|
অতীত
ও ভবিষ্যৎ
কেমন গো আমাদের ছোট সে কুটীরখানি—
সমুখে নদীটি যায় চলি,
মাথার উপরে তার বট অশথের ছায়া,
সামনে বকুল গাছগুলি।
সারাদিন হু হু করি বহিছে নদীর বায়ু,
ঝর ঝর দুলে গাছপালা,
ভাঙ্গাচোরা বেড়াগুলি, উঠেছে লতিকা তায়
ফুল ফুটে করিয়াছে আলা।
ও দিকে পড়িয়া মাঠ, দূরে দু-চারিটি গাভী
চিবায় নবীন তৃণদল—
কেহবা গাছের ছায়ে কেহবা খালের ধারে
পান করে সুশীতল জল।
জান ত কল্পনাবালা, কত সুখে ছেলেবেলা
সেইখানে করেছি যাপন—
সেদিন পড়িলে মনে প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে,
হুহু ক'রে ওঠে যেন মন।
নিশীথে নদী 'পরে ঘুমিয়েছে ছায়া-চাঁদ,
সাড়াশব্দ নাই চারি পাশে,
একটি দুরন্ত ঢেউ জাগে নি নদীর কোলে,
পাতাটিও নড়ে নি বাতাসে,
তখন যেমন ধীরে দূর হ'তে দূর প্রান্তে
নাবিকের বাঁশরীর গান—
ধরি ধরি করি সুর ধরিতে না পারে মন,
উদাসিয়া ওঠে যেন প্রাণ!
কি যেন হারানো ধন কোথাও না পাই খুঁজে,
কি কথা গিয়াছি যেন ভুলে,
বিস্মৃতি স্বপনবেশে পরাণের কাছে এসে
আধস্মৃতি জাগাইয়া তুলে।
তেমনি হে কলপনা, তুমি ও বীণায় যবে
বাজাও সেদিনকার গান,
আঁধার মরমমাঝে জেগে ওঠে প্রতিধ্বনি,
কেঁদে ওঠে আকুল পরাণ!
হা দেবি, তেমনি যদি থাকিতাম চিরকাল!
না ফুরাত সেই ছেলেবেলা,
হৃদয় তেমনি ভাবে করিত গো থল থল,
মরমেতে তরঙ্গের খেলা!
ঘুমভাঙ্গা আঁখি মেলি যখন প্রফুল্ল উষা
ফেলে ধীরে সুরভিনিশ্বাস,
ঢেউগুলি জেগে ওঠে পুলিনের কানে কানে
কহে তার মরমের আশ।
তেমনি উঠিত হৃদে প্রশান্ত সুখের ঊর্ম্মি
অতি-মৃদু অতি-সুশীতল—
বহিত সুখের শ্বাস, নাহিয়া শিশিরজলে
ফেলে যথা কুসুমসকল।
অথবা যেমন যবে প্রশান্ত সায়াহ্নকালে
ডুবে সূর্য্য সমুদ্রের
কোলে,
বিষণ্ণ কিরণ তার শ্রান্ত বালকের মত
প'ড়ে থাকে সুনীল সলিলে।
নিস্তব্ধ সকল দিক, একটি ডাকে না পাখী,
একটুও বহে না বাতাস,
তেমনি কেমন এক গম্ভীর বিষণ্ণ সুখ
হৃদয়ে তুলিত দীর্ঘশ্বাস।
এইরূপ কত কি যে হৃদয়ের ঢেউ-খেলা
দেখিতাম বসিয়া বসিয়া,
মরমের ঘুমঘোরে কত দেখিতাম স্বপ্ন
যেত দিন হাসিয়া-খুসিয়া।
বনের পাখীর মত অনন্ত আকাশতলে
গাহিতাম অরণ্যের গান—
আর কেহ শুনিত না, প্রতিধ্বনি জগিত না,
শূন্যে মিলাইয়া যেত তান।
প্রভাত এখনো আছে, এরি মধ্যে কেন তবে
আমার এমন দুরদশা—
অতীতে সুখের স্মৃতি, বর্ত্তমানে দুখজ্বালা,
ভবিষ্যতে এ কি রে কুয়াশা!
যেন এই জীবনের আঁধারসমুদ্র-মাঝে
ভাসায়ে দিয়েছি জীর্ণ তরী,
এসেছি যেখান হতে অস্ফুট সে নীলতট
এখনো রয়েছে দৃষ্টি ভরি!
সেদিকে ফিরায়ে আঁখি এখনো দেখিতে পাই
ছায়া-ছায়া কাননের রেখা,
নানা বরণের মেঘ মিশেছে বনের শিরে
এখনো বুঝি রে যায় দেখা!
যেতেছি যেখানে ভাসি সেদিকে চাহিয়া দেখি
কিছুই ত না পাই উদ্দেশ—
আঁধার সলিলরাশি সুদূর দিগন্তে মিশে,
কোথাও না দেখি তার শেষ!
ক্ষুদ্র জীর্ণ ভগ্ন তরি একাকী যাইবে ভাসি
যত দিনে ডুবিয়া না যায়,
সমুখে আসন্ন ঝড়, সমুখে নিস্তব্ধ নিশি
শিহরিছে বিদ্যুতশিখায়!
দিকবালা
দূর আকাশের পথ
উঠিছে জলদরথ,
নিম্নে চাহি দেখে কবি ধরণী নিদ্রিত।
অস্ফুট চিত্রের মত
নদ নদী পরবত,
পৃথিবীর পটে যেন রয়েছে চিত্রিত!
সমস্ত পৃথিবী ধরি একটি মুঠায়
অনন্ত সুনীল সিন্ধু সুধীরে লুটায়।
হাত ধরাধরি করি দিক্বালাগণ
দাঁড়ায়ে সাগরতীরে ছবির মতন।
কেহ বা জলদময় মাখায়ে জোছানা।
নীল দিগন্তের কোলে পাতিছে বিছানা।
মেখের শয্যায় কেহ ছড়ায়ে কুন্তল
নীরবে ঘুমাইতেছে নিদ্রায় বিহ্বল।
সাগরতরঙ্গ তার চরণে মিলায়,
লইয়া শিথিল কেশ পবন খেলায়।
কোন কোন দিক্বালা বসি কুতূহলে
আকাশের চিত্র আঁকে সাগরের জলে।
আঁকিল জলদমালা চন্দ্রগ্রহ তারা,
রঞ্জিল সাগর দিয়া জোছনার ধারা।
পাপিয়ার ধ্বনি শুনি কেহ হাসিমুখে
প্রতিধ্বনিরমণীরে জাগায় কৌতুকে!
শুকতারা প্রভাতের ললাটে ফুটিল,
পূরবের দিক্দেবী জাগিয়া উঠিল।
লোহিত কমলকরে পূরবের দ্বার
খুলিয়া, সিন্দূর দিল সীমন্তে উষার।
মাজি দিয়া উদয়ের কনকসোপান,
তপনের সারথিরে করিল আহ্বান।
সাগর-ঊর্ম্মির শিরে সোনার চরণ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেচে গেল দিক্বালাগণ।
পূরবদিগন্ত-কোলে জলদ গুছায়ে
ধরণীর মুখ হ'তে আঁধার মুছায়ে,
বিমল শিশিরজলে ধুইয়া চরণ,
নিবিড় কুন্তলে মাখি কনককিরণ,
সোনার মেঘের মত আকাশের তলে,
কনককমলসম মানসের জলে
ভাসিতে লাগিল যত দিক্-বালাগণে—
উলসিত তনুখানি প্রভাতপবনে।
ওই হিমগিরি-'পরে কোন দিক্বালা
রঞ্জিছে কনককরে নীহারিকামালা!
নিভৃতে সরসীজলে করিতেছে স্নান,
ভাসিছে কমলবনে কমলবয়ান।
তীরে উঠি মালা গাঁথি শিশিরের জলে
পরিছে তুষারশুভ্র সুকুমার গলে।
ওদিকে দেখেছ ওই সাহারা-প্রান্তরে,
মধ্যে দিক্দেবী শুভ্র বালুকার 'পরে।
অঙ্গ হতে ছুটিতেছে জ্বলন্ত কিরণ,
চাহিতে মুখের পানে ঝলসে নয়ন।
আঁকিছে বালুকাপুঞ্জে শত শত রবি,
আঁকিছে দিগন্তপটে মরীচিকা-ছবি।
অন্য দিকে কাশ্মীরের উপত্যকা-তলে
পরি শত বরণের ফুলমালা গলে,
শত বিহঙ্গের গান শুনিতে শুনিতে,
সরসীলহরীমালা গুনিতে গুনিতে,
এলায়ে কোমল তনু কমলকাননে
আলসে দিকের বালা মগন স্বপনে।
ওই হোথা দিক্দেবী বসিয়া হরষে
ঘুরায় ঋতুর চক্র মৃদুল পরশে।
ফুরায়ে গিয়েছে এবে শীতসমীরণ,
বসন্ত পৃথিবীতলে অর্পিবে চরণ।
পাখীরে গাহিতে কহি অরণ্যের গান
মলয়ের সমীরণে করিয়া আহ্বান
বনদেবীদের কাছে কাননে কাননে
কহিল ফুটাতে ফুলদিক্দেবীগণে—
বহিল মলয়বায়ু কাননে ফিরিয়া,
পাখীরা গাহিল গান কানন ভরিয়া।
ফুলবালা-সাথে আসি বনদেবীগণ
ধীরে দিক্দেবীদের বন্দিল চরণ। |