|
অপ্সরাপ্রেম
গাথা
নায়িকার উক্তি
রজনীর পরে আসিছে দিবস,
দিবসের পর রাতি।
প্রতিপদ ছিল হ'ল পূরণিমা,
প্রতি নিশি নিশি বাড়িল চাঁদিমা,
প্রতি নিশি নিশি ক্ষীণ হয়ে এল
ফুরালো জোছনাভাতি।
উদিছে তপন উদয়শিখরে,
ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া সারা দিন ধ'রে
ধীর পদক্ষেপে অবসন্ন দেহে
যেতেছে চলিয়া বিশ্রামের গেহে
মলিন বিষণ্ণ অতি।
উদিছে তারকা আকাশের তলে,
আসিছে নিশীথ প্রতি পলে পলে,
পল পল করি যায় বিভাবরী,
নিভিছে তারকা এক এক করি,
হাসিতেছে উষা সতী।
এস গো, সখা, এস গো—
কত দিন ধ'রে বাতায়নপাশে
একেলা বসিয়া, সখা, তব আশে—
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই,
পথপানে চেয়ে রয়েছি সদাই—
এস গো, সখা, এস গো!—
সুমুখে তটিনী যেতেছে বহিয়া,
নিশ্বসিছে বায়ু রহিয়া রহিয়া,
লহরীর পর উঠিছে লহরী,
গণিতেছি বসি এক এক করি—
নাই রাতি নাই দিন।
ওই তৃণগুলি হরিত প্রান্তরে
নোয়াইছে মাথা মৃদুবায়ুভরে,
সারা দিন যায়—সারা রাত যায়—
শূন্য আঁখি মেলি চেয়ে আছি হায়—
নয়ন পলকহীন।
বরষে বাদল, গরজে অশনি,
পলকে পলকে চমকে দামিনী,
পাগলের মত হেথায় হোথায়
আঁধার আকাশে বহিতেছে বায়
অবিশ্রাম সারারাতি।
বহিতেছে বায়ু পাদপের ‘পরে,
বহিছে আঁধার-প্রাসাদ-শিখরে,
ভগ্ন দেবালয়ে বহে হুহু করি,
জাগিয়া উঠিছে তটিনীলহরী
তটিনী উঠিছে মাতি।
কোথায় গো, সখা, কোথা গো!
একাকী হেথায় বাতায়নপাশে
রয়েছি বসিয়া, সখা, তব আশে—
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই,
পথপানে চেয়ে রয়েছি সদাই—
কোথায় গো, সখা কোথা গো!
যাহারা যাহারা গিয়েছিল রণে,
সবাই ফিরিয়া এসেছে ভবনে,
প্রিয়-আলিঙ্গনে প্রণয়িনীগণ
কাঁদিয়া হাসিয়া মুছিছে নয়ন
কোন জ্বালা নাহি জানে।
আমিই কেবল একা আছি প'ড়ে
পরিশ্রান্ত অতি — আশা ক'রে ক'রে—
নিরাশ পরাণ আর ত রহে না,
আর ত পারি না, আর ত সহে না,
আর ত সহে না প্রাণে।
এস গো, সখা, এস গো!
একাকী হেথায় বাতায়নপাশে
একেলা বসিয়া, সখা, তব আশে—
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই,
পথপানে চেয়ে রয়েছি সদাই,
এস গো, সখা, এস গো!—
আসে সন্ধ্যা হয়ে আঁধার আলয়ে—
একেলা রয়েছি বসি,
যে যাহার ঘরে আসিতেছে ফিরে,
জ্বলিছে প্রদীপ কুটীরে কুটীরে,
শ্রান্ত মাথা রাখি বাতায়নদ্বারে
আঁধার প্রান্তরে চেয়ে আছি হা রে—
আকাশে উঠিছে শশী।
কত দিন আর রহিব এমন,
মরণ হইলে বাঁচি রে এখন!
অবশ হৃদয়, দেহ দুরবল,
শুকায়ে গিয়াছে নয়নের জল,
যেতেছে দিবস নিশি!
কোথায় গো সখা, কোথা গো!
কত দিন ধ'রে, সখা, তব আশে
একেলা বসিয়া বাতায়নপাশে—
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই,
পথপানে চেয়ে রয়েছি সদাই—
কোথায় গো সখা, কোথা গো!
অপ্সরার উক্তি
অদিতিভবন হইতে যখন
আসিতেছিলাম অলকাপুরে—
মাথার উপরে সাঁঝের গগন,
শারদ তটিনী বহিছে দূরে!
সাঁঝের কনকবরণ সাগর
অলস ভাবে সে ঘুমায়ে আছে,
দেখিনু দারুণ বাধিয়াছে রণ
গউরীশিখর গিরির কাছে।
দেখিনু সহসা বীর একজন
সমরসাগরে গিরির মতন—
পদতলে আসি আঘাতে লহরী,
তবুও অটল-পারা।
বিশাল ললাটে ভ্রূভঙ্গীটি নাই,
শান্ত ভাব জাগে নয়নে সদাই—
উরস-বরমে বরষার মত
বরিষে বাণের ধারা।
অশনিধ্বনিত ঝটিকার মেঘে
দেখেছি ত্রিদশপতি—
চারি দিকে সব ছুটিছে ভাঙ্গিছে,
তিনি সে মহান্ অতি!
এমন উদার শান্ত ভাব বুঝি
দেখি নি তাঁহারো কভু।
পৃথ্বী নত হয় যাঁহার অসিতে,
স্বরগ যে জন পারেন শাসিতে,
দুরবল এই নারীহৃদয়ের
তাঁহারে করিনু প্রভু।
দিলাম বিছায়ে দিব্য পাখাছায়া
মাথার উপরে তাঁর,
মায়া দিয়া তাঁরে রাখিনু আবরি
নাশিতে বাণের ধার।
প্রতি পদে পদে গেনু সাথে সাথে,
দেখিনু সমর ঘোর—
শোণিত হেরিয়া শিহরি উঠিল
আকুল হৃদয় মোর।
থামিল সমর, জয়ী বীর মোর
উঠিলা তরণী-'পরে,
বহিল মৃদুল পবন, তরণী
চলিল গরবভরে।
গেল কত দিন— পূরব গগনে
উঠিল জলদরেখা,
মুহু ঝলকিয়া ক্ষীণ সৌদামিনী
দূর হ'তে দিল দেখা।
ক্রমশঃ জলদ ছাইল আকাশ,
অশনি সরোষে জ্বলি
মাথার উপর দিয়া তরণীর
অভিশাপ গেল বলি।
সহসা ভ্রূকুটি' উঠিল সাগর,
পবন উঠিল জাগি,
শতেক ঊরমি মাতিয়া উঠিল
সহসা কিসের লাগি।
দারুণ উল্লাসে সফেন সাগর
অধীর হইল হেন—
ভাঙ্গে-বিভোলা মহেশের মত
নাচিতে লাগিল যেন।
তরণীর 'পরে একেলা অটল
দাঁড়ায়ে বীর আমার,
শুনি ঝটিকার প্রলয়ের গীত
বাজিছে হৃদয় তাঁর।
দেখিতে দেখিতে ডুবিল তরণী,
ডুবিল নাবিক যত—
যুঝি যুঝি বীর সাগরের সাথে
হইল চেতনহত।
আকাশ হইতে নামিয়া ছুঁইনু
অধীর জলধিজল,
পদতলে আসি করিতে লাগিল
ঊরমিরা কোলাহল।
অধীর পবনে ছড়ায়ে পড়িল
কেশপাশ চারি ধার—
সাগরের কানে ঢালিতে লাগিনু
সুধীরে গীতের ধার!
গীত
কেন গো সাগর এমন চপল
এমন অধীরপ্রাণ,
শুন গো আমার গান
তবে শুন গো আমার গান!
পূরণিমানিশি আসিবে যখন
আসিবে যখন
ফিরে—
তার মেঘের ঘোমটা সরায়ে দিব গো
খুলিয়ে দিব গো ধীরে!
যত হাসি তার পড়িবে তোমার
বিশাল হৃদয়-'পরে,
কত আনন্দে ঊরমি জাগিবে তখন
নাচিবে পুলকভরে!
তবে থাম গো সাগর, থাম গো,
কেন হয়েছ অধীরপ্রাণ?
আমি লহরীশিশুরে করিব তোমার
তারার খেলেনা দান।
দিক্বালাদের বলিয়া দিব,
আঁকিবে তাহারা বসি
প্রতি ঊরমির মাথায় মাথায়
একটি একটি শশী।
তটিনীরে আমি দিব গো শিখায়ে
না হবে তাহার আন,
তারা গাহিবে প্রেমের গান,
তারা কানন হইতে আনিবে কুসুম
করিবে
তোমারে দান—
তারা হৃদয় হইতে শত প্রেমধারা
করাবে তোমারে পান!
তবে থাম গো সাগর, থাম গো,
কেন হয়েছ অধীরপ্রাণ?
যদি ঊরমিশিশুরা নীরব নিশীথে
ঘুমাতে নাহিক চায়,
তবে জানিও সাগর ব'লে দিব আমি
আসিবে
মৃদুল বায়—
কানন হইতে করিয়া তাহারা
ফুলের সুরভি পান
কানে কানে ধীরে গাহিয়া যাইবে
ঘুম পাড়াবার গান!
অমনি তাহারা ঘুমায়ে পড়িবে
তোমার বিশাল বুকে,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে দেখিবে তখন
চাঁদের স্বপন সুখে!
যদি কভু হয় খেলাবার সাধ
আমারে
কহিও তবে—
শতেক পবন আসিবে অমনি
হরষ-আকুল রবে—
সাগর-অচলে ঘেরিয়া ঘেরিয়া
হাসিয়া সফেন হাসি
মাথার উপরে ঢালিও তাহার
প্রবালমুকুতারাশি!
তবে রাখ গো আমার কথা,
তবে শুন গো আমার গান,
তবে থাম গো সাগর, থাম গো,
কেন হয়েছ অধীরপ্রাণ?
দেখ প্রবাল-আলয়ে সাগরবালা
গাঁথিতেছিল গো মুকুতামালা,
গাহিতেছিল গো গান,
আঁধার-অলক কপোলের শোভা
করিতেছিল গো পান!
কেহবা হরষে নাচিতেছিল
হরষে পাগল-পারা,
কেশপাশ হ'তে ঝরিতেছিল
নিটোল মুকুতাধারা!
কেহ মণিময় গুহায় বসিয়া
মৃদু অভিমানভরে
সাধাসাধি করে প্রণয়ী আসিয়া
একটি কথার তরে।
এমনি সময়ে শতেক ঊরমি
সহসা মাতিয়ে উঠেছে সুখে,
সহসা এমন লেগেছে আঘাত
আহা সে বালার কোমল বুকে!
ওই দেখ দেখ—
আঁচল হইতে
ঝরিয়া পড়িল মুকুতারাশি!
ওই দেখ দেখ— হাসিতে হাসিতে
চমক লাগিয়া ঘুচিল হাসি!
ওই দেখ দেখ— নাচিতে নাচিতে
থমকি দাঁড়ায় মলিনমুখে,
ওই দেখ বালা অভিমান ত্যজি
ঝাঁপায়ে পড়িল প্রণয়ীবুকে!
থাম গো সাগর, থাম গো— থাম গো
হোয়ো না অমন পাগল-পারা—
আহা, দেখ দেখি সাগরললনা
ভয়ে একেবারে হয়েছে সারা!
বিবরণ হয়ে গিয়েছে কপোল,
মলিন হইয়ে গিয়েছে মুখ,
সভয়ে মুদিয়া আসিছে নয়ন
থরথর করি কাঁপিছে বুক!
আহা, থাম তুমি থাম গো—
হোয়ো না অধীরপ্রাণ,
রাখ গো আমার কথা,
ওগো শোন গো আমার গান!
যদি না রাখ আমার কথা,
যদি না থামে প্রমোদ তব,
তবে জানিও সাগর জানিও
আমি সাগরবালারে কব।
তারা জোছনা-নিশীথে ত্যজিয়া আলয়
সাজিয়া মুকুতাবেশে
হাসি হাসি আর গাহিবে না গান
তোমার উপরে এসে।
যে রূপ হেরিয়া লহরীরা তব
হইতে পাগল-মত,
যে গানে মজিয়া কানন ত্যজিয়া
আসিত বায়ুরা যত।
আধখানি তনু সলিলে লুকান',
সুনিবিড় কেশরাশি
লহরীর সাথে নাচিয়া নাচিয়া
সলিলে পড়িত আসি,
অধীর ঊরমি মুখ চুমিবারে
যতন করিত কত,
নিরাশ হইয়া পড়িত ঢলিয়া
মরমে মিশায়ে যেত।
সে বালারা আর আসিবে না,
সে মধুর হাসি হাসিবে না,
জোছনায় মিশি সে রূপের ছায়া
সলিলে তোমার ভাসিবে না,
তবে থাম গো সাগর, থাম গো—
কেন হয়েছ অধীরপ্রাণ,
তুমি রাখ এ আমার কথা,
তুমি শোন এ আমার গান।
....
দেখিতে দেখিতে শতেক ঊরমি
সাগর-উরসে ঘুমায়ে এল,
দেখিতে দেখিতে মেঘেরা মিলিয়া
সুদূর শিখরে খেলাতে গেল।
যে মহাপবন সাগরহৃদয়ে
প্রলয়খেলায় আছিল রত,
অতি ধীরে ধীরে কপোল আমার
চুমিতে লাগিল প্রণয়ী-মত।
গীতরব মোর দ্বীপের কাননে
বহিয়া লইয়া গেল সে ধীরে—
"কে গায়" বলিয়া কাননবালারা
থামিতে কহিল পাপিয়াটিরে।
বীরেরে তখন লইয়া এলাম
অমরদ্বীপের কাননতীরে,
কুসুমশয়নে অচেতন দেহ
যতন করিয়া রাখিনু ধীরে।
চেতন পাইয়া উঠিল জাগিয়া,
অবাক্ রহিল চাহি,
পৃথিবীর স্মৃতি ঢাকিয়া ফেলিনু
মায়াময় গীত গাহি।
নূতন জীবন পাইয়া তখন
উঠিল সে বীর ধীরে,
সহসা আমারে দেখিতে পাইল
দাঁড়ায়ে সাগরতীরে।
নিমেষ হারায়ে চাহিয়া রহিল
অবাক্ নয়ন তার,
দেখিয়া দেখিয়া কিছুতেই যেন
দেখা ফুরায় না আর!
যেন আঁখি তার করিয়াছে পণ
এইরূপ এক ভাবে
নিমেষ না ফেলি চাহিয়া চাহিয়া
পাষাণ হইয়া যাবে।
রূপে রূপে যেন ডুবিয়া গিয়াছে
তাহার হৃদয়তল,
অবশ আঁখির পলক ফেলিতে
যেন রে নাইক বল!
কাছে গিয়া তার পরশিনু বাহু,
চমকি উঠিল হেন—
তিখিনী তিখিনী অশনি-সমান
বিঁধেছে যে দেহে শত শত বাণ,
নারীর কোমল পরশটুকুও
তার সহিল না যেন!
কাছে গেলে যেন পারে না সহিতে,
অভিভূত যেন পড়ে সে মহীতে,
রূপের কিরণে মন যেন তার
মুদিয়া ফেলে গো আঁখি,
সাধ যেন তার দেখিতে কেবল
অতিশয় দূরে থাকি !
নায়কের উক্তি
কি হ'ল গো, কি হ'ল আমার!
বনে বনে সিন্ধুতীরে বেড়াতেছি ফিরে ফিরে,
কি যেন হারান' ধন খুঁজি আনিবার!
সহসা ভুলিয়ে যেন গিয়েছি কি কথা!
এই মনে আসে-আসে, আর যেন আসে না সে,
অধীর-হৃদয়ে শেষে ভ্রমি হেথা হোথা!
এ কি হ'ল এ কি হ'ল ব্যথা!
সম্মুখে অপার সিন্ধু দিবস যামিনি
অবিশ্রাম কলতানে কি কথা বলে কে জানে,
লুকান' আঁধার প্রাণে কি এক কাহিনী।
সাধ যায় ডুব দিই, ভেদি গভীরতা
তল হ'তে তুলে আনি সে রহস্য কথা।
বায়ু এসে কি যে বলে পারি নে বুঝিতে
প্রাণ শুধু রহে গো যুঝিতে!
পাপিয়া একাকী কুঞ্জে কাঁপায় আকাশ,
শুনে কেন উঠে রে নিশ্বাস!
ওগো, দেবি, ওগো বনদেবি,
বল মোরে কি হয়েছে মোর!
কি ধন হারায়ে গেছে, কি সে কথা ভুলে গেছি,
হৃদয় ফেলেছে ছেয়ে কি সে ঘুমঘোর।
এ যে সব লতাপাতা হেরি চারি পাশে
এরা সব জানে যেন তবুও বলে না কেন!
আধখানি বলে, আর দুলে দুলে হাসে!
নিশীথে ঘুমাই যবে, কি যেন স্বপন হেরি,
প্রভাতে আসে না তাহা মনে,
কে পারে গো ছিঁড়ে দিতে এ প্রাণের আবরণ—
কি কথা সে রেখেছে গোপনে।
কি কথা সে!
এ হৃদয় অগ্নিগিরি দহিতেছে ধীরে ধীরে
কোন্ খানে কিসের হুতাশে!
অপ্সরার উক্তি
হ'ল না গো হ'ল না!
প্রেমসাধ বুঝি পূরিল না।
বল সখা, বল কি-করিব বল,
কী দিলে জুড়াবে হিয়া!
বাছিয়া বাছিয়া তুলিয়াছি ফুল,
তুলেছি গোলাপ, তুলেছি বকুল,
নিজ হাতে আমি রচেছি শয়ন
কমলকুসুম দিয়া।
কাঁটাগুলি সব ফেলেছি বাছিয়া,
রেণুগুলি ধীরে দিয়েছি মুছিয়া,
ফুলের উপরে গুছায়েছি ফুল
মনের মতন করি—
শীতল শিশির দিয়েছি ছিটায়ে
অনেক যতন করি।
হ'ল না গো হ'ল না!
প্রেমসাধ বুঝি পূরিল না!
শুন ওগো সখা, বনবালারে
দিয়েছি যে আমি বলি,
প্রতি শাখে শাখে গাইবে পাখী
প্রতি ফুলে ফুলে অলি।
দেখ চেয়ে দেখ বহিছে তটিনী,
বিমল তটিনী গো।
এত কথা তার রয়েছে প্রাণে,
বলিবারে চায় তটের কানে,
তবুও গভীর প্রাণের কথা
ভাষায় ফুটে নি গো!
দেখ হোথা ওই সাগর আসি
চুমিছে রজত বালুকারাশি,
দেখ হেথা চেয়ে চপল চরণে
চলেছে নিঝরধারা।
তীরে তীরে তার রাশি রাশি ফুল,
হাসি হাসি তারা হতেছে আকুল,
লহরে লহরে ঢলিয়া ঢলিয়া
খেলায়ে খেলায়ে হতেছে সারা।
হ'ল না গো হ'ল না,
প্রেম সাধ বুঝি পূরিল না।
তবে শুনিবে কি সখা গান?
তবে খুলিয়া দিব কি প্রাণ?
তবে চাঁদের হাসিতে নীরব নিশীথে
মিশাব ললিততান?
আমি গাব হৃদয়ের গান।
আমি গাব প্রণয়ের গান।
কভু হাসি কভু সজল নয়ন,
কভু বা বিরহ কভু বা মিলন,
কভু সোহাগেতে ঢল ঢল তনু
কভু মধু অভিমান।
কভু বা হৃদয় যেতেছে ফেটে,
সরমে তবুও কথা না ফুটে,
কভু বা পাষাণে বাধিয়া মরম
ফাটিয়া যেতেছে প্রাণ!
হ'ল না গো হ'ল না,
মনোসাধ আর পূরিল না।
এস তবে এস মায়ার বাঁধন
খুলে দিই ধীরে ধীরে—
যেথা সাধ যাও, আমি একাকিনী
ব'সে থাকি সিন্ধুতীরে।
গান
সোনার পিঞ্জর ভাঙিয়ে আমার
প্রাণের পাখীটি উড়িয়ে যাক্!
সে যে হেথা গান গাহে না,
সে যে মোরে আর চাহে না,
সুদূর কানন হইতে সে যে
শুনেছে কাহার ডাক,
পাখীটি উড়িয়ে যাক্!
মুদিত নয়ন খুলিয়ে আমার
সাধের স্বপন যায় রে যায়!
হাসিতে অশ্রুতে গাঁথিয়া গাঁথিয়া
দিয়েছিনু তার বাহুতে বাঁধিয়া,
আপনার মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ছিঁড়িয়া ফেলেছে হায় রে হায়!
সাধের স্বপন যায় রে যায়!
যে যায় সে যায় ফিরিয়ে না চায়,
যে থাকে সে শুধু করে হায় হায়,
নয়নের জল নয়নে শুকায়
মরমে লুকায় আশা।
বাঁধিতে পারে না আদরে সোহাগে,—
রজনী পোহায়, ঘুম হতে জাগে,
হাসিয়া কাঁদিয়া বিদায় সে মাগে—
আকাশে তাহার বাসা।
যায় যদি তবে যাক্,
একবার তবু ডাক্!
কি জানি যদি রে প্রাণ কাঁদে তার
তবে থাক্ তবে থাক্! |