|
বিমুখতা
মন যে তাহার হঠাৎপ্লাবনী
নদীর প্রায়
অভাবিত পথে সহসা কী টানে
বাঁকিয়া যায় —
সে তার সহজ গতি,
সেই বিমুখতা ভরা ফসলের
যতই করুক ক্ষতি ।
বাঁধা পথে তারে বাঁধিয়া রাখিবে যদি
বর্ষা নামিলে খরপ্রবাহিণী নদী
ফিরে ফিরে তার ভাঙিয়া ফেলিবে কূল,
ভাঙিবে তোমার ভুল ।
নয় সে খেলার পুতুল, নয় সে
আদরের পোষা প্রাণী,
মনে রেখো তাহা জানি ।
মত্তপ্রবাহবেগে
দুর্দাম তার ফেনিল হাস্য
কখন উঠিবে জেগে ।
তোমার প্রাণের পণ্য আহরি
ভাসাইয়া দিলে ভঙ্গুর তরী,
হঠাৎ কখন পাষাণে আছাড়ি
করিবে সে পরিহাস,
হেলায় খেলায় ঘটাবে সর্বনাশ ।
এ খেলারে যদি খেলা বলি মান,
হাসিতে হাস্য মিলাইতে জান,
তা হলে রবে না খেদ ।
ঝরনার পথে উজানের খেয়া,
সে যে মরণের জেদ ।
স্বাধীন বলো যে ওরে
নিতান্ত ভুল ক'রে ।
দিক্সীমানার বাঁধন টুটিয়া
ঘুমের ঘোরেতে চমকি উঠিয়া
যে-উল্কা পড়ে খ'সে
কোন্ ভাগ্যের দোষে
সেই কি স্বাধীন, তেমনি স্বাধীন এও —
এরে ক্ষমা করে যেয়ো ।
বন্যারে নিয়ে খেলা যদি সাধ
লাভের হিসাব দিয়ো তবে বাদ,
গিরিনদী-সাথে বাঁধা পড়িয়ো না
পণ্যের ব্যবহারে ।
মূল্য যাহার আছে একটুও
সাবধান করি ঘরে তারে থুয়ো,
খাটাতে যেয়ো না মাতাল চলার
চলতি এ কারবারে ।
কাটিয়ো সাঁতার যদি জানা থাকে,
তলিয়ে যেয়ো না আওড়ের পাকে,
নিজেরে ভাসায়ে রাখিতে না জান
ভরসা ডাঙার পারে —
যতই নীরস হোক-না সে তবু
নিরাপদ জেনো তারে ।
‘সে আমারি ' ব'লে বৃথা অহমিকা
ভালে আঁকি দেয় ব্যঙ্গের টিকা ।
আল্গা লীলায় নাই দেওয়া পাওয়া,
দূর থেকে শুধু আসা আর যাওয়া —
মানবমনের রহস্য কিছু শিখা ।
[কালিম্পং
জুন ১৯৪০]
আত্মছলনা
দোষী করিব না তোমারে,
ব্যথিত মনের বিকারে,
নিজেরেই আমি নিজে নিজে করি ছলনা।
মনের বুঝাই বুঝি ভালবাস,
আড়ালে আড়ালে তাই তুমি হাস;
স্থির জানে, এ যে অবুঝের খেলা,
এ শুধু মোহের রচনা।
সন্ধ্যামেঘের রাগে
অকারণে যত ভেসে-চলে-যাওয়া
অপরূপ ছবি জাগে।
সেইমতো ভাসে মায়ার আভাসে
রঙিন বাষ্প মনের আকাশে,
উড়াইয়া দেয় ছিন্ন লিপিতে
বিরহমিলন-ভাবনা।
[কালিম্পং]
২৯।৫।৪০
অসময়
বৈকালবেলা ফসল-ফুরানো
শূন্য খেতে
বৈশাখে যবে কৃপণ ধরণী
রয়েছে তেতে,
ছেড়ে তার বন জানি নে কখন
কী ভুল ভুলি
শুষ্ক ধূলির ধূসর দৈন্যে
এসেছিল বুল্বুলি ।
সকালবেলার স্মৃতিখানি মনে
বহিয়া বুঝি
তরুণ দিনের ভরা আতিথ্য
বেড়ালো খুঁজি ।
অরুণে শ্যামলে উজ্জ্বল সেই
পূর্ণতারে
মিথ্যা ভাবিয়া ফিরে যাবে সে কি
রাতের অন্ধকারে ।
তবুও তো গান করে গেল দান
কিছু না পেয়ে ।
সংশয়-মাঝে কী শুনায়ে গেল
কাহারে চেয়ে ।
যাহা গেছে সরে কোনো রূপ ধ'রে
রয়েছে বাকি,
এই সংবাদ বুঝি মনে মনে
জানিতে পেরেছে পাখি ।
প্রভাতবেলার যে ঐশ্বর্য
রাখে নি কণা,
এসেছিল সে যে, হারায় না কভু
সে সান্ত্বনা ।
সত্য যা পাই ক্ষণেকের তরে
ক্ষণিক নহে ।
সকালের পাখি বিকালের গানে
এ আনন্দই বহে ।
? ১৯৪০
অপঘাত
সূর্যাস্তের পথ হতে বিকালের রৌদ্র এল নেমে ।
বাতাস ঝিমিয়ে গেছে থেমে ।
বিচালি-বোঝাই গাড়ি চলে দূর নদিয়ার হাটে
জনশূন্য মাঠে ।
পিছে পিছে
দড়ি-বাঁধা বাছুর চলিছে ।
রাজবংশীপাড়ার কিনারে
পুকুরের ধারে
বনমালী পণ্ডিতের বড়ো ছেলে
সারাক্ষণ বসে আছে ছিপ ফেলে ।
মাথার উপর দিয়ে গেল ডেকে
শুকনো নদীর চর থেকে
কাজ্লা বিলের পানে
বুনোহাঁস গুগ্লি-সন্ধানে ।
কেটে-নেওয়া ইক্ষুখেত, তারি ধারে ধারে
দুই বন্ধু চলে ধীরে শান্ত পদচারে
বৃষ্টিধোওয়া বনের নিশ্বাসে,
ভিজে ঘাসে ঘাসে ।
এসেছে ছুটিতে —
হঠাৎ গাঁয়েতে এসে সাক্ষাৎ দুটিতে,
নববিবাহিত একজনা,
শেষ হতে নাহি চায় ভরা আনন্দের আলোচনা ।
আশে-পাশে ভাঁটিফুল ফুটিয়া রয়েছে দলে দলে
বাঁকাচোরা গলির জঙ্গলে,
মৃদুগন্ধে দেয় আনি
চৈত্রের ছড়ানো নেশাখানি ।
জারুলের শাখায় অদূরে
কোকিল ভাঙিছে গলা একেঘেয়ে প্রলাপের সুরে ।
টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে
ফিন্ল্যান্ড্ চূর্ণ হল সোভিয়েট বোমার বর্ষণে ।
[কালিম্পিং]
১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ |