ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


শৈশব সঙ্গীত


 

                প্রভাত
শুন     নলিনী, খোল গো আঁখি,
ঘুম     এখনো ভাঙ্গিল না কি!
দেখ,   তোমারি দুয়ার-'পরে
সখি        এসেছে তোমারি রবি।
শুনি,   প্রভাতের গাথা মোর
দেখ    ভেঙ্গেছে ঘুমের ঘোর,
দেখ    জগৎ উঠেছে নয়ন মেলিয়া
              নূতন জীবন লভি।
তবে   তুমি গো সজনি, জাগিবে না কি,
             আমি যে তোমারি কবি।
শুন         আমার কবিতা তবে,
আমি       গাহিব নীরব রবে
ভবে        নব জীবনের গান।
         প্রভাতজলদ, প্রভাতসমীর,
         প্রভাতবিহগ, প্রভাতশিশির
         সমস্বরে তারা সকলে মিলি
              মিশাবে মধুর তান!
         প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি,
              প্রতিদিন গান গাহি

        প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান
              ধীরে ধীরে উঠ চাহি।
        আজিও এসেছি চেয়ে দেখ দেখি,
              আর ত রজনী নাহি!
              শিশিরে মুখানি মাজি,
সখি         লোহিত বসনে সাজি,
দেখ    বিমল সরসী-আরসীর 'পরে
              অপরূপ রূপরাশি।
তবে   থেকে থেকে ধীরে নুইয়া পড়িয়া,
         নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া,
         ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া
                সরমের মৃদু হাসি।

             
কামিনী ফুল

ছি ছি সখা কি করিলে,          কোন্‌ প্রাণে পরশিলে
         কামিনীকুসুম ছিল বন আলো করিয়া

মানুষপরশ-ভরে                  শিহরিয়া সকাতরে
        ওই যে শতধা হয়ে পড়িল গো ঝরিয়া।
জান ত কামিনী সতী            কোমল কুসুম অতি
        দূর হ'তে দেখিবারে, ছুঁইবারে নহে সে

দূর হ'তে মৃদু বায়,              গন্ধ তার দিয়ে যায়,
        কাছে গেলে মানুষের শ্বাস নাহি সহে সে।
মধুপের পদক্ষেপে              পড়িতেছে কেঁপে কেঁপে,
        কাতর হতেছে কত প্রভাতের সমীরে!
পরশিতে রবিকর                শুকায়েছে কলেবর,
       শিশিরের ভরটুকু সহিছে না শরীরে।
হেন কোমলতাময়              ফুল কি না-ছুঁলে নয়!
       হায় রে কেমন বন ছিল আলো করিয়া!
মানুষপরশ-ভরে               শিহরিয়া সকাতরে,
      ওই যে শতধা হয়ে পড়িল গো ঝরিয়া!

                
লাজময়ী

কাছে তার যাই যদি           কত যেন পায় নিধি
        তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে, ফুটে না।
কখন বা মৃদু হেসে            আদর করিতে এসে
        সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না।
অভিমানে যাই দূরে,          কথা তার নাহি ফুরে,
        চরণ বারণ-তরে উঠে উঠে, উঠে না।
কাতর নিশ্বাস ফেলি           আকুল নয়ন মেলি
        চেয়ে থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না।
যখন ঘুমায়ে থাকি             মুখপানে মেলি আঁখি
        চাহি দেখে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না।
সহসা উঠিলে জাগি,          তখন কিসের লাগি
        মরমেতে ম'রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না!
লাজময়ি তোর চেয়ে          দেখি নি লাজুক মেয়ে
        প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু ছুটে না!
 

                প্রেমমরীচিকা
             রাগিণী ঝিঁঝিট-খাম্বাজ

ও কথা বোল' না তারে
      কভু সে কপট না রে,
         আমার কপালদোষে চপল সে জন!
অধীর হৃদয় বুঝি               শান্তি নাহি পায় খুঁজি,
        সদাই মনের মত করে অন্বেষণ!
        ভাল সে বাসিত যবে করে নি ছলনা।
মনে মনে জানিত সে          সত্য বুঝি ভালবাসে,
        বুঝিতে পারে নি তাহা যৌবনকল্পনা।
        হরষে হাসিত যবে হেরিয়ে আমায়
সে হাসি কি সত্য নয়?
     সে যদি কপট হয়
        তবে সত্য ব'লে কিছু নাহি এ ধরায়!
        স্বচ্ছ দর্পণের মত বিমল সে হাস
        হৃদয়ের প্রতি ছায়া করিত প্রকাশ।
তাহা কপটতাময়?
        কখনো কখনো নয়,
       কে আছে সে হাসি তার করে অবিশ্বাস।
ও কথা বোল'না তারে,       কভু সে কপট না রে,
       আমার কপাল-দোষে চপল সে জন

প্রেমমরীচিকা হেরি           ধায় সত্য মনে করি,
       চিনিতে পারে নি সে যে আপনার মন।

               
গোলাপবালা
             গোলাপের প্রতি বুল্‌বুল্‌
                  রাগিনী বেহাগ

বলি,      ও আমার গোলাপবালা,
বলি,      ও আমার গোলাপবালা,
         তোল মুখানি, তোল মুখানি,
                কুসুমকুঞ্জ কর আলা।
বলি,      কিসের সরম এত?
সখি,      কিসের সরম এত?
সখি,   পাতার মাঝারে লুকায়ে মুখানি
              কিসের সরম এত?
বালা,     ঘুমায়ে পড়েছে ধরা,
সখি,      ঘুমায় চাঁদিমা তারা,
প্রিয়ে,     ঘুমায় দিক্‌বালারা,
প্রিয়ে,     ঘুমায় জগত যত।
সখি,      বলিতে মনের কথা
বল        এমন সময় কোথা?
প্রিয়ে,  তোল মুখানি, আছে গো আমার
                 প্রাণের কথা কত!
আমি      এমন সুধীর স্বরে
সখি,      কহিব তোমার কানে,
প্রিয়ে   স্বপনের মত সে কথা আসিয়ে
                পশিবে তোমার প্রাণে,
আর    কেহ শুনিবে না, কেহ জাগিবে না,
         প্রেমকথা শুনি প্রতিধনিবালা
         উপহাস সখি করিবে না,
                পরিহাস সখি করিবে না।
তবে      মুখানি তুলিয়া চাও!
সুধীরে    মুখানি তুলিয়া চাও!
সখি,      একটি চুম্বন দাও!
গোপনে  একটি চুম্বন দাও!
সখি,      তোমারি বিহগ আমি,
বালা,     কাননের কবি আমি,
আমি      সরারাত ধ'রে, প্রাণ,
করিয়া    তোমারি প্রণয় গান
সুখে    সারাদিন ধ'রে গাহিব সজনি
                তোমারি প্রণয়গান!
সখি,     এখন মধুর স্বরে
আমি     গাহিব সে সব গান
দূরে   মেঘের মাঝারে আবরি তনু
              ঢালিব প্রেমের তান

তবে     মজিয়া সে প্রেমগানে,
সবে     চাহিবে আকাশপানে,
তারা    ভাবিবে গাইছে অপসর কবি
                প্রেয়সীর গুণগান।
তবে       মুখানি তুলিয়া চাও!
সুধীরে    মুখানি তুলিয়া চাও!
নীরবে    একটি চুম্বন দাও,
গোপনে  একটি চুম্বন দাও!

        
হরহৃদে কালিকা

কে তুই লো হরহৃদি অলো করি দাঁড়ায়ে,
ভিখারীর সর্ব্বত্যাগী বুকখানি মাড়ায়ে?
নাই হোথা সুখ-আশা, বিষয়ের কামনা,
নাই হোথা সংসারের
পৃথিবীর ভাবনা!
আছে শুধু এই রূপে বুকখানি ভরিয়ে

আছে শুধু ওই রূপে মনে মন মরিয়ে।
বুকের জলন্ত শিরে রক্তরাশি নাচায়ে,
পাষাণ পরাণখানি এখনও বাঁচায়ে,
নাচিছে হৃদয়মাঝে জ্যোতির্ম্ময়ী কামিনী,
শোণিততরঙ্গে ছুটে প্রস্ফুরিত দামিনী।
ঘুমায়েছে মনখানা, ঘুমায়েছে প্রাণ গো,
এক স্বপ্নে ভরা শুধু হৃদয়ের স্থান গো!
জগতে থাকিয়া আমি থাকি তার বাহিরে,
জগৎ বিদ্রূপছলে পাগল ভিখারী বলে

তাই আমি চাই হতে, আর কিবা চাহি রে!
ভিখারী করিব ভিক্ষা বাঘাম্বর পরিয়ে,
বিমোহন রূপখানি হৃদিমাঝে ধরিয়ে।
                  . . .
একদা প্রলয়শিঙ্গা বাজিয়া রে উঠিবে!
অমনি নিভিবে রবি, অমনি মিশাবে তারা,
অমনি এ জগতের রাশরজ্জু টুটিবে।
আলোকসর্ব্বম্ব হারা      অন্ধ যত গ্রহ তারা।
দারুণ উন্মাদ হয়ে মহাশূন্যে ছুটিবে!
ঘুম হ'তে জাগি উঠি রক্ত আঁখি মেলিয়া
প্রলয়, জগৎ লয়ে বেড়াইবে খেলিয়া।
প্রলয়ের তালে তালে ওই বামা নাচিবে,
প্রলয়ের তালে তালে এই হৃদি বাজিবে!
আঁধারকুন্তল তোর মহাশূন্য জুড়িয়া
প্রলয়ের কালঝড়ে বেড়াইবে উড়িয়া!
অন্ধকারে দিশাহারা কম্পমান গ্রহ তারা
চরণের তলে আসি পড়িবেক গুঁড়ায়ে,
দিবি সেই বিশ্বচূর্ণ নিঃশ্বাসেতে উড়ায়ে!
এমনি রহিব স্তব্ধ ওই মুখে চাহিয়া

দেখিব হৃদয়মাঝে      কেমনে ও বামা নাচে
উন্মাদিনী, প্রলয়ের ঘোর গীতি গাহিয়া!
জগতের হাহাকার যবে স্তব্ধ হইবে

ঘোর স্তব্ধ, মহাস্তব্ধ, মহাশূন্য রহিবে,
আঁধারের সিন্দুরবে অনন্তেরে গ্রাসিয়া

সে মহান্‌ জলধির নাই ঊর্ম্মি, নাই তীর

সেই স্তব্ধ সিন্ধু ব্যাপি রব আমি ভাসিয়া!
তখনো র'বি কি তুই এই বুকে দাঁড়ায়ে,
ভাবনাবাসনাহীন এই বুক মাড়ায়ে?