ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই


 

          দূরের গান
সুদূরের পানে চাওয়া উৎকণ্ঠিত আমি
         মন সেই আঘাটায় তীর্থপথগামী
যেথায় হঠাৎ-নামা প্লাবনের জলে
                 তটপ্লাবী কোলাহলে
      ওপারের আনে আহ্বান,
               নিরুদ্দেশ পথিকের গান ।
ফেনোচ্ছল সে-নদীর বন্ধহারা জলে
               পণ্যতরী নাহি চলে,
কেবল অলস মেঘ ব্যর্থ ছায়া-ভাসানের খেলা
         খেলাইছে এবেলা ওবেলা ।

দিগন্তের নীলিমার স্পর্শ দিয়ে ঘেরা
       গোধূলিলগ্নের যাত্রী মোর স্বপনেরা ।
             নীল আলো প্রেয়সীর আঁখিপ্রান্ত হতে
নিয়ে যায় চিত্ত মোর অকূলের অবারিত স্রোতে ;
        চেয়ে চেয়ে দেখি সেই নিকটতমারে
               অজানার অতিদূর পারে ।

             মোর জন্মকালে
       নিশীথে সে কে মোরে ভাসালে
দীপ-জ্বালা ভেলাখানি নামহারা অদৃশ্যের পানে ;
          আজিও চলেছি তার টানে ।
                বাসাহারা মোর মন
তারার আলোতে কোন্‌ অধরাকে করে অন্বেষণ
         পথে পথে
              দূরের জগতে ।

          ওগো দূরবাসী,
কে শুনিতে চাও মোর চিরপ্রবাসের এই বাঁশি —
        অকারণ বেদনার ভৈরবীর সুরে
             চেনার সীমানা হতে দূরে
        যার গান কক্ষচ্যুত তারা
চিররাত্রি আকাশেতে খুঁজিছে কিনারা ।
         এ বাঁশি দিবে সে মন্ত্র যে মন্ত্রের গুণে
               আজি এ ফাল্গুনে
কুসুমিত অরণ্যের গভীর রহস্যখানি
        তোমার সর্বাঙ্গে মনে দিবে আনি
               সৃষ্টির প্রথম গূঢ়বাণী ।
        যেই বাণী অনাদির সুচিরবাঞ্ছিত
তারায় তারায় শূন্যে হল রোমাঞ্চিত,
                রূপেরে আনিল ডাকি
অরূপের অসীমেতে জ্যোতিঃসীমা আঁকি ।

 

উদয়ন। শান্তিনিকেতন

   ২২ ফাল্গুন ১৩৪৬

 

           কর্ণধার
ওগো আমার প্রাণের কর্ণধার,
     দিকে দিকে ঢেউ জাগালো
               লীলার পারাবার ।
          আলোক-ছায়া চমকিছে
          ক্ষণেক আগে ক্ষণেক পিছে,
          অমার আঁধার ঘাটে ভাসায়
                       নৌকা পূর্ণিমার ।
               ওগো কর্ণধার
          ডাইনে বাঁয়ে দ্বন্দ্ব লাগে
                সত্যের মিথ্যার ।

ওগো আমার লীলার কর্ণধার,
        জীবন-তরী মৃত্যুভাঁটায়
                  কোথায় কর পার ।
            নীল আকাশের মৌনখানি
            আনে দূরের দৈববাণী,
            গান করে দিন উদ্দেশহীন
                  অকূল শূন্যতার ।
         তুমি ওগো লীলার কর্ণধার
               রক্তে বাজাও রহস্যময়
                     মন্ত্রের ঝংকার ।
 

তাকায় যখন নিমেষহারা
দিনশেষের প্রথমতারা
        ছায়াঘন কুঞ্জবনে
        মন্দ মৃদু গুঞ্জরণে
        বাতাসেতে জাল বুনে দেয়
                 মদির তন্দ্রার ।
       স্বপ্নস্রোতে লীলার কর্ণধার
            গোধূলিতে পাল তুলে দাও
                  ধূসরচ্ছন্দার ।

অস্তরবির ছায়ার সাথে
লুকিয়ে আঁধার আসন পাতে ।
        ঝিল্লিরবে গগন কাঁপে,
        দিগঙ্গনা কী জপ জাপে,
        হাওয়ায় লাগে মোহপরশ
                   রজনীগন্ধার ।
হৃদয়-মাঝে লীলার কর্ণধার
        একতারাতে বেহাগ বাজাও
                  বিধুর সন্ধ্যার ।

রাতের শঙ্খকুহর ব্যেপে
গম্ভীর রব উঠে কেঁপে ।
         সঙ্গবিহীন চিরন্তনের
         বিরহগান বিরাট মনের
         শূন্যে করে নিঃশবদের
               বিষাদ বিস্তার ।
      তুমি আমার লীলার কর্ণধার
             তারার ফেনা ফেনিয়ে তোল
                    আকাশগঙ্গার ।

বক্ষে যবে বাজে মরণভেরি
ঘুচিয়ে ত্বরা ঘুচিয়ে সকল দেরি,
         প্রাণের সীমা মৃত্যুসীমায়
         সূক্ষ্ম হয়ে মিলায়ে যায়,
         ঊর্ধ্বে তখন পাল তুলে দাও
                   অন্তিম যাত্রার ।
ব্যক্ত কর, হে মোর কর্ণধার,
         আঁধারবিহীন অচিন্ত্য সে
               অসীম অন্ধকার ।
 

উদীচী। শান্তিনিকেতন
 ২৮ জানুয়ারি ১৯৪০

 

             আসা-যাওয়া
        ভালোবাসা এসেছিল
              এমন সে নিঃশব্দ চরণে
          তারে স্বপ্ন হয়েছিল মনে,
        দিই নি আসন বসিবার ।
বিদায় সে নিল যবে, খুলিতেই দ্বার
             শব্দ তার পেয়ে,
        ফিরায়ে ডাকিতে গেনু ধেয়ে ।
       তখন সে স্বপ্ন কায়াহীন,
             নিশীথে বিলীন,
           দূরপথে তার দীপশিখা
                  একটি রক্তিম মরীচিকা ।

[শান্তিনিকেতন]
২৮ মার্চ ১৯৪০


                     
বিপ্লব
ডমরুতে নটরাজ বাজালেন তাণ্ডবে যে তাল
      ছিন্ন করে দিল তার ছন্দ তব ঝংকৃত কিঙ্কিণী
                     হে নর্তিনী,
       বেণীর বন্ধনমুক্ত উৎক্ষিপ্ত তোমার কেশজাল
                     ঝঞ্ঝার বাতাসে
               উচ্ছৃঙ্খল উদ্দাম উচ্ছ্বাসে ;
বিদীর্ণ বিদ্যুৎঘাতে তোমার বিহ্বল বিভাবরী
                  হে সুন্দরী ।
         সীমন্তের সিঁথি তব, প্রবালে খচিত কণ্ঠহার —
অন্ধকারে মগ্ন হল চৌদিকে বিক্ষিপ্ত অলংকার ।
                আভরণশূন্য রূপ
          বোবা হয়ে আছে করি চুপ ।
               ভীষণ রিক্ততা তার
উৎসুক চক্ষুর ‘ পরে হানিছে আঘাত অবজ্ঞার ।
         নিষ্ঠুর নৃত্যের ছন্দে মুগ্ধ হস্তে-গাঁথা পুষ্পমালা
               বিস্রস্ত দলিত দলে বিকীর্ণ করিছে রঙ্গশালা ।
                   মোহমদে ফেনায়িত কানায় কানায়
                          যে পাত্রখানায়
           মুক্ত হত রসের প্লাবন
মত্ততার শেষ পালা আজি সে করিল উদ্‌যাপন ।
        যে অভিসারের পথে চেলাঞ্চলখানি
                   নিতে টানি
         কম্পিত প্রদীপশিখা- ' পরে
     তার চিহ্ন পদপাতে লুপ্ত করি দিলে চিরতরে ;
           প্রান্তে তার ব্যর্থ বাঁশিরবে
     প্রতীক্ষিত প্রত্যাশার বেদনা যে উপেক্ষিত হবে ।

এ নহে তো ঔদাসীন্য, নহে ক্লান্তি, নহে বিস্মরণ,
      ক্রুদ্ধ এ বিতৃষ্ণা তব মাধুর্যের প্রচন্ড মরণ,
                 তোমার কটাক্ষ
      দেয় তারই হিংস্র সাক্ষ্য
                ঝলকে ঝলকে
                      পলকে পলকে,
                 বঙ্কিম নির্মম
            মর্মভেদী তরবারি-সম ।
         তবে তাই হোক,
      ফুৎকারে নিবায়ে দাও অতীতের অন্তিম আলোক ।
চাহিব না ক্ষমা তব, করিব না দুর্বল বিনতি,
     পরুষ মরুর পথে হোক মোর অন্তহীন গতি,
                 অবজ্ঞা করিয়া পিপাসারে,
     দলিয়া চরণতলে ক্রূর বালুকারে ।

               মাঝে মাঝে কটুস্বাদ দুখে
তীব্র রস দিতে ঢালি রজনীর অনিদ্র কৌতুকে
                    যবে তুমি ছিলে রহঃসখী ।
প্রেমেরই সে দানখানি, সে যেন কেতকী
            রক্তরেখা এঁকে গায়ে
রক্তস্রোতে মধুগন্ধ দিয়েছে মিশায়ে ।
      আজ তব নিঃশব্দ নীরস হাস্যবাণ
            আমার ব্যথার কেন্দ্র করিছে সন্ধান ।
                  সেই লক্ষ্য তব
            কিছুতেই মেনে নাহি লব,
      বক্ষ মোর এড়ায়ে সে যাবে শূন্যতলে,
             যেখানে উল্কার আলো জ্বলে
                  ক্ষণিক বর্ষণে
                       অশুভ দর্শনে ।

        বে জে ওঠে ডঙ্কা, শঙ্কা শিহরায় নিশীথগগনে —
     হে নির্দয়া, কী সংকেত বিচ্ছুরিল স্খলিত কঙ্কণে ।

[শান্তিনিকেতন]
২১ জানুয়ারি ১৯৪০