|
রূপকথায়
কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা
মনে মনে ।
মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা
মনে মনে ।
তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপকথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপকথার,
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা
মনে মনে ।
সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি
মেঘে মেঘে আকাশকুসুম তুলি ।
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
যাই ভেসে দূর দিশে,
পরীর দেশের বদ্ধ দুয়ার দিই হানা
মনে মনে ।
[শান্তিনিকেতন]
১০।১।৪০
আহ্বান
জ্বেলে দিয়ে যাও সন্ধ্যাপ্রদীপ
বিজন ঘরের কোণে।
নামিল শ্রাবণ, কালো ছায়া তার
ঘনাইল বনে বনে।
বিস্ময় আনো ব্যগ্র হিয়ার পরশ-প্রতীক্ষায়
সজল পবনে নীল বসনের চঞ্চল কিনারায়,
দুয়ার-বাহির হতে আজি ক্ষণে ক্ষণে
তব কবরীর করবীমালার বারতা আসুক মনে।
বাতায়ন হতে উৎসুক দুই আঁখি
তব মঞ্জীরধ্বনি পথ বেয়ে
তোমারে কি যায় ডাকি।
কম্পিত এই মোর বক্ষের ব্যথা
অলকে তোমার আনে কি চঞ্চলতা
বকুলবনের মুখরিত সমীরণে।
[শান্তিনিকেতন]
১০।১।৪০
অধীরা
চির-অধীরার বিরহ-আবেগ
দূরদিগন্তপথে
ঝঞ্ঝার ধ্বজা উড়ায়ে ছুটিল
মত্ত মেঘের রথে ।
দ্বার ভাঙিবার অভিযান তার,
বার বার কর হানে,
বার বার হাঁকে ‘ চাই আমি চাই ',
ছোটে অলক্ষ্য-পানে ।
হুহু হুংকার ঝর্ঝর বর্ষণ,
সঘন শূন্যে বিদ্যুৎঘাতে
তীব্র কী হর্ষণ ।
দুর্দাম প্রেম কি এ —
প্রস্তর ভেঙে খোঁজে উত্তর
গর্জিত ভাষা দিয়ে ।
মানে না শাস্ত্র, জানে না শঙ্কা,
নাই দুর্বল মোহ —
প্রভুশাপ- 'পরে হানে অভিশাপ
দুর্বার বিদ্রোহ ।
করুণ ধৈর্যে গনে না দিবস,
সহে না পলেক গৌণ,
তাপসের তপ করে না মান্য,
ভাঙে সে মুনির মৌন ।
মৃত্যুরে দেয় টিটকারি তার হাস্যে,
মঞ্জীরে বাজে যে-ছন্দ তার লাস্যে
নহে মন্দাক্রান্তা —
প্রদীপ লুকায়ে শঙ্কিত পায়ে
চলে না কোমলকান্তা ।
নিষ্ঠুর তার চরণতাড়নে
বিঘ্ন পড়িছে খসে,
বিধাতারে হানে
ভর্ৎসনাবাণী
বজ্রের
নির্ঘোষে।
নিলাজ ক্ষুধায় অগ্নি
বরষে
নিঃসংকোচে আঁখি,
ঝড়ের বাতাসে অবগুণ্ঠন
উড্ডীন
থাকি থাকি।
মুক্ত বেণীতে, স্রস্ত
আঁচলে,
উচ্ছৃঙ্খল সাজে
দেখা যায় ওর মাঝে
অনাদি কালের
বেদনার উদ্বোধন-
সৃষ্টিযুগের প্রথম রাতের রোদন-
যে-নবসৃষ্টির অসীম কালের
সিংহদুয়ারে থামি
হেঁকেছিল তার প্রথম মন্ত্রে
'এই
আসিয়াছি আমি'।
মংপু
৮ জুন ১৯৩৮
বাসাবদল
যেতেই হবে ।
দিনটা যেন খোঁড়া পায়ের মতো
ব্যন্ডেজেতে বাঁধা ।
একটু চলা, একটু থেমে-থাকা,
টেবিলটাতে হেলান দিয়ে বসা
সিঁড়ির দিকে চেয়ে ।
আকাশেতে পায়রাগুলো ওড়ে
ঘুরে ঘুরে চক্র বেঁধে ।
চেয়ে দেখি দেয়ালে সেই লেখনখানি
গেল বছরের,
লালরঙা পেন্সিলে লেখা —
‘এসেছিলুম ; পাই নি দেখা ; যাই তা হলে ।
দোসরা ডিসেম্বরে । '
এ লেখাটি ধুলো ঝেড়ে রেখেছিলেম তাজা,
যাবার সময় মুছে দিয়ে যাব ।
পুরোনো এক ব্লটিং কাগজ
চায়ের ভোজে অলস ক্ষণের হিজিবিজি-কাটা,
ভাঁজ ক'রে তাই নিলেম জামার নিচে ।
প্যাক করতে গা লাগে না,
মেজের ‘পরে বসে আছি পা ছড়িয়ে ।
হাতপাখাটা ক্লান্ত হাতে
অন্যমনে দোলাই ধীরে ধীরে ।
ডেস্কে ছিল মেডেন্-হেয়ার পাতায় বাঁধা
শুকনো গোলাপ,
কোলে নিয়ে ভাবছি বসে —
কী ভাবছি কে জানে ।
অবিনাশের ফরিদপুরে বাড়ি,
আনুকূল্য তার
বিশেষ কাজে লাগে
আমার এ দশাতেই ।
কোথা থেকে আপনি এসে জোটে
চাইতে না চাইতেই,
কাজ পেলে সে ভাগ্য ব'লেই মানে —
খাটে মুটের মতো ।
জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা,
লাগল ক'ষে আস্তিন গুটিয়ে ।
ওডিকোলন মুড়ে নিল পুরোনো এক আনন্দবাজারে ।
ময়লা মোজায় জড়িয়ে নিল এমোনিয়া ।
ড্রেসিং কেসে রাখল খোপে খোপে
হাত-আয়না, রূপোয় বাঁধা বুরুশ,
নখ চাঁচবার উখো,
সাবানদানি, ক্রিমের কৌটো, ম্যাকাসারের তেল ।
ছেড়ে-ফেলা শাড়িগুলো
নানা দিনের নিমন্ত্রণের
ফিকে গন্ধ ছড়িয়ে দিল ঘরে ।
সেগুলো সব বিছিয়ে দিয়ে চেপে চেপে
পাট করতে অবিনাশের যে-সময়টা গেল
নেহাত সেটা বেশি ।
বারে বারে ঘুরিয়ে আমার চটিজোড়া
কোঁচা দিয়ে যত্নে দিল মুছে,
ফুঁ দিয়ে সে উড়িয়ে দিল ধুলোটা কাল্পনিক
মুখের কাছে ধ'রে ।
দেয়াল থেকে খসিয়ে নিল ছবিগুলো,
একটা বিশেষ ফোটো
মুছল আপন আস্তিনেতে অকারণে ।
একটা চিঠির খাম
হঠাৎ দেখি লুকিয়ে নিল
বুকের পকেটেতে ।
দেখে যেমন হাসি পেল, পড়ল দীর্ঘশ্বাস ।
কার্পেটটা গুটিয়ে দিল দেয়াল ঘেঁষে —
জন্মদিনের পাওয়া,
হল বছর-সাতেক ।
অবসাদের ভারে অলস মন,
চুল বাঁধতে গা লাগে নাই সারা সকালবেলা,
আলগা আঁচল অন্যমনে বাঁধি নি ব্রোচ দিয়ে ।
কুটিকুটি ছিঁড়তেছিলেম একে-একে
পুরোনো সব চিঠি —
ছড়িয়ে রইল মেঝের ‘পরে, ঝাঁট দেবে না কেউ
বোশেখমাসের শুকনো হাওয়া ছাড়া ।
ডাক আনল পাড়ার পিয়ন বুড়ো,
দিলেম সেটা কাঁপা হাতে রিডাইরেক্টেড ক ' রে ।
রাস্তা দিয়ে চলে গেল তপসি-মাছের হাঁক,
চমকে উঠে হঠাৎ পড়ল মনে —
নাই কোনো দরকার ।
মোটর-গাড়ির চেনা শব্দ কখন দূরে মিলিয়ে গেছে
সাড়ে-দশটা বেলায়
পেরিয়ে গিয়ে হাজরা রোডের মোড় ।
উজাড় হল ঘর,
দেয়ালগুলো অবুঝ-পারা তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে
যেখানে কেউ নেই ।
সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে দিল অবিনাশ
ট্যাক্সিগাড়ি- 'পরে ।
এই দরোজায় শেষ বিদায়ের বাণী
শোনা গেল ঐ ভক্তের মুখে —
বললে, ‘আমায় চিঠি লিখো । '
রাগ হল তাই শুনে
কেন জানি বিনা কারণেই ।
[শান্তিনিকেতন
অগস্ট ১৯৩৮]
শেষ কথা
রাগ কর নাই কর, শেষ কথা এসেছি বলিতে
তোমার প্রদীপ আছে, নাইকো সলিতে।
শিল্প তার মূল্যবান, দেয় না সে আলো,
চোখেতে জড়ায় লোভ, মনেতে ঘনায় ছায়া কালো
অবসাদে। তবু তারে প্রাণপণে রাখি যতনেই,
ছেড়ে যাব তার পথ নেই।
অন্ধকারে অন্ধদৃষ্টি নানাবিধ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরে
আচ্ছন্ন করিয়া বাস্তবেরে।
অস্পষ্ট তোমারে যবে
ব্যগ্রকণ্ঠে ডাক দিই অত্যুক্তির স্তবে
তোমারে লঙ্ঘন করি সে-ডাক বাজিতে থাকে সুরে
তাহারি উদ্দেশে আজো যে রয়েছে দূরে।
হয়তো সে আসিবে না কভূ,
তিমিরে আচ্ছন্ন তুমি তারেই নির্দেশ কর তবু।
তোমার এ দূত অন্ধকার
গোপনে আমার
ইচ্ছারে করিয়া পঙ্গু গতি তার করেছে হরণ,
জীবনের উৎসজলে মিশায়েছ মাদক মরণ।
রক্তে মোর যে-দুর্বল আছে
শঙ্কিত বক্ষের কাজে
তারেই সে করেছে সহায়,
পশুবাহনের মতো মোহভার তাহারে বহায়।
সে যে একান্তই দীন,
মূল্যহীন,
নিগড়ে বাঁধিয়া তারে
আপনারে
বিড়ম্বিত করিতেছ পূর্ণ দান হতে,
এ প্রমাদ কখনো কি দেখিবে আলোতে।
প্রেম নাহি দিয়ে যারে টানিয়াছ উচ্ছিষ্টের লোভে
সে-দীন কি পার্শ্বে তব শোভে।
কভু কি জানিতে পাবে অসম্মানে নত এই প্রাণ
বহন করিছে নিত্য তোমারি আপন অসম্মান।
আমারে যা-পারিলে না দিতে
সে-কার্পণ্য তোমারেই চিরদিন রহিল বঞ্চিতে।
শ্যামলী। শান্তনিকেতন
২২ মার্চ ১৯৩৯
মুক্তপথে
বাঁকাও ভুরু দ্বারে আগল দিয়া,
চক্ষু করো রাঙা,
ঐ আসে মোর জাত-খোয়ানো প্রিয়া
ভদ্র-নিয়ম-ভাঙা।
আসন পাবার কাঙাল ও নয় তো
আচার-মানা ঘরে—
আমি ওকে বসাব হয়তো
ময়লা কাঁথার ’পরে।
সাবধানে রয় বাজার-দরের খোঁজে
সাধু গাঁয়ের লোক,
ধুলার বরন ধূসর বেশে ও যে
এড়ায় তাদের চোখ।
বেশের আদর করতে গিয়ে ওরা
রূপের আদর ভোলে—
আমার পাশে ও মোর মনোচোরা,
একলা এসো চলে।
হঠাৎ কখন এসেছ ঘর ফেলে
তুমি পথিক বধূ,
মাটির ভাঁড়ে কোথায় থেকে পেলে
পদ্মাবনের মধু।
ভালোবাসি ভাবের সহজ খেলা
এসছ তাই শুনে—
মাটির পাত্রে নাইকো আমার হেলা
হাতের পরশগুণে।
পায়ে নূপুর নাই রহিল বাঁধা,
নাচেতে কাজ নাই,
যে-চলনটি রক্তে তোমার সাধা
মন ভোলাবে তাই।
লজ্জা পেতে লাগে তোমার লাজ
ভূষণ নেইকো ব’লে,
নষ্ট হবে নেই তো এমন সাজ
ধুলোর ’পরে চ’লে।
গাঁয়ের কুকুর ফেরে তোমার পাশে,
রাখালরা হয় জড়ো,
বেদের মেয়ের মতন অনায়াসে
টাট্টু ঘোড়ায় চড়ো।
ভিজে শাড়ি হাঁটুর ’পরে তুলে
পার হয়ে যাও নদী,
বামুনপাড়ার রাস্তা যে যাই ভুলে
তোমায় দেখি যদি।
হাটের দিনে শাক তুলে নাও ক্ষেতে
চুপড়ি নিয়ে কাঁখে,
মটর কলাই খাওয়াও আঁচল পেতে
পথের গাধাটাকে।
মান নাকো বাদল দিনের মানা,
কাদায়-মাখা পায়ে
মাথায় তুলে কচুর পাতাখানা
যাও চলে দূর গাঁয়ে।
পাই তোমারে যেমন খুশি তাই
যেথায় খুশি সেথা।
আয়োজনের বালাই কিছু নাই
জানবে বলো কে তা।
সতর্কতার দায় গুচায়ে দিয়ে
পাড়ার অনাদরে
এসো ও মোর জাত খোয়ানো প্রিয়ে,
মু্ক্ত পথের ’পরে।
[শ্রীনিকেতন]
৬ নভেম্বর ১৯৩৬ |