|
স্মৃতির ভূমিকা
আজি এই মেঘমুক্ত সকালের স্নিগ্ধ নিরালায়
অচেনা গাছের যত ছিন্ন ছিন্ন ছায়ার ডালায়
রৌদ্রপুঞ্জ আছে ভরি।
সারাবেলা ধরি
কোন্ পাখি আপনারি সুরে কুতূহলী
আলস্যের পেয়ালায় ঢেলে দেয় অস্ফুট কাকলি।
হঠাৎ কী হল মতি,
সোনালি রঙের প্রজাপতি
আমার রুপালি চুলে
বসিয়া রয়েছে পথ ভুলে।
সাবধানে থাকি, লাগে ভয়,
পাছে ওর জাগাই সংশয়—
ধরা প’ড়ে যায় পাছে, আমি নই গাছের দলের,
আমার বাণী সে নহে ফুলের ফলের।
চেয়ে দেখি, ঘন হয়ে কোথা নেমে গেচে ঝোপঝাড়;
সম্মুখে পাহাড়
আপনার অচলতা ভুলে থাকে বেলা-অবেলায়,
হামাগুড়ি দিয়ে চলে দলে দলে মেঘের খেলায়।
হোথা শুষ্ক জলধারা
শব্দহীন রচিছে ইশারা
পরিশ্রান্ত নিদ্রিত বর্ষার। নুড়িগুলি
বনের ছায়ার মধ্যে অস্থিসার প্রেতের অঙ্গুলি
নির্দেশ করিছে তারে যাহা নিরর্থক,
নির্ঝরিণী-সর্পিণীর দেহচ্যুত ত্বক্।
এখনি এ আমার দেখাতে
মিলায়েছে শৈলশ্রেণী তরঙ্গিত নীলিম রেখাতে
আপন অদৃশ্য লিপি। বাড়ির সিঁড়ির ’পরে
স্তরে স্তরে
বিদেশী ফুলের টব, সেথা জেরেনিয়মের গন্ধ
শ্বসিয়া নিয়েছে মোর ছন্দ
এ চারিদিকের এই-সব নিয়ে সাথে
বর্ণে গন্ধে বিচিত্রিত একটি দিনের ভূমিকাতে
এটুকু রচনা মোর বাণীর যাত্রায় হোক পার
যে ক’দিন তার ভাগ্যে সময়ের আছে অধিকার।
মংপু
৮ জুন ১৯৩৯
মানসী
মনে নেই, বুঝি হবে অগ্রহান মাস,
তখন তরণীবাস
ছিল মোর পদ্মাবক্ষ-’পরে।
বামে বালুচরে
সর্বশূন্য শুভ্রতার না পাই অবধি।
ধারে ধারে নদী
কলরবধারা দিয়ে নিঃশব্দেরে করিছে মিনতি।
ওপারেতে আকাশের প্রশান্ত প্রণতি
নেমেছে মন্দিরচূড়া-’পরে।
হেথা-হোথা পলিমাটিস্তরে
পাড়ির নিচের তলে
ছোলা-খেত ভরেছে ফসলে।
অরণ্যে নিবিড় গ্রাম নীলিমার নিম্নান্তের পটে;
বাঁধা মোর নৌকাখানি জনশূন্য বালুকার তটে।
পূর্ণ যৌবনের বেগে
নিরুদ্দেশ বেদনার জোয়ার উঠেছে মনে জেগে
মানসীর মায়ামূর্তি বহি।
ছন্দের বুনানি গেঁথে অদেখার সাথে কথা কহি।
ম্লানরৌদ্র অপরাহ্ণবেলা
পাণ্ডুর জীবন মোর হেরিলাম প্রকাণ্ড একেলা
অনারদ্ধ সৃজনের বিশ্বকর্তা-সম।
সুদূর দুর্গম
কোন্ পথে যায় শোনা
অগোচর চরণের স্বপ্নে আনাগোনা।
প্রলাপ বিছায়ে দিনু আগন্তুক অচেনার লাগি,
আহ্বান পাঠানু শূন্যে তারি পদপরশন মাগি।
শীতের কৃপণ বেলা যায়।
ক্ষীণ কুয়াশায়
অস্পষ্ট হয়েছে বালি।
সায়াহ্নের মলিন সোনালি
পলে পলে
বদল করিছে রঙ মসৃণ তরঙ্গহীন জলে।
বাহিরেতে বাণী মোর হল শেষ,
অন্তরের তারে তারে ঝংকারে রহিল তার রেশ।
অফলিত প্রতীক্ষার সেই গাথা আজি।
কবিরে পশ্চাতে ফেলে শূন্যপথে চলিয়াছে বাজি।
কোথায় রহিল তার সাথে
বক্ষস্পন্দে-কম্পমান সেই স্তব্ধ রাতে
সেই সন্ধ্যাতারা।
জন্মসাথিহারা
কাব্যখানি পাড়ি দিল চিহ্নহীন কালের সাগরে
কিছুদিন তরে;
শুধু একখানি
সূত্রছিন্ন বাণী
সেদিনের দিনান্তের মগ্নস্মৃতি হতে
ভেসে যায় স্রোতে।
[মংপু]
৯ জুন ১৯৩৯
দেওয়া-নেওয়া
বাদল দিনের প্রথম কদমফুল
আমায় করেছ দান,
আমি তো দিয়েছি ভরা শ্রাবণের
মেঘমল্লার গান।
সজল ছায়ার অন্ধকারে
ঢাকিয়া তারে
এনেছি সুরে শ্যামল খেতের
প্রথম সোনার ধান।
আজ এনে দিলে যাহা
হয়তো দিবে না কাল,
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।
স্মৃতিবন্যার উছল প্লাবনে
আমার এ গান শ্রাবণে শ্রাবণে
ফিরিয়া ফিরিয়া বাহিবে তরণী
ভরি তব সম্মান।
[শান্তিনিকেতন]
১০।১।৪০
সার্থকতা
ফাল্গুনের সূর্য যবে
দিল কর প্রসারিয়া সঙ্গীহীন দক্ষিণ অর্ণবে,
অতল বিরহ তার যুগযুগান্তের
উচ্ছ্বসিয়া ছুটে গেল নিত্য-অশান্তের
সীমানার ধারে।
ব্যথার ব্যথিত কারে
ফিরিল খুঁজিয়া,
বেড়ালো যুঝিয়া
আপন তরঙ্গদল-সাথে।
অবশেষে রজনীপ্রভাতে,
জানে না সে কখন দুলায়ে গেল চলি
বিপুল নিশ্বাসবেগে একটুকু মল্লিকার কলি।
উদ্বারিল গন্ধ তার,
সচকিয়া লভিল সে গভীর রহস্য আপনার।
এই বার্তা ঘোষিল অম্বরে—
সমুদ্রের উদ্বোধন পূর্ণ আজি পুষ্পের অন্তরে।
[শান্তিনিকেতন]
৭ আশ্বিন ১৩৪৫
মায়া
আজ এ মনের কোন্ সীমানায়
যুগান্তরের প্রিয়া ।
দূরে-উড়ে-যাওয়া মেঘের ছিদ্র দিয়া
কখনো আসিছে রৌদ্র কখনো ছায়া,
আমার জীবনে তুমি আজ শুধু মায়া ;
সহজে তোমায় তাই তো মিলাই সুরে,
সহজেই ডাকি সহজেই রাখি দূরে ।
স্বপ্নরূপিণী তুমি
আকুলিয়া আছ পথ-খোয়া মোর
প্রাণের স্বর্গভূমি ।
নাই কোনো ভার, নাই বেদনার তাপ,
ধূলির ধরায় পড়ে না পায়ের ছাপ ।
তাই তো আমার ছন্দে
সহসা তোমার চুলের ফুলের গন্ধে
জাগে নির্জন রাতের দীর্ঘশ্বাস,
জাগে প্রভাতের পেলব তারায়
বিদায়ের স্মিত হাস ।
তাই পথে যেতে কাশের বনেতে
মর্মর দেয় আনি
পাশ-দিয়ে-চলা ধানী-রঙ-করা
শাড়ির পরশখানি ।
যদি জীবনের বর্তমানের তীরে
আস কভু তুমি ফিরে
স্পষ্ট আলোয়, তবে
জানি না তোমার মায়ার সঙ্গে
কায়ার কি মিল হবে ।
বিরহস্বর্গলোকে
সে-জাগরণের রূঢ় আলোয়
চিনিব কি চোখে-চোখে ।
সন্ধ্যাবেলায় যে-দ্বারে দিয়েছ
বিরহকরুণ নাড়া,
মিলনের ঘায়ে সে-দ্বার খুলিলে
কাহারো কি পাবে সাড়া ।
কালিম্পঙ
২২ জুন ১৯৩৮
অদেয়
তোমায় যখন সাজিয়ে দিলেম দেহ,
করেছ সন্দেহ
সত্য আমার দিই নি তাহার সাথে ।
তাই কেবলি বাজে আমার দিনে রাতে
সেই সুতীব্র ব্যথা —
এমন দৈন্য, এমন কৃপণতা,
যৌবন-ঐশ্বর্যে আমার এমন অসম্মান ।
সে লাঞ্ছনা নিয়ে আমি পাই নে কোথাও স্থান
এই বসন্তে ফুলের নিমন্ত্রণে ।
ধেয়ান-মগ্ন ক্ষণে
নৃত্যহারা শান্ত নদী সুপ্ত তটের অরণ্যচ্ছায়ায়
অবসন্ন পল্লীচেতনায়
মেশায় যখন স্বপ্নে-বলা মৃদু ভাষার ধারা —
প্রথম রাতের তারা
অবাক চেয়ে থাকে,
অন্ধকারের পারে যেন কানাকানির মানুষ পেল কাকে,
হৃদয় তখন বিশ্বলোকের অনন্ত নিভৃতে
দোসর নিয়ে চায় যে প্রবেশিতে —
কে দেয় দুয়ার রুধে,
একলা ঘরের স্তব্ধ কোণে থাকি নয়ন মুদে ।
কী সংশয়ে কেন তুমি এলে কাঙাল বেশে ।
সময় হলে রাজার মতো এসে
জানিয়ে কেন দাও নি আমায় প্রবল তোমার দাবি ।
ভেঙে যদি ফেলতে ঘরের চাবি
ধুলার 'পরে মাথা আমার দিতেম লুটায়ে,
গর্ব আমার অর্ঘ্য হত পায়ে ।
দুঃখের সংঘাতে আজি সুধার পাত্র উঠেছে এই ভ 'রে,
তোমার পানে উদ্দেশেতে ঊর্ধ্বে আছি ধ 'রে
চরম আত্মদান ।
তোমার অভিমান
আঁধার ক'রে আছে আমার সমস্ত জগৎ,
পাই নে খুঁজে সার্থকতার পথ ।
কালিম্পঙ
১৮ জুন ১৯৩৮ |