|   | 
		
		            
		
		দ্বিধাএসেছিলে তবু আস নাই, তাই
 জানায়ে গেলে
 সমুখের পথে পলাতকা পদ-পতন ফেলে।
 তোমার সে উদাসীনতা
 উপহাসভরে জানালো কি মোর দীনতা।
 সে কি ছল-করা অবহেলা, জানি না সে—
 চপল চরণ সত্য কি ঘাসে ঘাসে
 গেল উপেক্ষা মেলে।
 পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা ঝরে জল,
 ছলছল করে শ্যাম বনান্ততল।
 
 তুমি কোথা দুরে কুঞ্জছায়াতে
 মিলে গেলে কলমুখর মায়াতে,
 পিছে পিছে তব ছায়ারৌদ্রের
 খেলা গেলে তুমি খেলে।
 [জানুয়ারি ১৯৪০]
 
		
		আধোজাগা
 রাত্রে কখন মনে হল যেন
 ঘা দিলে আমার দ্বারে,
 জানি নাই আমি জানি নাই, তুমি
 স্বপ্নের পরপারে ।
 অচেতন মন-মাঝে
 নিবিড় গহনে ঝিমিঝিমি ধ্বনি বাজে,
 কাঁপিছে তখন বেণুবনবায়ু
 ঝিল্লির ঝংকারে ।
 
 জাগি নাই আমি জাগি নাই গো,
 আধোজাগরণ বহিছে তখন
 মৃদুমন্থরধারে ।
 
 গভীর মন্দ্রস্বরে
 কে করেছে পাঠ পথের মন্ত্র
 মোর নির্জন ঘরে ।
 জাগি নাই আমি জাগি নাই, যবে
 বনের গন্ধ রচিল ছন্দ
 তন্দ্রার চারিধারে ।
 
		  
		
		[জানুয়ারি ১৯৪০] 
 
		
		যক্ষ
 যক্ষের বিরহ চলে অবিশ্রাম অলকার পথে
 পবনের ধৈর্যহীন রথে
 বর্ষাবাষ্প-ব্যাকুলিত দিগন্তে ইঙ্গিত-আমন্ত্রণে
 গিরি হতে গিরিশীর্ষে, বন হতে বনে ।
 সমুৎসুক বলাকার ডানার আনন্দ-চঞ্চলতা
 তারি সাথে উড়ে চলে বিরহীর আগ্রহ-বারতা
 চিরদূর স্বর্গপুরে,
 ছায়াচ্ছন্ন বাদলের বক্ষোদীর্ণ নিশ্বাসের সুরে ।
 নিবিড় ব্যথার সাথে পদে পদে পরমসুন্দর
 পথে পথে মেলে নিরন্তর ।
 
 পথিক কালের মর্মে জেগে থাকে বিপুল বিচ্ছেদে ;
 পূর্ণতার সাথে ভেদ
 মিটাতে সে নিত্য চলে ভবিষ্যের তোরণে তোরণে
 নব নব জীবনে মরণে ।
 এ বিশ্ব তো তারি কাব্য, মন্দাক্রান্তে তারি রচে টীকা
 বিরাট দুঃখের পটে আনন্দের সুদূর ভূমিকা ।
 ধন্য যক্ষ সেই
 সৃষ্টির আগুন-জ্বালা এই বিরহেই ।
 
 হোথা বিরহিণী ও যে স্তব্ধ প্রতীক্ষায়,
 দণ্ড পল গনি গনি মন্থর দিবস তার যায় ।
 সম্মুখে চলার পথ নাই,
 রুদ্ধ কক্ষে তাই
 আগন্তুক পান্থ-লাগি ক্লান্তিভারে ধূলিশায়ী আশা ।
 কবি তারে দেয় নাই বিরহের তীর্থগামী ভাষা ।
 
 তার তরে বাণীহীন যক্ষপুরী ঐশ্বর্যের কারা
 অর্থহারা —
 নিত্য পুষ্প, নিত্য চন্দ্রালোক,
 অস্তিত্বের এত বড়ো শোক
 নাই মর্তভূমে
 জাগরণ নাহি যার স্বপ্নমুগ্ধ ঘুমে ।
 প্রভুবরে যক্ষের বিরহ
 আঘাত করিছে ওর দ্বারে অহরহ ।
 স্তব্ধগতি চরমের স্বর্গ হতে
 ছায়ায়-বিচিত্র এই নানাবর্ণ মর্তের আলোতে
 উহারে আনিতে চাহে
 তরঙ্গিত প্রাণের প্রবাহে ।
 
		  
		কালিম্পঙ 
		২০ জুন ১৯৩৮ 
		
		পরিচয়
 বয়স ছিল কাঁচা,
 বিদ্যালয়ের মধ্যপথের থেকে
 বার হয়েছি আই.এ.- র পালা সেরে ।
 মুক্ত বেণী পড়ল বাঁধা খোঁপার পাকে,
 নতুন রঙের শাড়ি দিয়ে
 দেহ ঘিরে যৌবনকে নতুন নতুন ক'রে
 পেয়েছিলুম বিচিত্র বিস্ময়ে ।
 
 অচিন জগৎ বুকের মধ্যে পাঠিয়ে দিত ডাক
 কখন থেকে থেকে,
 দুপুরবেলায় অকাল ধারায় ভিজে মাটির আতপ্ত নিশ্বাসে,
 চৈত্ররাতের মদির ঘন নিবিড় শূন্যতায়,
 ভোরবেলাকার তন্দ্রাবিবশ দেহে
 ঝাপসা আলোয় শিশির-ছোঁয়া আলস-জড়িমাতে ।
 যে-বিশ্ব মোর স্পষ্ট জানার শেষের সীমায় থাকে
 তারি মধ্যে, গুণী, তুমি অচিন সবার চেয়ে
 তোমার আপন রচন-অন্তরালে ।
 কখনো-বা মাসিকপত্রে চমক দিত প্রাণে
 অপূর্ব এক বাণীর ইন্দ্রজাল,
 কখনো-বা আলগা-মলাট বইয়ের দাগি পাতায়
 হাজারোবার-পড়া লেখায় পুরনো কোন্ লাইন
 হানত বেদন বিদ্যুতেরই মতো,
 কখনো-বা বিকেলবেলায় ট্রামে চ ' ড়ে
 হঠাৎ মনে উঠত গুনগুনিয়ে
 অকারণে একটি তোমার শ্লোক ।
 
 অচিন কবি, তোমার কথার ফাঁকে ফাঁকে
 দেখা যেত একটি ছায়াছবি —
 স্বপ্ন-ঘোড়ায়-চড়া তুমি খুঁজতে বেরিয়েছ
 তোমার মানসীকে
 সীমাবিহীন তেপান্তরে,
 রাজপুত্র তুমি যে রূপকথার ।
 
 আয়নাখানার সামনে সেদিন চুল বাঁধবার বেলায়
 মনে যদি ক'রে থাকি সে রাজকন্যা আমিই,
 হেসো না তাই ব'লে ।
 তোমার সঙ্গে দেখা হবার আগে-ভাগেই
 ছুঁইয়েছিলে রুপোর কাঠি,
 জাগিয়েছিলে ঘুমন্ত এই প্রাণ ।
 সেই বয়সে আমার মতো অনেক মেয়ে
 ওই কথাটাই ভেবেছিল মনে ;
 তোমায় তারা বারে বারে পত্র লিখেছিল,
 কেবল তোমায় দেয় নি ঠিকানাটা ।
 
 হায় রে খেয়াল! খেয়াল এ কোন্ পাগলা বসন্তের ;
 ওই খেয়ালের কুয়াশাতে আবছা হয়ে যেত
 কত দুপুরবেলায়
 কত ক্লাসের পড়া,
 উছল হয়ে উঠত হঠাৎ
 যৌবনেরই খাপছাড়া এক ঢেউ ।
 
 রোমান্স বলে একেই —
 নবীন প্রাণের শিল্পকলা আপনা ভোলাবার ।
 আর-কিছুদিন পরেই
 কখন ভাবের নীহারিকায় রশ্মি হত ফিকে —
 বয়স যখন পেরিয়ে যেত বিশ-পঁচিশের কোঠা,
 হাল-আমলের নভেল প'ড়ে
 মনের যখন আব্রু যেত ভেঙে,
 তখন হাসি পেত
 আজকে দিনের কচিমেয়েপনায় ।
 
 সেই যে তরুণীরা
 ক্লাসের পড়ার উপলক্ষে
 পড়ত বসে ‘ ওড্স্ টু নাইটিঙ্গেল ',
 না-দেখা কোন্ বিদেশবাসী বিহঙ্গমের
 না-শোনা সংগীতে
 বক্ষে তাদের মোচড় দিত,
 ঝরোখা সব খুলে যেত হৃদয়-বাতায়নে
 ফেনায়িত সুনীল শূন্যতায়
 উজাড় পরীস্থানে ।
 
 বরষ-কয়েক যেতেই
 চোখে তাদের জুড়িয়ে গেল দৃষ্টি দহন
 মরীচিকায়-পাগল হরিণীর ।
 ছেঁড়া মোজা শেলাই করার এল যুগান্তর,
 বাজারদরের ঠকা নিয়ে চাকরগুলোর সঙ্গে বকাবকির,
 চা-পান-সভায় হাঁটুজলের সখ্যসাধনার ।
 কিন্তু আমার স্বভাব বশে
 ঘোর ভাঙে নি যখন ভোলামনে
 এলুম তোমার কাছাকাছি ।
 
 চেনাশোনার প্রথম পালাতেই
 পড়ল ধরা, একেবারে দুর্লভ নও তুমি —
 আমার লক্ষ্য-সন্ধানেরই আগেই
 তোমার দেখি আপনি বাঁধন-মানা ।
 হায় গো রাজার পুত্র,
 একটু পরশ দেবামাত্র পড়ল মুকুট খ ' সে
 আমার পায়ের কাছে,
 কটাক্ষেতে চেয়ে তোমার মুখে
 হেসেছিলুম আবিল চোখের বিহ্বলতায় ।
 তাহার পরে হঠাৎ কবে মনে হল —
 দিগন্ত মোর পাঁশু হয়ে গেল,
 মুখে আমার নামল ধূসর ছায়া ;
 পাখির কণ্ঠে মিইয়ে গেল গান,
 পাখায় লাগল উড়ুক্ষু পাগলামি ।
 পাখির পায়ে এঁটে দিলেম ফাঁস
 অভিমানের ব্যঙ্গস্বরে,
 বিচ্ছেদেরই ক্ষণিক বঞ্চনায়,
 কটুরসের তীব্র মাধুরীতে ।
 
 এমন সময় বেড়াজালের ফাঁকে
 পড়ল এসে আরেক মায়াবিনী ;
 রণিতা তার নাম ।
 এ কথাটা হয়তো জান —
 
 মেয়েতে মেয়েতে আছে বাজি রাখার পণ
 ভিতরে ভিতরে ।
 কটাক্ষে সে চাইল আমায়, তারে চাইলুম আমি,
 পাশা ফেলল নিপুণ হাতের ঘুরুনিতে,
 এক দানেতেই হল তারি জিত ।
 জিত ? কে জানে তাও সত্য কি না ।
 কে জানে তা নয় কি তারি
 দারুণ হারের পালা ।
 
 সেদিন আমি মনের ক্ষোভে
 বলেছিলুম কপালে কর হানি,
 চিনব ব'লে এলেম কাছে
 হল বটে নিংড়ে নিয়ে চেনা
 চরম বিকৃতিতে ।
 কিন্তু তবু ধিক্ আমারে, যতই দুঃখ পাই
 পাপ যে মিথ্যে কথা ।
 আপনাকে তো ভুলিয়েছিলুম যেই তোমারে এলেম ভোলাবারে ;
 ঘুলিয়ে-দেওয়া ঘূর্ণিপাকে সেই কি চেনার পথ ।
 আমার মায়ার জালটা ছিঁড়ে অবশেষে আমায় বাঁচালে যে ;
 আবার সেই তো দেখতে পেলেম
 আজো তোমার স্বপ্ন-ঘোড়ায়-চড়া
 নিত্যকালের সন্ধান সেই মানসসুন্দরীকে
 সীমাবিহীন তেপান্তরের মাঠে ।
 
 দেখতে পেলেম ছবি,
 এই বিশ্বের হৃদয়মাঝে
 বসে আছেন অনির্বচনীয়া,
 তুমি তাঁরি পায়ের কাছে বাজাও তোমার বাঁশি ।
 এ-সব কথা শোনাচ্ছে কি সাজিয়ে-বলার মতো ।
 না বন্ধু, এ হঠাৎ মুখে আসে,
 ঢেউয়ের মুখে মোতি ঝিনুক যেন
 মরুবালুর তীরে ।
 এ-সব কথা প্রতিদিনের নয় ;
 যে-তুমি নও প্রতিদিনের সেই তোমারে দিলাম যে-অঞ্জলি
 তোমার দেবীর প্রসাদ রবে তাহে ।
 আমি কি নই সেই দেবীরই সহচরী,
 ছিলাম না কি অচিন রহস্যে
 যখন কাছে প্রথম এসেছিলে ।
 
 তোমায় বেড়া দিতে গিয়ে আমায় দিলেম সীমা ।
 তবু মনে রেখো,
 আমার মধ্যে আজো আছে চেনার অতীত কিছু ।
 
 
		মংপু১৩ জুন ১৯৩৯
 
		
		নারী
 স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ
 যে-আনন্দরস
 রূপ ধরেছিল রমণীতে,
 ধরণীর ধমনীতে
 তুলেছিল চাঞ্চল্যের দোল
 রক্তিম হিল্লোল,
 সেই আদি ধ্যানমূর্তিটিরে
 সন্ধান করিছে ফিরে ফিরে
 রূপকার মনে-মনে
 বিধাতার তপস্যার সংগোপনে ।
 পলাতকা লাবণ্য তাহার
 বাঁধিবারে চেয়েছে সে আপন সৃষ্টিতে
 প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে ।
 দুর্বাধ্য প্রস্তরপিন্ডে দুঃসাধ্য সাধনা
 সিংহাসন করেছে রচনা
 অধরাকে করিতে আপন
 চিরন্তন ।
 সংসারের ব্যবহারে যত লজ্জা ভয়
 সংকোচ সংশয়,
 শাস্ত্রবচনের ঘের,
 ব্যবধান বিধিবিধানের
 সকলই ফেলিয়া দূরে
 ভোগের অতীত মূল সুরে
 নগ্নতা করেছে শুচি,
 দিয়ে তারে ভুবনমোহিনী শুভ্ররুচি ।
 পুরুষের অনন্ত বেদন
 মর্তের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ ।
 তারি চিহ্ন যেখানে-সেখানে
 কাব্যে গানে,
 ছবিতে মূর্তিতে,
 দেবালয়ে দেবীর স্তুতিতে ।
 কালে কালে দেশে দেশে শিল্পস্বপ্নে দেখে রূপখানি,
 নাহি তাহে প্রত্যহের গ্লানি ।
 দুর্বলতা নাহি তাহে, নাহি ক্লান্তি —
 টানি লয়ে বিশ্বের সকল কান্তি
 আদিস্বর্গলোক হতে নির্বাসিত পুরুষের মন
 রূপ আর অরূপের ঘটায় মিলন ।
 উদ্ভাসিত ছিলে তুমি, অয়ি নারী, অপূর্ব আলোকে
 সেই পূর্ণ লোকে —
 সেই ছবি আনিতেছ ধ্যান ভরি
 বিচ্ছেদের মহিমায় বিরহীর নিত্যসহচরী ।
 
 
		আলমোড়া১৮ মে ১৯৩৭
 |