ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
রুদ্রচণ্ড
সপ্তম দৃশ্য
বন [একজন দূতের প্রবেশ] |
||
দূত । | একি ঘোর স্তব্ধ বন, একি অন্ধকার! | |
চারি দিকে ঝোপঝাপ, পথ নাই কোথা! ওই বুঝি হবে তার আঁধার কুটীর, ওইখানে রুদ্রচণ্ড বাস করে বুঝি! [রুদ্রচণ্ডের প্রবেশ] |
||
দূত ।
প্রণাম! রুদ্র । কে তুই! দূত । আগে কুটীরেতে চল! |
||
একে একে সব কথা করি নিবেদন! | ||
রুদ্র । | পথ ভুলে বুঝি তুই এসেছিস্ হেথা? | |
আমি রুদ্রচণ্ড, এই অরণ্যের রাজা। নগরনিবাসী তোরা হেথা কেন এলি? ঐশ্বর্য্যমাঝারে তোরা প্রাসাদে থাকিস, ননীর পুতুল যত ললনারে লয়ে আবেশে মুদিত আঁখি, গদ গদ ভাষা, ফুলের পাপড়ি 'পরে পড়িলে চরণ ব্যথায় অধীর হয়ে উঠিস যে তোরা– নগরফুলের কীট হেথা তোরা কেন? আমি পৃথ্বীরাজ নই, আমি রুদ্রচণ্ড। মৃদু মিষ্ট কথা শুনি আহ্লাদে গলিয়া রাজ্যধন উপহার দিই নাক আমি! বিশাল রাজসভার ব্যাধি তোরা যত আমার অরণ্যে কেন করিলি প্রবেশ? পুষ্টদেহ ধনী তোরা, দেখিতে এলি কি কুটীরে কি ক'রে থাকে অরণ্যের লোক? মনে কি করিলি এই অরণ্যবাসীরে দুটা অনুগ্রহবাক্যে কিনিয়া রাখিবি? তাই আজ প্রাতঃকালে স্বর্ণময় বেশে বিশাল উষ্ঞীষ এক বাঁধিয়া মাথায় এলি হেথা ধাঁধিবারে দরিদ্রনয়ন? জানিস কি, বনবাসী এই রুদ্রচণ্ড– যতেক উষ্ণীষধারী আছয়ে নগরে সবার উষ্ণীষে করে শত পদাঘাত! |
||
দূত । | রুদ্রচণ্ড, মিছা কেন করিতেছে রোষ! | |
উপকার করিতেই এসেছি হেথায়! | ||
রুদ্র । | বটে বটে, উপকার করিতে এসেছ! | |
তোমারা নগরবাসী স্ফীতদেহ সবে উপকার করিবারে সদাই উদ্যত! তোমাদের নগরের বালক সে চাঁদ উপকার করিতে আসেন তিনি হেথা, উপকার ক'রে মোরে রেখেছেন কিনে! এত উপকার তিনি করেছেন মোর আর কারো উপকারে আবশ্যক নাই! |
||
দূত । | রুদ্রচণ্ড, বুঝি তুমি ভ্রমে পড়িয়াছ, | |
আমি নহি পৃথ্বীরাজ-রাজ-সভাসদ। রাজরাজ মহারাজ মহম্মদ ঘোরী তিনি আমারে হেথা করেন প্রেরণ– অধীর হোয়ো না, সব শোন একে একে– পৃথ্বীরাজে আক্রমিতে আসিছেন তিনি, বহুদূর পর্য্যটনে শ্রান্ত সৈন্যদল– থাম রুদ্র, বলি আমি, কথা মোর শোন– আজ এক রাত্রি-তরে এ অরণ্যমাঝে রাজরাজ মহারাজ চাহেন আশ্রয়! |
||
রুদ্র । | কি বলিলি দূত! তোর মহম্মদ ঘোরী, | |
পৃথ্বীরাজে আক্রমিতে আসিতেছে হেথা! | ||
দূত । | এ বনে ত লোক নাই? ধীরে কথা কও! | |
রুদ্র । | ধীরে ক'ব! যাব আমি নগরে নগরে, | |
ঊর্দ্ধকণ্ঠে কব আমি রাজপথে গিয়া, 'ম্লেচ্ছ সেনাপতি এক মহম্মদ ঘোরী তস্করের মত আসে আক্রমিতে দেশ!' |
||
দূত । | শোন রুদ্র, পৃথ্বী তব রাজ্যধন কেড়ে | |
নির্ব্বাসিত করেছেন এ অরণ্যদেশে– | ||
রুদ্র । | সংবাদের-আবর্জ্জনা-ভিক্ষুক কুক্কুর, | |
এ সংবাদ কোথা হতে করিলি সংগ্রহ? | ||
দূত । | ধৈর্য্য ধর। পৃথ্বী তব রাজ্যধন লয়ে | |
নির্ব্বাসিত করেছেন এ অরণ্যদেশে! প্রতিহিংসা সাধিবার সাধ থাকে যদি এই তার উপযুক্ত হয়েছে সময়। মহম্মদ ঘোরী হেথা– |
||
রুদ্র । | মহম্মদ ঘোরী? | |
কেন, আমার কি কাছে ছুরি নাই মূঢ়! এত দিন বক্ষে তারে করিনু পোষণ, প্রতি দণ্ডে দণ্ডে তারে দিয়েছি আশ্বাস। আজ কোথা হতে আসি মহম্মদ ঘোরী তাহার মুখের গ্রাস লইবে কাড়িয়া? যেমন পৃথ্বীর শত্রু মহম্মদ ঘোরী তেমনি আমারো শত্রু কহি তোরে দূত! পৃথ্বীর রাজত্ব প্রাণ এসেছে কাড়িতে, সমস্ত জগৎ মোর ছিনিতে এসেছে। এখনি নগরে যাব কহি তোরে আমি। অশুভ বারতা এই করিব প্রচার। [কৃপাণ খুলিয়া রুদ্রচণ্ডকে দূতের সহসা আক্রমণ উভয়ের যুদ্ধ ও দূতের পতন] |