|   | 
		              
		ব্যথিতাজাগায়ো না, ওরে জাগায়ো না ।
 ও আজি মেনেছে হার
 ক্রূর বিধাতার কাছে ।
 সব চাওয়া ও যে দিতে চায় নিঃশেষে
 অতলে জলাঞ্জলি ।
 দুঃসহ দুরাশার
 গুরুভার যাক দূরে
 কৃপণ প্রাণের ইতর বঞ্চনা ।
 আসুক নিবিড় নিদ্রা,
 তামসী মসীর তুলিকায়
 অতীত দিনের বিদ্রূপবাণী
 রেখায় রেখায় মুছে মুছে দিক্
 স্মৃতির পত্র হতে,
 থেমে যাক ওর বেদনার গুঞ্জন
 সুপ্ত পাখির স্তব্ধ নীড়ের মতো ।
 
 
		[শান্তিনিকেতন]১৩ জানুয়ারি ১৯৪০
 
		
		বিদায়
 বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে
 শেষ কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে।
 তেমনি তুমি যাবে জানি,
 ঝলক দেবে হাসিখানি,
 অলক হতে কসবে অশোক নাচের তালে।
 ভাসান-খেলার তরীখানি চলবে বেয়ে,
 একলা ঘাটে রইব চেয়ে।
 অস্তরবি তোমার পালে
 রঙিন রশ্মি যখন ঢালে
 কালিমা রয় আমার রাতের
 অন্তরালে।
 [১৩৪৬]
 
		
		যাবার আগে
 উদাস হাওয়ার পথে পথে
 মুকুলগুলি ঝরে,
 কুড়িয়ে নিয়ে এনেছি তাই
 লহো করুণ করে ।
 যখন যাব চলে
 ফুটবে তোমার কোলে,
 মালা গাঁথার আঙুল যেন
 আমায় স্মরণ করে ।
 
 ও হাতখানি হাতে নিয়ে
 বসব তোমার পাশে
 ফুল-বিছানো ঘাসে,
 কানাকানির সাক্ষী রইবে তারা ।
 বউ-কথা-কও ডাকবে তন্দ্রাহারা ।
 
 স্মৃতির ডালায় রইবে আভাসগুলি
 কালকে দিনের তরে ।
 শিরীষ-পাতায় কাঁপবে আলো
 নীরব দ্বিপ্রহরে ।
 
 [১৩৪৬]
 
		
		সানাই
 সারারাত ধ'রে
 গোছা গোছা কলাপাতা আসে গাড়ি ভ'রে ।
 আসে সরা খুরি
 ভূরি ভূরি ।
 এপাড়া ওপাড়া হতে যত
 রবাহূত অনাহূত আসে শত শত ;
 প্রবেশ পাবার তরে
 ভোজনের ঘরে
 ঊর্ধ্বশ্বাসে ঠেলাঠেলি করে ;
 ব'সে পড়ে যে পারে যেখানে,
 নিষেধ না মানে ।
 কে কাহারে হাঁক ছাড়ে হৈ হৈ,
 এ কই, ও কই ।
 রঙিন উষ্ণীষধর
 লালরঙা সাজে যত অনুচর
 
 অনর্থক ব্যস্ততায় ফেরে সবে
 আপনার দায়িত্বগৌরবে ।
 গোরুর গাড়ির সারি হাটের রাস্তায়,
 রাশি রাশি ধুলো উড়ে যায়,
 রাঙা রাগে
 রৌদ্রে গেরুয়া রঙ লাগে ।
 ওদিকে ধানের কল দিগন্তে কালিমাধূম্র হাত
 ঊর্ধ্বে তুলি, কলঙ্কিত করিছে প্রভাত ।
 ধান-পচানির গন্ধে
 বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
 মিশাইছে বিষ ।
 থেকে থেকে রেলগাড়ি মাঠের ওপারে দেয় শিস ।
 দুই প্রহরের ঘণ্টা বাজে ।
 
 সমস্ত এ ছন্দভাঙা অসংগতি-মাঝে
 সানাই লাগায় তার সারঙের তান ।
 কী নিবিড় ঐক্যমন্ত্র করিছে সে দান
 কোন্ উদ্ভ্রান্তের কাছে,
 বুঝিবার সময় কি আছে ।
 অরূপের মর্ম হতে সমুচ্ছ্বাসি
 উৎসবের মধুচ্ছন্দ বিস্তারিছে বাঁশি ।
 সন্ধ্যাতারা-জ্বালা অন্ধকারে
 অনন্তের বিরাট পরশ যথা অন্তর-মাঝারে,
 তেমনি সুদূর স্বচ্ছ সুর
 গভীর মধুর
 অমর্ত লোকের কোন্ বাক্যের অতীত সত্যবাণী
 অন্যমনা ধরণীর কানে দেয় আনি ।
 নামিতে নামিতে এই আনন্দের ধারা
 বেদনার মূর্ছনায় হয় আত্মহারা ।
 বসন্তের যে দীর্ঘনিশ্বাস
 বিকচ বকুলে আনে বিদায়ের বিমর্ষ আভাস,
 সংশয়ের আবেগ কাঁপায়
 সদ্যঃপাতী শিথিল চাঁপায়,
 তারি স্পর্শ লেগে
 সাহানার রাগিণীতে বৈরাগিণী ওঠে যেন জেগে,
 চলে যায় পথহারা অর্থহারা দিগন্তের পানে ।
 
 কতবার মনে ভাবি, কী যে সে কে জানে ।
 মনে হয়, বিশ্বের যে মূল উৎস হতে
 সৃষ্টির নির্ঝর ঝরে শূন্যে শূন্যে কোটি কোটি স্রোতে
 এ রাগিণী সেথা হতে আপন ছন্দের পিছু পিছু
 নিয়ে আসে বস্তুর অতীত কিছু
 হেন ইন্দ্রজাল
 যার সুর যার তাল
 রূপে রূপে পূর্ণ হয়ে উঠে
 কালের অঞ্জলিপুটে ।
 প্রথম যুগের সেই ধ্বনি
 শিরায় শিরায় উঠে রণরণি ;
 মনে ভাবি, এই সুর প্রত্যহের অবরোধ- ' পরে
 যতবার গভীর আঘাত করে
 ততবার ধীরে ধীরে কিছু কিছু খুলে দিয়ে যায়
 ভাবী যুগ-আরম্ভের অজানা পর্যায় ।
 নিকটের দুঃখদ্বন্দ্ব নিকটের অপূর্ণতা তাই
 সব ভুলে যাই,
 মন যেন ফিরে
 সেই অলক্ষ্যের তীরে তীরে
 যেথাকার রাত্রিদিন দিনহারা রাতে
 পদ্মের কোরক-সম প্রচ্ছন্ন রয়েছে আপনাতে ।
 
 [উদীচী। শান্তিনিকেতন]
 ১৫ জানুয়ারি ১৯৪০
 
		
		পূর্ণা
 তুমি গো পঞ্চদশী
 শুক্লা নিশার অভিসারপথে
 চরম তিথির শশী।
 স্মিত স্বপ্নের আভাস লেগেছে
 বিহ্বল তব রাতে।
 ক্বচিৎ চকিত বিহগকাকলি
 তব যৌবনে উঠিছে আকুলি
 নব আষাঢ়ের কেতকীগন্ধ-
 শিথিলিত নিদ্রাতে।
 
 যেন অশ্রুত বনমর্মর
 তোমার বক্ষে কাঁপে থরথর।
 অগোচর চেতনার
 অকারণ বেদনার
 ছায়া এসে পড়ে মনের দিগন্তে,
 গোপন অশান্তি
 উছলিয়া তুলে ছলছল জল
 কজ্জল-আঁখিপাতে।
 
 [শান্তিনিকেতন]
 ১০।১।৪০
 
		কৃপণা
 এসেছিনু দ্বারে ঘনবর্ষণ রাতে,
 প্রদীপ নিবালে কেন অঞ্চলাঘাতে।
 কালো ছায়াখানি মনে পড়ে গেল আঁকা,
 বিমুখ মুখের ছবি অন্তরে ঢাকা,
 কলঙ্করেখা যেন
 চিরদিন চাঁদ বহি চলে সাথে সাথে।
 
 কেন বাধা হল দিতে মাধুরীর কণা
 হায় হায়, হে কৃপণা।
 তব যৌবন-মাঝে
 লাবণ্য বিরাজে,
 লিপিখানি তার নিয়ে এসে তবু
 কেন যে দিলে না হাতে।
 
 [জানুয়ারি ১৯৪০]
 
		
		ছায়াছবি
 আমার প্রিয়ার সচল ছায়াছবি
 সজল নীলাকাশে।
 আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
 সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
 সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার ভাসে।
 বারিঝরা বনের গন্ধ নিয়া
 পরশহারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
 আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
 আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়,
 আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
 নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে।
 [১৩৪৫]
 |