ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
রুদ্রচণ্ড
দ্বাদশ দৃশ্য
রুদ্রচণ্ড | ||
রুদ্রচণ্ড । | এখনো ত কিছু তার পেনু না সংবাদ | |
পৃথ্বীরাজ মরেছে কি রয়েছে বাঁচিয়া। হীন প্রাণ, কবে তোর ফুরাইবে কাজ! ঋণ-করা প্রাণ আর বহিতে পারি না, কবে তোরে ত্যাগ ক'রে বাঁচিব আবার! ছিছি, তোর লাগি আমি ভিক্ষা করিলাম, জীবন নামেতে এক মরণ পাইনু! অদৃষ্ট রে, আরো কি চাহিস করিবারে? অনুগ্রহ 'পরে মোর জীবন রাখিলি! অনুগ্রহ– শিশু চাঁদ, তার অনুগ্রহ! [একটি দূতের প্রবেশ] |
||
দূত । | বন্দী পৃথ্বীরাজ আজ হত হয়েছেন। | |
রুদ্রচণ্ড । | [চমকিয়া]– | |
হত? সে কি কথা? মিথ্যা বলিস নে মূঢ়! মরে নি সে, মরে নি, মরে নি পৃথ্বীরাজ। এখনো আছে এ ছুরি, আছে এ হৃদয়, বল্ তুই, এখনো সে আছে পৃথ্বীরাজ। কোথা যাস বল্ তুই এখনো সে আছে! |
||
দূত । | সহসা উন্মাদ আজি হলে নাকি তুমি? | |
বন্দীভাবে পৃথ্বীরাজ হত হয়েছেন যারে বলি সেই মোরে মারিতে উদ্যত, কিন্তু হেন রোষ আমি দেখি নি ত কারো। [প্রস্থান |
||
রুদ্রচণ্ড । | [ছুরি নিক্ষেপ করিয়া ]– | |
মুহূর্ত্তে জগৎ মোর ধ্বংস হ'য়ে গেল। শূন্য হয়ে গেল মোর সমস্ত জীবন! পৃথ্বীরাজ মরে নাই, মরেছে যে জন সে কেবল রুদ্রচণ্ড, আর কেহ নয়। যে দুরন্ত দৈত্যশিশু দিন রাত্রি ধ'রে হৃদয়মাঝারে আমি করিনু পালন, তারে নিয়ে খেলা শুধু এক কাজ ছিল, পৃথিবীতে আর কিছু ছিল না আমার, তাহারি জীবন ছিল আমার জীবন– এ মুহূর্ত্তে মরে গেল সেই বৎস মোর! তারি নাম রুদ্রচণ্ড, আমি কেহ নই। আয়, ছুরি, আয় তবে, প্রভু গেছে তোর– এ শূন্য আসন তাঁর ভেঙ্গে ফেল্ তবে। [বিঁধাইয়া বিঁধাইয়া ] ভেঙ্গে ফেল্, ভেঙ্গে ফেল্, ভেঙ্গে ফেল্ তবে। [অমিয়ার প্রবেশ] |
||
অমিয়া। | পিতা, পিতা, অমিয়ারে ক্ষমা কর পিতা! | |
[চমকিয়া স্তব্ধ] | ||
রুদ্রচণ্ড । | আয় মা অমিয়া মোর, কাছে আয় বাছা! | |
এত দিন পিতা তোর ছিল না এ দেহে, আজ সে সহসা হেথা এসেছে ফিরিয়া। অমিয়া, মলিন বড় মুখখানি তোর! আহা বাছা, কত কষ্ট পেলি এ জীবনে! আর তোরে দুঃখ পেতে হবে না, বালিকা, পাষণ্ড পিতার তোর ফুরায়েছে দিন। |
||
অমিয়া। | [রুদ্রচণ্ডকে আলিঙ্গন করিয়া]– | |
ও কথা বোলো না পিতা, বোলো না, বোলো না– অমিয়ার এ সংসারে কেহ নাই আর। তাড়ায়ে দিয়েছে মোরে সমস্ত সংসার, এসেছি পিতার কোলে বড় শ্রান্ত হয়ে। যেথা তুমি যাবে পিতা যাব সাথে সাথে, যা তুমি বলিবে মোর সকলি শুনিব, তোমারে তিলেক-তরে ছাড়িব না আর। |
||
রুদ্রচণ্ড । | আয় মা আমার তুই থাক্ বুকে থাক্। | |
সমস্ত জীবন তোরে কত কষ্ট দিনু! এখন সময় মোর ফুরায়ে এসেছে, আজ তোরে কি করিয়া সুখী করি বাছা? আশীর্ব্বাদ করি, বাছা, জন্মান্তরে যেন এমন নিষ্ঠুর পিতা তোর নাহি হয়! অমিয়া মা, কাঁদিস্ নে, থাক্ বুকে থাক্! |