে মনের দুয়ারে
            বসে বসে কাঁদিতেছে ডাকিতেছে সদা!
            যতই রাখিতে চাই দুয়ার রুধিয়া —
            কিছুতেই যাবে না সে, ফিরে ফিরে আসে,
           একটু মনের মাঝে স্থান পেতে চায়।
     
           নির্ভয়ে গা ঢেলে দিয়ে সংসারের স্রোতে
           এরা সবে কী আরামে চলেছে ভাসিয়া।
           যে যাহার কাজ করে, গৃহে ফিরে যায়,
          ছোটো ছোটো সুখে দুঃখে দিন যায় কেটে।
          আমি কেন দিবানিশি প্রাণপণ করে
          যুঝিতেছি সংসারের স্রোত-প্রতিকূলে।
          পেরেছি কি এক তিল অগ্রসর হতে!
          বিপরীতে মুখ শুধু ফিরাইয়া আছি,
          উজানে যেতেছি বলে হইতেছে ভ্রম,
         পশ্চাতে স্রোতের টানে চলেছি ভাসিয়া—
         সবাই চলেছে যেথা ছুটেছি সেথাই!

                  দরিদ্র বালিকার প্রবেশ
বালিকা। ওগো, দয়া করো মোরে আমি অনাথিনী।

                   সহসা চমকিয়া উঠিয়া
সন্ন্যাসী। কে রে তুই? কে রে বাছা? কোথা হতে এলি?
            অনাথিনী? তুইও কি তারি মতো তবে?
            তোরেও কি ফেলে কেউ গিয়েছে পলায়ে?
            তারেই কি চারি দিকে খুঁজিয়া বেড়াস?
            বৎসে, কাছে আয় তুই — দে রে পরিচয়।
বালিকা। ভিখারি বালিকা আমি, সন্ন্যাসী ঠাকুর,
            অন্ধ বৃদ্ধ মাতা মোর রোগশয্যাশায়ী।
            আসিয়াছি একমুঠা ভিক্ষান্নের তরে।
সন্ন্যাসী । আহা বৎসে, নিয়ে চল্‌ কুটিরেতে তোর।
             রুগ্‌ণ তোর জননীরে দেখে আসি আমি।    [প্রস্থান

       কতকগুলি সন্তান লইয়া এক জন স্ত্রীলোকের প্রবেশ

স্ত্রী। দেখ্ দেখি, মিশ্রদের বাড়ির ছেলেগুলি কেমন রিষ্টপুষ্ট! দেখলে দু-দণ্ড চেয়ে থাকতে ইচ্ছা করে — আর এঁদের ছিরি দেখো-না, যেন বৃষকাষ্ঠ দাঁড়িয়ে আছেন, যেন সাতকুলে কেউ নেই, যেন সাত জন্মে খেতে পান না।
সন্তানগণ। তা আমরা কী করব মা! আমাদের দোষ কী?
মা। বললেম—বলি, রোজ সকালে ভালো করে হলুদ মেখে তেল মেখে স্নান কর্, ধাত পোষ্টাই হবে, ছিরি ফিরবে— তা তো কেউ শুনবে না! আহা ওদের দিকে চাইলে চোখ জুড়িয়ে যায়, রং যেন দুধে-আলতায় —
সন্তানগণ। আমাদের রং কালো তা আমরা কী করব?
মা। তোদের রং কালো কে বললে? তোদের রং মন্দ কী? তবে কেন ওদের মতো দেখায় না?  [প্রস্থান

              সন্ন্যাসীর প্রবেশ। একটি কন্যা লইয়া স্ত্রীলোকের প্রবেশ
সন্ন্যাসী।  কোথায় চলেছ বাছা।
স্ত্রী।               প্রণাম ঠাকুর!
            ঘরেতে যেতেছি মোরা।
সন্ন্যাসী।           সেথায় কে আছে?
স্ত্রী।         শাশুড়ি আছেন মোর, আছেন সোয়ামী,
             শত্রুমুখে ছাই দিয়ে দুটি ছেলে আছে।
সন্ন্যাসী।  কী কাজে কাটাও দিন বলো মোরে বাছা!
স্ত্রী।        ঘরকন্না-কাজ আছে, ছেলেপিলে আছে,
            গোয়ালে তিনটি গোরু তার করি সেবা,
            বিকেলে চরকা কাটি মেয়েটিরে নিয়ে।
সন্ন্যাসী।  সুখেতে কি কাটে দিন? দুঃখ কিছু নেই?
স্ত্রী।        দয়ার শরীর রাজা প্রজার মা-বাপ,
            কোনো দুঃখ নেই প্রভু !রামরাজ্যে থাকি।
সন্ন্যাসী। এটি কি তোমারি মেয়ে বাছা!
স্ত্রী।                       হাঁ ঠাকুর।

                     কন্যার প্রতি
             যা না রে, প্রভুরে গিয়ে কর্ দণ্ডবৎ।
সন্ন্যাসী।  আয় বৎসে, কাছে আয় কোলে করি তোরে।
             আসিবি নে! তুই মোরে চিনেছিস বুঝি —
             নিষ্ঠুর কঠিন আমি পাষাণ হৃদয়,
             আমারে বিশ্বাস করে আসিস নে কাছে!

                                   মাকে টানিয়া
কন্যা।    মা গো, ঘরে চলো।
স্ত্রী।                  তবে প্রণাম ঠাকুর।          
সন্ন্যাসী। যাও বাছা, সুখে থাকো আশীর্বাদ করি।
              [সন্ন্যাসী ব্যতীত সকলের প্রস্থান

            বসে বসে কী দেখি এ, এই কি রে সুখ!
            লঘু সুখ লঘু আশা বাহিয়া বাহিয়া
            সংসারসাগরে এরা ভাসিয়া বেড়ায়,
            তরঙ্গের নৃত্য-সনে নৃত্য করিতেছে।
            দু দিনেতে জীর্ণ হবে এ ক্ষুদ্র তরণী,
            আশ্রয়ের সাথে কোথা মজিবে পাথারে।
            আমি তো পেয়েছি কূল অটল পর্বতে,
            নিত্য যাহা তারি মাঝে করিতেছি বাস।
            আবার কেন রে হোথা সন্তরণ-সাধ!
            ওই অশ্রুসাগরের তরঙ্গহিল্লোলে
            আবার কি দিবানিশি উঠিবি পড়িবি!

                         চক্ষু মুদিয়া
            হৃদয় রে শান্ত হও, যাক সব দূরে—
            যাক দূরে, যাক চলে মায়া-মরীচিকা।
            এস এস অন্ধকার, প্রলয়সমুদ্রে
            তপ্ত দীপ্ত দগ্ধ প্রাণ দাও ডুবাইয়া।
            অকুল স্তব্ধতা এসো চারি দিকে ঘিরে,
            কোলাহলে কর্ণ মোর হয়েছে বধির।
            গেল, সব ডুবে গেল, হইল বিলীন,
            হৃদয়ের অগ্নিজ্বালা সব নিবে গেল।

                    বালিকার প্রবেশ
বালিকা। পিতা, পিতা, কোথা তুমি পিতা!

                      চমকিয়া
সন্ন্যাসী।                     কে রে তুই!
             চিনি নে, চিনি নে তোরে, কোথা হতে এলি!
বালিকা।  আমি, পিতা, চাও পিতা, দেখো পিতা, আমি!
সন্ন্যাসী।  চিনি নে, চিনি নে তোরে, ফিরে যা, ফিরে যা।
            আমি কারো কেহ নই, আমি যে স্বাধীন।

                      পায়ে পড়িয়া
বালিকা।  আমাকে যেয়ো না ফেলে, আমি নিরাশ্রয়।
             শুধায়ে শুধায়ে সবে তোমারে খুঁজিয়া
             বহু দূর হতে পিতা, এসেছি যে আমি।
                   সহসা ফিরিয়া আসিয়া, বুকে টানিয়া
সন্ন্যাসী।  আয় বাছা, বুকে আয়, ঢাল্‌ অশ্রুধারা!
            ভেঙে যাক এ পাষাণ তোর অশ্রুস্রোতে!
            আর তোরে ফেলে আমি যাব না বালিকা,
            তোরে নিয়ে যাব আমি নূতন জগতে।
            পদাঘাতে ভেঙেছিনু জগৎ আমার —
            ছোটো এ বালিকা এর ছোটো দুটি হাতে
            আবার ভাঙা জগৎ গড়িয়া তুলিল।
            আহা তোর মুখখানি শুকায়ে গিয়েছে,
            চরণ দাঁড়াতে যেন পারিছে না আর।
            অনিদ্রায়, অনাহারে, মধ্যাহ্ন-তপনে
            তিন দিবসের পথ কেমনে এলি রে!
            আয় রে বালিকা তোরে বুকে করে নিয়ে
            যেথা ছিনু ফিরে যাই সেই গুহামাঝে।    [প্রস্থান

                     
দ্বাদশ দৃশ্য
                       গুহার দ্বারে
সন্ন্যাসী।  এইখানে সব বুঝি শেষ হয়ে গেল!
            যে ধ্যানে অনন্তকাল মগ্ন হব বলে
            আসন পাতিয়াছিনু বিশ্বের বাহিরে,
            আরম্ভ না হতে হতে ভেঙে গেল বুঝি!
            তারি মুখ জাগে মনে সমাধিতে বসে,
            তারি মুখ হৃদয়ের প্রলয়-আঁধারে
            সহসা তারার মতো কোথা ফুটে ওঠে,
            সেই দিকে আঁখি যেন বদ্ধ হয়ে থাকে,
            ক্রমে ক্রমে অন্ধকার মিলাইয়া যায়,
            জগতের দৃশ্য ধীরে ফুটে ফুটে ওঠে—
            গাছপালা, সূর্যালোক, গৃহ, লোকজন
            কোথা হতে জেগে ওঠে গুহার মাঝারে।
            সদা মনে হয় বালা কোথায় না জানি,
            হয়তো সে গেছে চলে নগরে ভ্রমিতে,
            হয়তো কে অনাদর করেছে তাহারে,
            এসেছে সে কাঁদো-কাঁদো মুখখানি করে
            আমার বুকের কাছে লুকাইতে মাথা।

            এইখানে সব বুঝি শেষ হয়ে গেল!
            মিছে ধ্যান মিছে জ্ঞান মিছে আশা মোর!
            আকাশবিহারী পাখি উড়িত আকাশে —
            মাটি হতে ব্যাধ তারে মারিয়াছে বাণ,
            ক্রমেই মাটির পানে যেতেছে পড়িয়া —
            ক্রমেই দুর্বল দেহ শ্রান্ত ভগ্ন পাখা,
            ক্রমেই আসিছে নুয়ে অভ্রভেদী মাথা।
            ধুলায়, মৃত্যুর মাঝে লুটাইতে হবে।
            লৌহপিঞ্জরের মাঝে বসিয়া বসিয়া
            আকাশের পানে চেয়ে ফেলিব নিশ্বাস।
            তবে কি রে আর কিছু নাইকো উপায়!
বালিকা। দেখো পিতা, লতাটিতে কুঁড়ি ধরিয়াছে,
            প্রভাতের আলো পেলে উঠিবে ফুটিয়া।

            সন্ন্যাসী সবেগে গিয়া লতা ছিঁড়িয়া ফেলিল

বালিকা। ও কী হল! ও কী হল! কী করিলে পিতা!
সন্ন্যাসী। রাক্ষসী পিশাচী, ওরে, তুই মায়াবিনী —
            দূর হ, এখনি তুই যা রে দূর হয়ে।
           এত বিষ ছিল তোর ওইটুকু-মাঝে।
           অনন্ত জীবন মোর ধ্বংস করে দিলি!
           ওরে, তোরে চিনিয়াছি, আজ চিনিয়াছি —
           প্রকৃতির গুপ্তচর তুই রে রাক্ষসী,
           গলায় বাঁধিয়া দিলি লোহার শৃঙ্খল।
           তুই রে আলোয়-আলো, তুই মরীচিকা—
           কোন্‌ পিপাসার মাঝে, দুর্ভিক্ষের মাঝে,
           কোন্‌ মরুভূমি-মাঝে, শ্মশানের পথে,
           কোন্‌ মরণের মুখে যেতেছিস নিয়ে!
           ওই-যে দেখি রে তোর নিদারুণ হাসি,
           প্রকৃতির হৃদিহীন উপহাস তুই —
           শৃঙ্খলেতে বেঁধে ফেলে পরাজিত মোরে
           হা হা করে হাসিতেছে প্রকৃতি রাক্ষসী!
           এখনো কি আশা তোর পুরে নি পাষাণী?
           এখনো করিবি মোরে আরো অপমান!
           আরো ধুলা দিবি ফেলে এ মাথায় মোর!
           আরো গহ্বরেতে মোরে টেনে নিয়ে যাবি!
           না রে না, তা হবে না রে, এখনো যুঝিব —
           এখনো হইব জয়ী ছিঁড়িব শৃঙ্খল।

        সন্ন্যাসীর সবেগে গুহা হইতে বহির্গমন
            ও মূর্ছিত হইয়া বালিকার পতন

                
ত্রয়োদশ দৃশ্য
                
অরণ্য
                   ঝড়বৃষ্টি । রাত্রি
সন্ন্যাসী। কে ও রে করুণকণ্ঠে করে আর্তনাদ!
           এখনো কানেতে কেন পশিছে আসিয়া!
           প্রলয়ের শব্দে আজি কাঁপিছে ধরণী—
           বজ্রদন্ত কড়মড়ি ছুটিতেছে ঝড়,
           ক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো আঁধার অরণ্য
           তরুর তরঙ্গ লয়ে উঠিছে পড়িছে!
           তবুও ঝটিকা, তোর বজ্রগীত গেয়ে
           ক্ষুদ্র এক বালিকার ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি
           পারিলি নে ডুবাইতে! এখনো শুনি যে!
           ওই -যে সে কাঁদিতেছে করুণ স্বরেতে,
           নিশীথের বুক ফেটে উঠিছে সে ধ্বনি।
           কোথা যাব, কোথা যাব, কোন্‌ অন্ধকারে —
           জগতের কোন্‌ প্রান্তে, নিশীথের বুকে —
           ধরণীর কোন্‌ ঘোর, ঘোর গর্ভতলে—
           এ ধ্বনি কোথায় গেলে পশিবে না কানে!
           যাই ছুটে আরো, আরো অরণ্যের মাঝে —
           মহাকায় তরুদের জটিলতা-মাঝে
           দিগ্বিদিক হারাইয়া মগ্ন হয়ে যাই।

                   
চতুর্দশ দৃশ্য
                        প্রভাত
             অরণ্য হইতে ছুটিয়া বাহিরে আসিয়া
সন্ন্যাসী। যাক, রসাতলে যাক সন্ন্যাসীর ব্রত!
                    ছুঁড়িয়া ফেলিয়া
           দূর করো, ভেঙে ফেলো দণ্ড কমণ্ডুলু!
           আজ হতে আমি আর নহি রে সন্ন্যাসী!
           পাষাণসংকল্পভার দিয়ে বিসর্জন
           আনন্দে নিশ্বাস ফেলে বাঁচি এক বার।
           হে বিশ্ব, হে মহাতরী, চলেছ কোথায়,
           আমারে তুলিয়া লও তোমার আশ্রয়ে —
           একা আমি সাঁতারিয়া পারিব না যেতে।
           কোটি কোটি যাত্রী ওই যেতেছে চলিয়া,
           আমিও চলিতে চাই উহাদেরি সাথে।
           যে পথে তপন শশী আলো ধরে আছে,
           সে পথ করিয়া তুচ্ছ, সে আলো ত্যজিয়া,
           আপনারি ক্ষুদ্র এই খদ্যোত-আলোকে
           কেন অন্ধকারে মরি পথ খুঁজে খুঁজে!
           জগৎ, তোমারে ছেড়ে পারি নে যে যেতে,
           মহা আকর্ষণে সবে বাঁধা আছি মোরা।
           পাখি যবে উড়ে যায় আকাশের পানে
           মনে করে, ‘এনু বুঝি পৃথিবী ত্যজিয়া,’
           যত ওড়ে — যত ওড়ে— যত ঊর্ধ্বে যায় —
           কিছুতে পৃথিবী তবু পারে না ছাড়িতে,
           অবশেষে শ্রান্তদেহে নীড়ে ফিরে আসে।

                       চারিদিকে চাহিয়া

           আজি এ জগৎ হেরি কী আনন্দময়!
           সবাই আমারে যেন দেখিতে আসিছে।
           নদী তরুলতা পাখি হাসিছে প্রভাতে।
           উঠিয়াছে লোকজন প্রভাত হেরিয়া,
           হাসিমুখে চলিয়াছে আপনার কাজে।
           ওই ধান কাটে, ওই করিছে কর্ষণ,
           ওই গাভী নিয়ে মাঠে চলেছে গাহিয়া।
           ওই যে পূজার তরে তুলিতেছে ফুল,
           ওই নৌকা লয়ে যাত্রী করিতেছে পার।
           কেহ বা করিছে স্নান, কেহ তুলে জল,
           ছেলেরা ধুলায় বসে খেলা করিতেছে,
           সখারা দাঁড়ায়ে পথে কহে কত কথা।

          আহা সে অনাথা বালা কোথায় না জানি!
         কে তারে আশ্রয় দেবে, কে তারে দেখিবে!
         ব্যথিত হৃদয় নিয়ে কার কাছে যাবে,
         কে তারে পিতার মতো বুকে নিয়ে তুলে
         নয়নের অশ্রুজল দিবে মুছাইয়া!
         কী করেছি, কী বলেছি, সব গেছি ভুলে,
         বিস্মৃত দুঃস্বপ্ন শুধু চেপে আছে প্রাণে—
         একখানি মুখ শুধু মনে পড়িতেছে,
         দুটি আঁখি চেয়ে আছে করুণ বিস্ময়ে।
         আহা, কাছে যাই তার— বুকে নিয়ে তারে
         শুধাই গে কী হয়েছে কী করেছি আমি!
        একটি কুটিরে মোরা রহিব দুজনে,
        রামায়ণ হতে তারে শুনাব কাহিনী—
        সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বেলে, শাস্ত্রকথা শুনে,
        বালিকা কোলেতে মোর পড়িবে ঘুমায়ে।  [প্রস্থান

                   
পঞ্চদশ দৃশ্য
                         পথে
                      লোকারণ্য
প্রথম পুরুষ । ওরে আজ আমাদের রাজপুত্রের বিয়ে।
দ্বিতীয় পুরুষ। তা তো জানি।
তৃতীয় পুরুষ। ছুটে চল্‌, ছুটে চল্‌, ছুটে চল্‌।
চতুর্থ পুরুষ। রাজার বাড়ি নবৎ বসেছে, কিন্তু ভাই আমাদের ডুগ‍্‍ডুগি না বাজলে আমোদ হয় না। তাই কাল সারা রাত্রি মোধোকে আর হরেকে ডেকে তিন জনে মিলে কেবল ডুগডুগি বাজিয়েছি।
স্ত্রীলোক। হাঁ গা, রাজপুত্তুরের বিয়ে হবে, তা মুড়িমুড়কি বিলোনো হবে না?
প্রথম পুরুষ। দূর মাগি, রাজপুত্তুরের বিয়েতে কি মুড়িমুড়কি বিলোনো হয়? গুড়, ছোলা, চিনির পানা —
দ্বিতীয় পুরুষ। না রে না, খুড়ো আমার শহরে থাকে, তার কাছে শুনেছি, দই দিতে ছাতু দিয়ে ফলার হবে।
অনেকে। ওরে তবে আজ আনন্দ করে নে রে, আনন্দ করে নে।
প্রথম পুরুষ। ওরে ও সর্দারের পো, আজ আবার কাজ করতে বসেছিস কেন, ঘর থেকে বেরিয়ে আয়।
দ্বিতীয় পুরুষ। আজ যে শালা কাজ করবে তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব।
তৃতীয় পুরুষ। না রে ভাই, বসে বসে মালা গাঁথছি, দরজায় ঝুলিয়ে দিতে হবে।
স্ত্রীলোক। (রুদ্যমান সন্তানের প্রতি) চুপ কর্ ,কাঁদিস নে, কাঁদিস নে, আজ রাজপুত্তুরের বিয়ে — আজ রাজবাড়িতে যাবি, মুঠো মুঠো চিনি খেতে পাবি।
[কোলাহল করিতে করিতে প্রস্থান

                        সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী। জগতের মুখে আজি এ কী হাস্য হেরি!
            আনন্দতরঙ্গ নাচে চন্দ্রসূর্য ঘেরি।
            আনন্দহিল্লোল কাঁপে লতায় পাতায়,
            আনন্দ উচ্ছ্বসি উঠে পাখির গলায়,
            আনন্দ ফুটিয়া পড়ে কুসুমে কুসুমে।

                   কতকগুলি পথিকের প্রবেশ
প্রথম পথিক। ঠাকুর, প্রণাম হই।
দ্বিতীয় পথিক। প্রভু গো, প্রণাম।
তৃতীয় পথিক। এই ছেলেটিরে মোর আশীর্বাদ করো।
চতুর্থ পথিক। পদধূলি দাও প্রভু, নিয়ে যাই শিরে।
পঞ্চম পথিক। এনেছি চরণে দিতে গুটি-দুই ফুল।
সন্ন্যাসী। কেন এরা সবে মোরে করিছে প্রণাম,
            আমি তো সন্ন্যাসী নই। ওঠো ভাই ওঠো —
            এস ভাই, আজ মোরা করি কোলাকুলি।
            আমিও যে একজন তোমাদেরি মতো,
            তোমাদেরি গৃহমাঝে নিয়ে যাও মোরে।
            জান কি কোথায় আছে মেয়েটি আমার?
            শুধাইতে কেন মোর করিতেছে ভয়!
            তার মলান মুখ দেখে কেহ কি তোমরা
            ডেকে নিয়ে যাও নাই গৃহে তোমাদের!
            সে বালিকা কোথাও কি পায় নি আশ্রয়?

                      
ষোড়শ দৃশ্য
                         গুহামুখ
                    ধুলায় পতিত বালিকা
                    সন্ন্যাসীর দ্রুত প্রবেশ
সন্ন্যাসী।  নয়ন-আনন্দ মোর, হৃদয়ের ধন,
            স্নেহের প্রতিমা ওগো, মা, আমি এসেছি —
            ধুলায় পড়িয়া কেন — ওঠ্‌ মা, ওঠ্‌ মা—
            পাষাণেতে মুখখানি রেখেছিস কেন?
            আয় রে বুকের মাঝে — এও তো পাষাণ!
            ও মা, এত অভিমান করেছিস কেন!
            মুখখানি তুলে দেখ্‌, দুটো কথা ক!
            এ কী, এ যে হিম দেহ! না পড়ে নিশ্বাস —
            হৃদয় কেন রে স্তব্ধ, বিবর্ণ মুখানি!

            বাছা, বাছা, কোথা গেলি! কী করিলি রে —
            হায় হায়, এ কী নিদারুণ প্রতিশোধ !