ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি


রাজা ও রানী

তৃতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় দৃশ্য

ত্রিচূড়
ক্রীড়াকানন
কুমারসেন, ইলা ও সখীগণ

ইলা।         যেতে হবে? কেন যেতে হবে যুবরাজ।
                ইলারে লাগে না ভালো দু-দণ্ডের বেশি,
                ছি ছি চঞ্চল হৃদয়!
কুমারসেন।                            প্রজাগণ সবে

ইলা।         তারা কি আমার চেয়ে হয় ম্রিয়মাণ
                তব অদর্শনে। রাজ্যে তুমি চলে গেলে
                মনে হয়, আর আমি নেই। যতক্ষণ
                তুমি মোরে মনে কর ততক্ষণ আছি,
                একাকিনী কেহ নই আমি। রাজ্যে তব
                কত লোক, কত চিন্তা, কত কার্যভার,
                কত রাজ-আড়ম্বর; আর সব আছে,
                শুধু সেথা ক্ষুদ্র ইলা নাই।
কুমারসেন।                                  সব আছে
                তবু কিছু নাই, তুমি না থেকেও আছ
                প্রাণতমে!
ইলা।                      মিছে কথা ব'লো না কুমার!
                তুমি রাজা আপন রাজত্বে, এ অরণ্যে
                আমি রানী, তুমি প্রজা মোর। কোথা যাবে
                যেতে আমি দিব না তোমারে। সখী, তোরা
                আয়। এরে বাঁধ্‌ ফুলপাশে, কর্‌ গান,
                কেড়ে নে সকলে মিলি রাজ্যের ভাবনা।

                                সখীদের গান
                        যদি আসে তবে কেন যেতে চায়।
                        দেখা দিয়ে তবে কেন গো লুকায়।
                চেয়ে থাকে ফুল হৃদয় আকুল বায়ু বলে এসে ভেসে যাই।
                ধরে রাখো, ধরে রাখো, সুখপাখি ফাঁকি দিয়ে উড়ে যায়।
                পথিকের বেশে সুখনিশি এসে বলে হেসে হেসে, মিশে যাই।
                জেগে থাকো, জেগে থাকো, বয়সের সাধ নিমেষে মিলায়।

কুমারসেন।  আমারে কী করেছিস, অয়ি কুহকিনী।
                নির্বাপিত আমি। সমস্ত জীবন মন
                নয়ন বচন ধাইছে তোমার পানে
                কেবল বাসনাময় হয়ে। যেন আমি
                আমারে ভাঙিয়ে দিয়ে ব্যাপ্ত হয়ে যাব
                তোমার মাঝারে প্রিয়ে। যেন মিশে রব
                সুখস্বপ্ন হয়ে ওই নয়নপল্লবে।
                হাসি হয়ে ভাসিব অধরে। বাহু দুটি
                ললিত লাবণ্যসম রহিব বেড়িয়া,
                মিলন-সুখের মতো কোমল হৃদয়ে
                রহিব মিলায়ে।
ইলা।                             তার পরে অবশেষে
                সহসা টুটিবে স্বপ্নজাল, আপনারে
                পড়িবে স্মরণে। গীতহীনা বীণাসম
                আমি পড়ে রব ভূমে, তুমি চলে যাবে
                গুনগুন গাহি অন্যমনে। না না সখা,
                স্বপ্ন নয়, মোহ নয়, এ মিলন-পাশ
                কখন বাঁধিয়া যাবে বাহুতে বাহুতে,
                চোখে চোখে, মর্মে মর্মে, জীবনে জীবনে।
কুমারসেন।  সে তো আর দেখি নাই
আজি সপ্তমীর
                অর্ধ চাঁদ ক্রমে ক্রমে পূর্ণ শশী হয়ে
                দেখিবেক আমাদের পূর্ণ সে মিলন।
                ক্ষীণ বিচ্ছেদের বাধা মাঝখানে রেখে
                কম্পিত আগ্রহবেগে মিলনের সুখ

                আজি তার শেষ। দূরে থেকে কাছাকাছি,
                কাছে থেকে তবু দূর, আজি তার শেষ।
                সহসা সাক্ষাৎ, সহসা বিস্ময়রাশি,
                সহসা মিলন, সহসা বিরহব্যথা

                বনপথ দিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়া
                শূন্য গৃহপানে সুখস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে,
                প্রতি কথা, প্রতি হাসিটুকু শতবার
                উলটি পালটি মনে, আজি তার শেষ।
                মৌন লজ্জা প্রতিবার প্রথম মিলনে,
                অশ্রুজল প্রতিবারে বিদায়ের বেলা

                আজি তার শেষ।
ইলা।                                 আহা তাই যেন হয়।
                সুখের ছায়ার চেয়ে সুখ ভালো, দুঃখ
                সেও ভালো। তৃষ্ঞা ভালো মরীচিকা চেয়ে।
                কখন তোমারে পাব, কখন পাব না,
                তাই সদা মনে হয়
কখন হারাব।
                একা বসে বসে ভাবি, কোথা আছ তুমি,
                কী করিছ। কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে আসে
                অরণ্যের প্রান্ত হতে। বনের বাহিরে
                তোমারে জানি নে আর, পাই নে সন্ধান।
                সমস্ত ভুবনে তব রহিব সর্বদা,
                কিছুই রবে না আর অচেনা, অজানা,
                অন্ধকার। ধরা দিতে চাহ না কি নাথ?
কুমারসেন।  ধরা তো দিয়েছি আমি আপন ইচ্ছায়,
                তবু কেন বন্ধনের পাশ। বলো দেখি।
                কী তুমি পাও নি, কোথা রয়েছে অভাব।
ইলা।         যখন তোমার কাছে সুমিত্রার কথা
                শুনি বসে, মনে মনে ব্যথা যেন বাজে।
                মনে হয় সে যেন আমায় ফাঁকি দিয়ে
                চুরি করে রাখিয়াছে শৈশব তোমার
                গোপনে আপন কাছে। কভু মনে হয়
                যদি সে ফিরিয়া আসে, বাল্য-সহচরী
                ডেকে নিয়ে যায় সেই সুখশৈশবের
                খেলাঘরে, সেথা তারি তুমি। সেথা মোর
                নাই অধিকার। মাঝে মাঝে সাধ যায়,
                তোমার সে সুমিত্রারে দেখি একবার।
কুমারসেন।  সে যদি আসিত, আহা, কত সুখ হত।
                উৎসবের আনন্দ-কিরণখানি হয়ে
                দীপ্তি পেত পিতৃগৃহে শৈশব-ভবনে।
                অলংকারে সাজাত তোমারে, বাহুপাশে
                বাঁধিত সাদরে, চুরি করে হাসিমুখে
                দেখিত মিলন। আর কি সে মনে করে
                আমাদের। পরগৃহে পর হয়ে আছে।
   
                            ইলার গান   
                এরা, পরকে আপন করে, আপনারে পর,
                বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।
                        ভালোবাসে সুখে দুখে,
                        ব্যথা সহে হাসিমুখে,
                মরণেরে করে চির জীবন-নির্ভর॥
কুমারসেন।  কেন এ করুণ সুর। কেন দুঃখগান।
                বিষণ্ন নয়ন কেন।
ইলা।                                 এ কি দুঃখগান।
                শোনায় গভীর সুখ দুঃখের মতন
                উদার উদাস। সুখদুঃখ ছেড়ে দিয়ে
                আত্মবিসর্জন করি রমণীর সুখ।
কুমারসেন।  পৃথিবী করিব বশ তোমার এ প্রেমে।
                আনন্দে জীবন মোর উঠে উচ্ছ্বসিয়া
                বিশ্বমাঝে। শ্রান্তিহীন কর্মসুখতরে
                ধায় হিয়া। চিরকীর্তি করিয়া অর্জন
                তোমারে করিব তার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
                বিরলে বিলাসে বসে এ অগাধ প্রেম
                পারি নে করিতে ভোগ অলসের মতো।
ইলা।         ওই দেখো রাশি রাশি মেঘ উঠে আসে
                উপত্যকা হতে, ঘিরিতে পর্বতশৃঙ্গ,

                সৃষ্টির বিচিত্র লেখা মুছিয়া ফেলিতে।
কুমারসেন।  দক্ষিণে চাহিয়া দেখো
অস্তরবিকরে
                সুবর্ণ-সমুদ্র সম সমতলভূমি
                গেছে চলে নিরুদ্দেশ কোন্‌ বিশ্বপানে।
                শস্যক্ষেত্র, বনরাজি, নদী, লোকালয়
                অস্পষ্ট সকলি
যেন স্বর্ণ-চিত্রপটে
                শুধু নানা বর্ণসমাবেশ, চিত্ররেখা
                এখনো ফোটে নি। যেন আকাঙক্ষা আমারি
                শৈল-অন্তরাল ছেড়ে ধরণীর পানে
                চলেছে বিস্তৃত হয়ে হৃদয়ে বহিয়া
                কল্পনার স্বর্ণলেখা ছায়াস্ফুট ছবি।
                আহা হোথা কত দেশ, নব দৃশ্য কত,
                কত নব কীর্তি, কত নব রঙ্গভূমি।
ইলা।         অনন্তের মূর্তি ধরে ওই মেঘ আসে
                মোদের করিতে গ্রাস। নাথ কাছে এস।
                আহা যদি চিরকাল এই মেঘমাঝে
                লুপ্ত বিশ্বে থাকিতাম তোমাতে আমাতে,
                দুটি পাখি একমাত্র মহামেখনীড়ে।
                পারিতে থাকিতে তুমি? মেঘ-আবরণ
                ভেদ করে কোথা হতে পশিত শ্রবণে
                ধরার আহ্বান; তুমি ছুটে চলে যেতে
                আমারে ফেলিয়া রেখে প্রলয়ের মাঝে।

                        পরিচারিকার প্রবেশ
পরিচারিকা। কাশ্মীরে এসেছে দূত জালন্ধর হতে
                গোপন সংবাদ লয়ে।
কুমারসেন।                             তবে যাই, প্রিয়ে,
                আবার আসিব ফিরে পূর্ণিমার রাতে
                নিয়ে যাব হৃদয়ের চিরপূর্ণিমারে

                হৃদয়দেবতা আছ, গৃহলক্ষ্মী হবে।
                                                    [ প্রস্থান
ইলা।         যাও তুমি, আমি একা কেমনে পারিব
                তোমারে রাখিতে ধরে। হায়, কত ক্ষুদ্র,
                কত ক্ষুদ্র আমি। কী বৃহৎ এ সংসার,
                কী উদ্দাম তোমার হৃদয়। কে জানিবে
                আমার বিরহ। কে গনিবে অশ্রু মোর।
                কে মানিবে এ নিভৃত বনপ্রান্তভাগে
                শূন্যহিয়া বালিকার মর্মকাতরতা।