|
গানের স্মৃতি
কেন মনে হয় —
তোমার এ গানখানি এখনি যে শোনালে তা নয় ।
বিশেষ লগ্নের কোনো চিহ্ন পড়ে নাই এর সুরে ;
শুধু এই মনে পড়ে, এই গানে দিগন্তের দূরে
আলোর কাঁপনখানি লেগেছিল সন্ধ্যাতারকার
সুগভীর স্তব্ধতায়, সে-স্পন্দন শিরায় আমার
রাগিণীর চমকেতে রহি রহি বিচ্ছুরিছে আলো
আজি দেয়ালির দিনে । আজো এই অন্ধকারে জ্বালো
সেই সায়াহ্নের স্মৃতি, যে নিভৃতে নক্ষত্রসভায়
নীহারিকা ভাষা তার প্রসারিল নিঃশব্দ প্রভায় —
যে-ক্ষণে তোমার স্বর জ্যোতির্লোকে দিতেছিল আনি
অনন্তের-পথ-চাওয়া ধরিত্রীর সকরুণ বাণী ।
সেই স্মৃতি পার হয়ে মনে মোর এই প্রশ্ন লাগে,
কালের-অতীত প্রান্তে তোমারে কি চিনিতাম আগে ।
দেখা হয়েছিল না কি কোনো-এক সংগীতের পথে
অরূপের মন্দিরেতে অপরূপ ছন্দের জগতে ।
শান্তিনিকেতন
দেয়ালি [৫ কার্তিক] ১৩৪৫
অবশেষে
যৌবনের অনাহূত রবাহূত ভিড়-করা ভোজে
কে ছিল কাহার খোঁজে,
ভালো করে মনে ছিল না তা ।
ক্ষণে ক্ষণে হয়েছে আসন পাতা,
ক্ষণে ক্ষণে নিয়েছে সরায়ে ।
মালা কেহ গিয়েছে পরায়ে
জেনেছিনু, তবু কে যে জানি নাই তারে ।
মাঝখানে বারে বারে
কত কী যে এলোমেলো
কভু গেল, কভু এল ।
সার্থকতা ছিল যেইখানে
ক্ষণিক পরশি তারে চলে গেছি জনতার টানে ।
সে যৌবনমধ্যাহ্নের অজস্রের পালা
শেষ হয়ে গেছে আজি, সন্ধ্যার প্রদীপ হল জ্বালা ।
অনেকের মাঝে যারে কাছে দেখে হয় নাই দেখা
একেলার ঘরে তারে একা
চেয়ে দেখি, কথা কই চুপে চুপে,
পাই তারে না-পাওয়ার রূপে ।
শান্তিনিকেতন
৩ ডিসেম্বর ১৯৩৮
সম্পূর্ণ
প্রথম তোমাকে দেখেছি তোমার
বোনের বিয়ের বাসরে
নিমন্ত্রণের আসরে ।
সেদিন তখনো দেখেও তোমাকে দেখি নি,
তুমি যেন ছিলে সূক্ষ্মরেখিণী
ছবির মতো —
পেন্সিলে-আঁকা ঝাপসা ধোঁয়াটে লাইনে
চেহারার ঠিক ভিতর দিকের
সন্ধানটুকু পাই নে ।
নিজের মনের রঙ মেলাবার বাটিতে
চাঁপালি খড়ির মাটিতে
গোলাপি খড়ির রঙ হয় নি যে গোলা,
সোনালি রঙের মোড়ক হয় নি খোলা ।
দিনে দিনে শেষে সময় এসেছে আগিয়ে,
তোমার ছবিতে আমারি মনের
রঙ যে দিয়েছি লাগিয়ে ।
বিধাতা তোমাকে সৃষ্টি করতে এসে
আনমনা হয়ে শেষে
কেবল তোমার ছায়া
রচে দিয়ে, ভুলে ফেলে গিয়েছেন —
শুরু করেন নি কায়া ।
যদি শেষ করে দিতেন, হয়তো
হত সে তিলোত্তমা,
একেবারে নিরুপমা ।
যত রাজ্যের যত কবি তাকে
ছন্দের ঘের দিয়ে
আপন বুলিটি শিখিয়ে করত
কাব্যের পোষা টিয়ে ।
আমার মনের স্বপ্নে তোমাকে
যেমনি দিয়েছি দেহ
অমনি তখন নাগাল পায় না
সাহিত্যিকেরা কেহ ।
আমার দৃষ্টি তোমার সৃষ্টি
হয়ে গেল একাকার ।
মাঝখান থেকে বিশ্বপতির ঘুচে গেল অধিকার ।
তুমি যে কেমন আমিই কেবল জানি,
কোনো সাধারণ বাণী
লাগে না কোনোই কাজে ।
কেবল তোমার নাম ধ'রে মাঝে-মাঝে
অসময়ে দিই ডাক,
কোনো প্রয়োজন থাক্ বা নাই-বা থাক্ ।
অমনি তখনি কাঠিতে-জড়ানো উলে
হাত কেঁপে গিয়ে গুন্তিতে যাও ভুলে ।
কোনো কথা আর নাই কোনো অভিধানে
যার এত বড়ো মানে ।
শ্যামলী। শান্তিনিকেতন
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯
উদ্বৃত্ত
তব দক্ষিণ হাতের পরশ
কর নি সমর্পণ।
লেখে আর মেছে তব আলো ছায়া
ভাবনার প্রাঙ্গণে
খনে খনে আলিপন।
বৈশাখে কৃশ নদী
পূর্ণ স্রোতের প্রসাদ না দিল যদি
শুধু কুণ্ঠিত বিশীর্ণ ধারা
তীরের প্রান্তে
জাগালো পিয়াসি মন।
যতটুকু পাই ভীরু বাসনার
অঞ্জলিতে
নাই বা উচ্ছলিল,
সারা দিবসের দৈন্যের শেসে
সঞ্চয় সে যে
সারা জীবনের স্বপ্নের আয়োজন।
[মংপু]
৩০।৯।৩৯
ভাঙন
কোন্ ভাঙনের পথে এলে
আমার সুপ্ত রাতে।
ভাঙল যা তাই ধন্য হল
নিঠুর চরণ-পাতে।
রাখব গেঁথে তারে
কমলমণির হারে,
দুলবে বুকে গোপন বেদনাতে।
সেতারখানি নিয়েছিলে
অনেক যতনভরে—
তার যবে তার ছিন্ন হল
ফেললে ভূমি-’পরে।
নীরব তাহার গান
রইল তোমার দান—
ফাগুন-হাওয়ার মর্মে বাজে
গোপন মত্ততাতে।
[শ্রীনিকেতন]
১২।৭।৩৯
অত্যুক্তি
মন যে দরিদ্র, তার
তর্কের নৈপুণ্য আছে, ধনৈশ্বর্য নাইকো ভাষার ।
কল্পনাভাণ্ডার হতে তাই করে ধার
বাক্য-অলংকার ।
কখন হৃদয় হয় সহসা উতলা —
তখন সাজিয়ে বলা
আসে অগত্যাই ;
শুনে তাই
কেন তুমি হেসে ওঠ, আধুনিকা প্রিয়ে,
অত্যুক্তির অপবাদ দিয়ে ।
তোমার সম্মানে ভাষা আপনারে করে সুসজ্জিত,
তারে তুমি বারে বারে পরিহাসে কোরো না লজ্জিত ।
তোমার আরতি-অর্ঘ্যে অত্যুক্তিবঞ্চিত ভাষা হেয়,
অসত্যের মতো অশ্রদ্ধেয় ।
নাই তার আলো,
তার চেয়ে মৌন ঢের ভালো ।
তব অঙ্গে অত্যুক্তি কি কর না বহন
সন্ধ্যায় যখন
দেখা দিতে আস ।
তখন যে হাসি হাস
সে তো নহে মিতব্যয়ী প্রত্যহের মতো —
অতিরিক্ত মধু কিছু তার মধ্যে থাকে তো সংহত ।
সে হাসির অতিভাষা
মোর বাক্যে ধরা দেবে নাই সে প্রত্যাশা ।
অলংকার যত পায় বাক্যগুলো তত হার মানে,
তাই তার অস্থিরতা বাড়াবাড়ি ঠেকে তব কানে ।
কিন্তু, ওই আশমানি শাড়িখানি
ও কি নহে অত্যুক্তির বাণী ।
তোমার দেহের সঙ্গে নীল গগনের
ব্যঞ্জনা মিলায়ে দেয়, সে যে কোন্ অসীম মনের
আপন ইঙ্গিত,
সে যে অঙ্গের সংগীত ।
আমি তারে মনে জানি সত্যের ও অধিক ।
সোহাগবাণীরে মোর হেসে কেন বল কাল্পনিক ।
পুরী
৭ মে ১৯৩৯
হঠাৎ মিলন
মনে পড়ে কবে ছিলাম একা বিজন চরে ;
তোমার নৌকা ভরা পালের ভরে
সুদূর পারের হতে
কোন্ অবেলার এল উজান স্রোতে ।
দ্বিধায় ছোঁওয়া তোমার মৌনীমুখে
কাঁপতেছিল সলজ্জ কৌতুকে
আঁচল-আড়ে দীপের মতো একটুখানি হাসি,
নিবিড় সুখের বেদন দেহে উঠছিল নিশ্বাসি ।
দুঃসহ বিস্ময়ে
ছিলাম স্তব্ধ হয়ে,
বলার মতো বলা পাই নি খুঁজে ;
মনের সঙ্গে যুঝে
মুখের কথার হল পরাজয় ।
তোমার তখন লাগল বুঝি ভয়,
বাঁধন-ছেঁড়া অধীরতার এমন দুঃসাহসে
গোপনে মন পাছে তোমায় দোষে ।
মিনতি উপেক্ষা করি ত্বরায় গেলে চলে
“ তবে আসি ” এইটি শুধু ব ' লে ।
তখন আমি আপন মনে যে-গান সারাদিন
গেয়েছিলেম, তাহারি সুর রইল অন্তহীন ।
পাথর-ঠেকা নির্ঝর সে, তারি কলস্বর
দূরের থেকে পূর্ণ করে বিজন অবসর ।
আলমোড়া
২৭ মে ১৯৩৭
গানের জাল
দৈবে তুমি
কখন নেশায় পেয়ে
আপন-মনে
যাও চলে গান গেয়ে।
যে আকাশের সুরের লেখা লেখ
বুঝি না তা, কেবল রহি চেয়ে।
হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে,
প্রতিদিনের ঠিকঠিকানা ভোলে—
মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন
গন্ধের পথ বেয়ে।
গানের টানা জালে
নিমেষ-ঘেরা বাঁধন হাতে
টানে অসীম কালে।
মাটির আড়ালে করি ভেদন
স্বর্গলোকের আনে বেদন,
পরান ফেলে ছেয়ে।
[১৯৩৯] |