ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


রুদ্রচণ্ড
(নাটিকা)
 

ত্রয়োদশ দৃশ্য


                    চাঁদ কবি
     
    ভ্রমিব সন্ন্যাসীবেশে শ্মশানে শ্মশানে।
অদৃষ্ট রে, একি তোর নিদারুণ খেলা,
এক দিনে করিলি কি ওলট্‌পালট্‌!
কিছু রাখিলি নে আজ, কাল যাহা ছিল!
পৃথ্বীরাজ, রাজদণ্ড, দৌর্দ্দণ্ড প্রতাপ,
হাসি-কান্না-লীলা-ময় নগর নগরী,
অচল অটল কাল ছিল বর্ত্তমান,
আজ তার কিছু নাই! চিহ্ন মাত্র নাই!
এই যে চৌদিকে হেরি গ্রাম দেশ যত,
এই যে মানুষগণ করে কোলাহল,
একি সব শ্মশানেতে মরীচিকা আঁকা!
মাঝে মাঝে স্থানে স্থানে মিলাইয়া যায়,
জগতের শ্মশান বাহির হ'য়ে পড়ে।
চিতার কোলের পরে অস্থিভস্মমাঝে
মানুষেরা নাট্যশালা করেছে স্থাপন!
সন্ন্যাসী, কোথায় যাস্‌ শ্মশানে ভ্রমিতে!
নগর নগরী গ্রাম সকলি শ্মশান।
পৃথ্বীরাজ, তুমি যদি গেলে গো চলিয়া,
কবির বীণায় নাম রহিবে তোমার!
যত দিন বেঁচে রব' যশোগান তব
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে বেড়াব গাহিয়া।
কুটীরের রমণীরা কাঁদিবে সে গানে,
বালকেরা ঘেরি মোরে শুনিবে অবাক্‌!
দেশে দেশে সে গান শিখিবে কত লোক,
মুখে মুখে তব নাম করিবে বিরাজ,
দিশে দিশে সে নামের হবে প্রতিধ্বনি!
এই এক ব্রত শুধু রহিল আমার,
জীবনের আর সব গেছে ধ্বংস হ'য়ে!
আহা সে অমিয়া মোর, সে কি বেঁচে আছে?
তার তরে প্রাণ বড় হয়েছে অধীর!
চৌদিকে উঠিছে যবে রণকোলাহল,
চৌদিকে চলেছে যবে মরণের খেলা,
করুণ সে মুখখানি, দীনহীন বেশ,
আঁখির সামনে ছিল ছবির মতন!
আকাশের পটে আঁকা সে মুখ হেরিয়া
ভীষণ সমরক্ষেত্রে কাঁদিয়াছি আমি!
তার সেই "চাঁদ' 'চাঁদ' স্নেহের উচ্ছ্বাস,
কানেতে বাজিতেছিল আকুল সে স্বর!
একটি কথাও তারে নারিনু বলিতে?
মুখের কথাটি তার মুখে র'য়ে গেল,
একটি উত্তর দিতে পেনু না সময়?
চাহিয়া পাষাণদৃষ্টি আইনু চলিয়া!
পাব কি দেখিতে তারে কোথায় সে গেল?
যাই সে অরণ্যমাঝে যাই একবার!