কর্ণধার
ওগো আমার প্রাণের কর্ণধার,
দিকে দিকে ঢেউ জাগালো
লীলার পারাবার ।
আলোক-ছায়া চমকিছে
ক্ষণেক আগে ক্ষণেক পিছে,
অমার আঁধার ঘাটে ভাসায়
নৌকা পূর্ণিমার ।
ওগো কর্ণধার
ডাইনে বাঁয়ে দ্বন্দ্ব লাগে
সত্যের মিথ্যার ।
ওগো আমার লীলার কর্ণধার,
জীবন-তরী মৃত্যুভাঁটায়
কোথায় কর পার ।
নীল আকাশের
মৌনখানি
আনে দূরের
দৈববাণী,
গান করে দিন
উদ্দেশহীন
অকূল শূন্যতার ।
তুমি ওগো লীলার কর্ণধার
রক্তে বাজাও রহস্যময়
মন্ত্রের ঝংকার ।
তাকায় যখন নিমেষহারা
দিনশেষের প্রথমতারা
ছায়াঘন কুঞ্জবনে
মন্দ মৃদু গুঞ্জরণে
বাতাসেতে জাল বুনে দেয়
মদির তন্দ্রার ।
স্বপ্নস্রোতে লীলার কর্ণধার
গোধূলিতে পাল
তুলে দাও
ধূসরচ্ছন্দার ।
অস্তরবির ছায়ার সাথে
লুকিয়ে আঁধার আসন পাতে ।
ঝিল্লিরবে গগন কাঁপে,
দিগঙ্গনা কী জপ জাপে,
হাওয়ায় লাগে মোহপরশ
রজনীগন্ধার ।
হৃদয়-মাঝে লীলার কর্ণধার
একতারাতে বেহাগ বাজাও
বিধুর সন্ধ্যার ।
রাতের শঙ্খকুহর ব্যেপে
গম্ভীর রব উঠে কেঁপে ।
সঙ্গবিহীন চিরন্তনের
বিরহগান বিরাট মনের
শূন্যে করে নিঃশবদের
বিষাদ বিস্তার ।
তুমি আমার লীলার কর্ণধার
তারার
ফেনা ফেনিয়ে তোল
আকাশগঙ্গার ।
বক্ষে যবে বাজে মরণভেরি
ঘুচিয়ে ত্বরা ঘুচিয়ে সকল দেরি,
প্রাণের সীমা মৃত্যুসীমায়
সূক্ষ্ম হয়ে মিলায়ে যায়,
ঊর্ধ্বে তখন পাল তুলে দাও
অন্তিম যাত্রার ।
ব্যক্ত কর, হে মোর কর্ণধার,
আঁধারবিহীন অচিন্ত্য সে
অসীম অন্ধকার ।
উদীচী। শান্তিনিকেতন
২৮ জানুয়ারি ১৯৪০
আসা-যাওয়া
ভালোবাসা এসেছিল
এমন সে নিঃশব্দ চরণে
তারে স্বপ্ন হয়েছিল মনে,
দিই নি আসন বসিবার ।
বিদায় সে নিল যবে, খুলিতেই দ্বার
শব্দ
তার পেয়ে,
ফিরায়ে ডাকিতে গেনু ধেয়ে ।
তখন সে স্বপ্ন কায়াহীন,
নিশীথে
বিলীন,
দূরপথে তার দীপশিখা
একটি রক্তিম মরীচিকা ।
[শান্তিনিকেতন]
২৮ মার্চ ১৯৪০
বিপ্লব
ডমরুতে নটরাজ বাজালেন তাণ্ডবে যে তাল
ছিন্ন করে দিল তার ছন্দ তব ঝংকৃত কিঙ্কিণী
হে নর্তিনী,
বেণীর বন্ধনমুক্ত উৎক্ষিপ্ত তোমার কেশজাল
ঝঞ্ঝার বাতাসে
উচ্ছৃঙ্খল উদ্দাম উচ্ছ্বাসে ;
বিদীর্ণ বিদ্যুৎঘাতে তোমার বিহ্বল বিভাবরী
হে সুন্দরী ।
সীমন্তের সিঁথি তব, প্রবালে খচিত
কণ্ঠহার —
অন্ধকারে মগ্ন হল চৌদিকে বিক্ষিপ্ত অলংকার ।
আভরণশূন্য রূপ
বোবা হয়ে আছে করি চুপ ।
ভীষণ রিক্ততা তার
উৎসুক চক্ষুর ‘ পরে হানিছে আঘাত অবজ্ঞার ।
নিষ্ঠুর নৃত্যের ছন্দে মুগ্ধ
হস্তে-গাঁথা পুষ্পমালা
বিস্রস্ত দলিত দলে বিকীর্ণ করিছে রঙ্গশালা ।
মোহমদে ফেনায়িত কানায় কানায়
যে পাত্রখানায়
মুক্ত হত রসের
প্লাবন
মত্ততার শেষ পালা আজি সে করিল উদ্যাপন ।
যে অভিসারের পথে চেলাঞ্চলখানি
নিতে টানি
কম্পিত প্রদীপশিখা- ' পরে
তার চিহ্ন পদপাতে লুপ্ত করি দিলে চিরতরে ;
প্রান্তে তার ব্যর্থ
বাঁশিরবে
প্রতীক্ষিত প্রত্যাশার বেদনা যে উপেক্ষিত হবে ।
এ নহে তো ঔদাসীন্য, নহে ক্লান্তি, নহে বিস্মরণ,
ক্রুদ্ধ এ বিতৃষ্ণা তব মাধুর্যের প্রচন্ড মরণ,
তোমার কটাক্ষ
দেয় তারই হিংস্র সাক্ষ্য
ঝলকে ঝলকে
পলকে পলকে,
বঙ্কিম নির্মম
মর্মভেদী
তরবারি-সম ।
তবে তাই হোক,
ফুৎকারে নিবায়ে দাও অতীতের অন্তিম আলোক ।
চাহিব না ক্ষমা তব, করিব না দুর্বল বিনতি,
পরুষ মরুর পথে হোক মোর অন্তহীন গতি,
অবজ্ঞা করিয়া পিপাসারে,
দলিয়া চরণতলে ক্রূর বালুকারে ।
মাঝে মাঝে কটুস্বাদ দুখে
তীব্র রস দিতে ঢালি রজনীর অনিদ্র কৌতুকে
যবে তুমি ছিলে রহঃসখী ।
প্রেমেরই সে দানখানি, সে যেন কেতকী
রক্তরেখা এঁকে
গায়ে
রক্তস্রোতে মধুগন্ধ দিয়েছে মিশায়ে ।
আজ তব নিঃশব্দ নীরস হাস্যবাণ
আমার ব্যথার
কেন্দ্র করিছে সন্ধান ।
সেই লক্ষ্য তব
কিছুতেই মেনে
নাহি লব,
বক্ষ মোর এড়ায়ে সে যাবে শূন্যতলে,
যেখানে
উল্কার আলো জ্বলে
ক্ষণিক বর্ষণে
অশুভ দর্শনে ।
বে জে ওঠে ডঙ্কা, শঙ্কা শিহরায়
নিশীথগগনে —
হে নির্দয়া, কী সংকেত বিচ্ছুরিল স্খলিত কঙ্কণে ।
[শান্তিনিকেতন]
২১ জানুয়ারি ১৯৪০