|  |                ভগ্নতরীগাথা
 প্রথম সর্গ
 
 ডুবিছে তপন, আসিছে আঁধার,
 দিবা হল অবসান—
 ঘুমায় সাঁঝের সাগর, করিয়া
 কনককিরণ পান।
 অলস লহরী তটের চরণে
 ঘুমে পড়িতেছে ঢুলি,
 এ উহার গায়ে পড়েছে এলায়ে
 ভাঙ্গাচোরা মেঘগুলি।
 কনকসলিলে লহরী তুলিয়া
 তরণী ভাসিয়া যায়—
 উড়িয়াছে পাল, নাচিছে নিশান,
 বহে অনুকূল বায়।
 শত কণ্ঠ হতে সাঁঝের আকাশে
 উঠিছে সুখের গীত,
 তালে তালে তার পড়িতেছে দাঁড়,
 ধ্বনিতেছে চারি ভিত।
 বাজিতেছে বীণা, বাজিতেছে বাঁশি,
 বাজিতেছে ভেরী কত—
 কেহ দেয় তালি, কেহ ধরে তান,
 কেহ নাচে জ্ঞানহত।
 তারকা উঠিছে ফুটিয়া ফুটিয়া,
 আকাশে উঠিছে শশী,
 উছলি উছলি উঠিছে সাগর
 জোছনা পড়িছে খসি।
 অতি নিরিবিলি, নিরালায় দেখ
 না মিশিয়া কোলাহলে
 ললিতা হোথায়, পতি সাথে তার
 বসি আছে গলে গলে।
 অজিতের গলে বাঁধি বাহুপাশ
 বুকেতে মাথাটি রাখি,
 ঢলঢল তনু, গল'গল' করা
 ঢুলুঢুলু দুটি আঁখি।
 আধো আধো হাসি অধরে জড়িত,
 সুখের নাহি যে ওর,
 প্রণয়বিভল প্রাণের মাঝারে
 লেগেছে ঘুমের ঘোর।
 পরশিছে দেহ    নিশীথের বায়ু
 অতি ধীর মৃদুশ্বাসে,
 লহরীরা আসি    করে কলরব
 তরণীর আশে-পাশে।
 মধুর মধুর     সকলি মধুর,
 মধুর আকাশ ধরা,
 মধুরজনীর    মধুর অধর
 মধু জোছনায় ভরা।
 যেতেছে দিবস, চলেছে তরণী
 অনুকূল বায়ুভরে।
 ছোট ছোট ঢেউ মাথাগুলি তুলি
 টলমল করি পড়ে।
 প্রণয়ীর কাল যেতেছে, তুলিয়া
 শত বরণের পাখা,
 মৃদুবায়ুভরে লঘু মেঘ যেন
 সাঁঝের-কিরণ-মাখা।
 আদরে ভাসিয়া গাহিছে অজিত
 চাহি ললিতার পানে
 মরম-গলানো সোহাগের গীত
 আবেশ-অবশ প্রাণে।—
 
 গান
 পাগলিনী তোর লাগি কি আমি করিব বল্?
 কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল!
 আদরের ধন তুমি      আদরে রাখিব আমি,
 আদরিণি, তোর লাগি পেতেছি এ বক্ষস্থল।
 আয় তোরে বুকে রাখি,     তুমি দেখ আমি দেখি—
 শ্বাসে শ্বাস মিশাইব আঁখিজলে আঁখিজল।
 
 হরষে কভু বা গাইছে ললিতা
 অজিতের হাত ধরি,
 মুখপানে তার চাহিয়া চাহিয়া
 প্রেমে আঁখি দুটি ভরি।—
 
 গান
 ওই কথা বল সখা, বল আর বার,
 ভালবাসো মোরে তাহা বল বার-বার!
 কতবার শুনিয়াছি     তবুও আবার যাচি,
 ভালোবাসো মোরে তাহা বল গো আবার!
 . . .
 সান্ধ্য দিক্বধূ স্তব্ধ ভয়ভারে,
 একটি নিশ্বাস পড়ে না তার;
 ঈশান-গগনে করিছে মন্ত্রণা
 মিলিয়া অযুত জলদভার।
 তড়িতছুরিতে বিঁধিয়া বিঁধিয়া
 ফেলিছে আঁধারে শতধা করি,
 দূর ঝটিকার রথচক্ররব
 ঘোষিছে অশনি ত্রিলোক ভরি।
 সহসা উঠিল ঘোর গরজন,
 প্রলয়ঝটিকা আসিছে ছুটে।
 ছিন্ন মেঘজাল দিগ্বিদিকে ধায়,
 ফেনিল তরঙ্গ আকুলি উঠে।
 পাগলের মত তরীযাত্রী যত
 হেথা হোথা ছুটে তরণী-'পরে—
 ছিঁড়িতেছে কেশ,হানিতেছে বুক,
 করে হাহাকার কাতর স্বরে!
 ছিন্ন-তার বীণা যায় গড়াগড়ি,
 অধীরে ভাঙ্গিয়া ফেলেছে বাঁশি—
 ঝটিকার স্বর দিতেছে ডুবায়ে
 শতেক কণ্ঠের বিলাপরাশি।
 তরণীর পাশে নীরব অজিত,
 ললিতা অবাক্-হিয়া
 মাথাটি রাখিয়া অজিতের কাঁধে
 রহিয়াছে দাঁড়াইয়া।
 কি ভয় মরণে, এক সাথে যবে
 মরিবে দুজনে মিলি?
 মুকুতাশয়নে সাগরের তলে
 ঘুমাইবে নিরিবিলি!
 দুইটি প্রণয়ী বাঁধা গলে গলে
 কাছাকাছি পাশাপাশি,
 পশিবে না সেথা দ্বেষ কোলাহল,
 কুটিল কঠোর হাসি।
 ঝটিকার মুখে হীনবল তরী
 করিতেছে টলমল্—
 উঠিছে, নামিছে আছাড়ি পড়িছে,
 ভিতরে পশিছে জল।
 বাঁধিল ললিতা অজিতের বাহু
 দৃঢ়তর বাহুডোরে,
 আদরে অজিত ললিতা-অধর
 চুমিল হৃদয় ভ'রে।
 ললিতা-কপোলে বাহিয়া পড়িল
 নয়নের জল দুটি—
 নবীন সুখের স্বপন, হায় রে,
 মাঝখানে গেল টুটি।
 "আয় সখি আয়" কহিল অজিত—
 হাত ধরাধরি করি
 দুজনে মিলিয়া ঝাঁপায়ে পড়িল
 আকুল সাগর-'পরি।
 
 দ্বিতীয় সর্গ
 নবরবি সুবিমল কিরণ ঢালিয়া
 নিশার আঁধাররাশি ফেলিল ক্ষালিয়া।
 ঝটিকার অবসানে প্রকৃতি সহাস,
 সংযত করিছে তার এলোথেলো বাস।
 খেলায়ে খেলায়ে শ্রান্ত সারাটি যামিনী,
 মেঘকোলে ঘুমাইয়া পড়েছে দামিনী।
 থেকে থেকে স্বপনেতে চমকিয়া চায়,
 ক্ষীণ হাসিখানি হেসে আবার ঘুমায়।
 শান্ত লহরীরা এবে শ্রান্ত পদক্ষেপে
 তীর-উপলের 'পরে পড়ে কেঁপে কেঁপে।
 দ্বীপের শৈলের শির প্লাবিত করিয়া,
 অজস্র কনকধারা পড়িছে ঝরিয়া।
 মেঘ, দ্বীপ, জল, শৈল, সব সুরঞ্জিত—
 সমস্ত প্রকৃতি গায় স্বর্ণ-ঢালা গীত।
 বহু দিন হতে এক ভগ্নতরী জন
 করিছে বিজন দ্বীপে জীবনযাপন।
 বিজনতাভারে তার অবসন্ন বুক,
 কত দিনে দেখে নাই মানুষের মুখ।
 এত দিন মৌন আছে না পেয়ে দোসর,
 শুনিলে চমকি উঠে আপনার স্বর।
 সুরেশ প্রভাতে আজি ছাড়িয়া কুটীর
 ভ্রমিতে ভ্রমিতে এল সাগরের তীর।
 বিমল প্রভাতে আজি শান্ত সমীরণ
 ধীরে ধীরে করে তার দেহ আলিঙ্গন।
 নীরবে ভ্রমিছে কত— 
		একি রে— 
		একি রে —
 সুমুখে কি দেখিতেছি সাগরের তীরে?
 রূপসী ললনা এক রয়েছে শয়ান,
 প্রভাতকিরণ তার চুমিছে বয়ান—
 মুদিত নয়ন দুটি, শিথিলিত কায়,
 সিক্ত কেহ এলোথেলো শুভ্র বালুকায়।
 প্রতিক্ষণে লহরীরা ঢলিয়া বেলায়
 এলানো কুন্তল ল'য়ে কত না খেলায়!
 বহু দিন পরে যথা কারামুক্ত জন
 হর্ষে অধীরিয়া উঠে হেরিয়া তপন,
 বহু দিন পরে হেরি মানুষের মুখ
 উচ্ছ্বসি উঠিল সুখে সুরেশের বুক।
 দেখিল এখনো বহে নিশ্বাসসমীর,
 এখনো তুষারহিম হয় নি শরীর।
 যতনে লইল তারে বাহুতে তুলিয়া,
 কেশপাশ চারি পাশে পড়িল খুলিয়া।
 সুকুমার মুখখানি রাখি স্কন্ধোপরে,
 দ্রুত পদে প্রবেশিল কুটীরভিতরে।
 কতক্ষণ-পরে তবে লভিয়া চেতন
 ললিতা সুধীরে অতি মেলিল নয়ন।
 দেখিল যুবক এক রয়েছে আসীন,
 বিশাল নয়ন তার নিমেষবিহীন—
 কুঞ্চিত কুন্তলরাশি গৌর গ্রীবা-'পরে
 এলাইয়া পড়ি আছে অতি অনাদরে।
 চমকি উঠিল বালা বিসময়ে বিহ্বল,
 সরমে সম্বরে তার শিথিল অঞ্চল।
 ভয়েতে অবশ দেহ, দুরু দুরু হিয়া—
 আকুল হইয়া কিছু না পায় ভাবিয়া।
 সহসা তাহার মনে পড়িল সকলি—
 সহসা উঠিল বসি নববলে বলী।
 সুরেশের মুখপানে চাহিয়া চাহিয়া
 পাগলের মত বালা উঠিল কহিয়া,
 "কেন বাঁচাইলে মোরে কহ মোরে কহ—
 দুই প্রণয়ীর কেন ঘটালে বিরহ?
 অনন্ত মিলন যবে হইল অদূর—
 দ্বার হতে ফিরাইয়া আনিলে নিষ্ঠুর!
 দায় কর একটুকু দুখিনীর প্রতি,
 দিও না তাপসবর বাধা এক রতি—
 মরিব— 
		নিভাব প্রাণ সাগরের জলে,
 মিলিব সখার সাথে নীলসিন্ধুতলে,
 উপরে উঠিবে ঝড়, উর্ম্মি শৈলাকার,
 নিমেন কিছু পশিবে না কোলাহল তার!"
 
 তৃতীয় সর্গ
 মরমের ভার বহি           
		দারুণ যাতনা সহি
 ললিতা সে কাটাইছে দিন।
 নয়নে নাই সে জ্যোতি     হৃদয় অবশ অতি,
 শরীর হইয়া গেছে ক্ষীণ।
 আলুথালু কেশপাশ,        বাঁধিতে নাহিক 
		আশ,
 উড়িয়া পড়িছে থাকি থাকি।
 কি করুণ মুখখানি,        একটি নাইক 
		বাণী,
 কেঁদে কেঁদে-শ্রান্ত দুটি আঁখি।
 যে দিকে চরণ ধায়,       সে দিকে চলেছে হায়,
 কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাই মনে।
 গাছের কাঁটার ধার,       ছিঁড়িছে আঁচল তার,
 লতাপাশ বাঁধিছে চরণে।
 একাকী আপনমনে       ভ্রমিতে ভ্রমিতে বনে
 যাইত সে তটিনীর তীরে—
 লতায় পাতায় গাছে      আঁধার করিয়া আছে,
 সেইখানে শুইত সুধীরে।
 জলকলরবরাশি,          
		প্রাণের ভিতরে আসি
 ঢালিত কি বিষাদের ধারা!
 ফাটিয়া যাইত বুক,      বাহুতে ঢাকিয়া মুখ
 কাঁদিয়া কাঁদিয়া হ'ত সারা।
 কাননশৈলের পায়ে,     মধ্যাহ্নে গাছের ছায়ে
 মলিন অঞ্চলে রাখি মাথা
 কত কি ভাবিত হায়,     উচ্ছ্বসি উঠিত বায়,
 ঝরিয়া পড়িত শুষ্ক পাতা।
 গভীর নীরব রাতে        উঠিয়া শৈলের 
		মাথে
 বসিয়া রহিত একাকিনী—
 তারা-পানে চেয়ে চেয়ে,   কত-কি ভাবিত মেয়ে,
 পড়িত কি বিষাদকাহিনী!
 কি করিলে ললিতার        ঘুচিবে হৃদয়ভার
 সুরেশ না পাইত ভাবিয়া—
 কাতর হইয়া কত যুবা তারে শুধাইত,
 আগ্রহে অধীর তার হিয়া—
 "রাখ কথা, শুন সখি,     একবার বল দেখি
 কি করিব তোমার লাগিয়া?
 কি চাও, কি দিব বালা,     বল গো কিসের জ্বালা?
 কি করিলে জুড়াবে ও হিয়া?"
 করুণ মমতা পেয়ে         সুরেশের 
		মুখ চেয়ে
 অশ্রু উচ্ছ্বসিত দরদরে—
 ললিতা কাতর রবে        রুদ্ধকণ্ঠে কহে 
		তবে,
 "সখা গো ভেব না মোর তরে!
 আমারে দিও না দেখা,     বিজনে রহিব একা
 বিজনেই নিপাতিব দেহ।
 এ দগ্ধ জীবন মোর,       কাঁদিয়া করিব ভোর,
 জানিতেও পারিবে না কেহ!"
 সুরেশ ব্যথিতহিয়া,        একেলা বিজনে 
		গিয়া
 ভাবিত, কাঁদিত আনমনে—
 প্রাণপণ করি তার         তবুও ত 
		ললিতার
 পারিল না অশ্রুবিমোচনে।
 সুরেশ প্রভাতে উঠি       সারাটি কানন লুটি
 তুলিয়া আনিত ফুলভার,
 ফুলঙ্গলি বাছি বাছি       গাঁথি লয়ে 
		মালাগাছি
 ললিতারে দিত উপহার।
 নির্ঝরে লইত জল,       তুলিয়া আনিত ফল
 আহারের তরে বালিকার।
 যতন করিয়া কত        পর্ণশয্যা বিছাইত,
 গুছাইত ঘরখানি তার।
 . . .
 শীতের তীব্রতা সহি,       তপনকিরণে দহি
 করিয়া শতেক অত্যাচার,
 মনের ভাবনা-ভরে        অবসন্ন কলেবরে
 পীড়া অতি হল ললিতার।
 অনলে দহিছে বুক,        শুকায়ে যেতেছে 
		মুখ,
 শুষ্ক অতি রসনা তৃষায়—
 নিশ্বাস অনলময়,           
		শয্যা অগ্নি মনে হয়,
 ছটফট করে যাতনায়।
 ত্যজিয়া আহার পান       সারা-রাত্রি-দিনমান
 সুরেশ করিছে তার সেবা,
 তৃষার্ত্ত অধরে তার          
		ঢালিছে সলিলধার,
 ব্যজন করিছে রাত্রি দিবা।
 নিশীথে সে রুগ্নঘরে        একটি 
		শিলার-'পরে
 দীপশিখা নিভ'নিভ' বায়ে—
 জ্যোতি অতি ক্ষীণতর,      দু পা হয়ে অগ্রসর
 অন্ধকারে যেতেছে হারায়ে।
 আকুল নয়ন মেলি           
		কাতর নিশ্বাস ফেলি,
 একটিও কথা না কহিয়া,
 শিয়রের সন্নিধানে           
		সুরেশ সে মুখপানে
 একদৃষ্টে রহিত চাহিয়া।
 বিকারে ললিতা যত       বকিত পাগল-মত,
 ছটফট করিত শয়ানে—
 ততই সুরেশ-হিয়া        উঠিত গো 
		ব্যাকুলিয়া,
 অশ্রুধারা পূরিত নয়নে।
 যখনি চেতনা পেয়ে,      ললিতা উঠিত চেয়ে,
 দেখিত সে শিয়রের কাছে
 মলানমুখ করি নত        নিস্তব্ধ ছবির 
		মত
 সুরেশ নীরবে বসি আছে।
 মনে তার হত তবে,      এ বুঝি দেবতা হবে,
 অসহায়া অবলা বালারে
 করুণাকোমল প্রাণে      এ ঘোর বিজন স্থানে
 রক্ষা করে নিশার আঁধারে।
 অশ্রুধারা দরদরি        কপোলে পড়িত 
		ঝরি,
 সুরেশের ধরি হাতখানি
 কৃতজ্ঞতাপূর্ণ প্রাণে,     আঁখি তুলি মুখপানে
 নীরবে কহিত কত বাণী!
 রোগের অনলজ্বালা      সহিতে না পারি বালা
 করিতে সে এ-পাশ ও-পাশ,
 হেরিয়ে করুণাময়       সুরেশের আঁখিদ্বয়
 অনেক যাতনা হ'ত হ্রাস।
 ফল-মূল-অন্বেষণে      যুবা যবে যেত বনে
 একেলা ঠেকিত ললিতার।
 চাহিত উৎসুকহিয়া      প্রতি শব্দে চমকিয়া,
 সমীরণে নড়িলে দুয়ার।
 বনে বনে বিহরিয়া      ফুল ফল আহরিয়া
 সুরেশ আসিত যবে ফিরে—
 আঁখি পাতা বিমুদিত     অতি মৃদু উঠাইত,
 হাসিটি উঠিত ফুটি ধীরে।
 দিন রাত্রি নাহি মানি     বনৌষধি তুলি আনি
 সুরেশ করিছে সেবা তার।
 রোগ চলি গেল ধীরে,     বল ক্রমে পেলে ফিরে,
 সুস্থ হল দেহ ললিতার।
 রোগশয্যা তেয়াগিয়া      মুক্ত সমীরণে গিয়া,
 মনসুখে বনে বনে ফিরি
 পাখীর সঙ্গীত শুনি       সিন্ধুর তরঙ্গ গুনি
 জীবনে জীবন এল ফিরি।
 
 চতুর্থ 
		সর্গ
 বসন্তসমীর আসি, কাননের কানে কানে
 প্রাণের উচ্ছ্বাস ঢালে নব যৌবনের গানে।
 এক ঠাঁই পাশাপাশি ফুটে ফুল রাশি রাশি—
 গলাগলি ফুলে ফুলে, গায়ে গায়ে ঢলাঢলি।
 খেলি প্রতি ফুল-’পরে সুরভিরাশির ভরে
 শ্রান্ত সমীরণ পড়ে প্রতি পদে টলি টলি।
 কোথায় ডাকিছে পাখী, খুঁজিয়া না পায় আঁখি—
 বনে বনে চারি দিকে হাসিরাশি বাদ্যগান।
 দুরগম শৈল যত, ঢাকা লতা গুলেম শত
 তাদের হরিত হৃদে তিল মাত্র নাই স্থান।
 ললিতার আঁখি হতে শুকায়েছে অশ্রুধার,
 বসন্তগীতের সাথে বাজিছে হৃদয় তার।
 পুরাণো পল্লব ত্যজি নবকিশলয়ে যথা
 চারি দিকে বনে বনে সাজিয়াছে তরুলতা,
 তেমনি গো ললিতার হৃদয়লতাটি ঘিরে
 নবীন হরিতপ্রেম বিকশিছে ধীরে ধীরে।
 ললিতা সে সুরেশের হাতে হাত জড়াইয়া
 বসন্তহসিত বনে,     ভ্রমিত হরষমনে,
 করুণ চরণক্ষেপে ফুলরাশি মাড়াইয়া।
 একটি দুর্গম শৈল সাগরের পড়েছে ঝুঁকি—
 অতি ক্লেশে সেথা উঠি বসিয়া রহিত দুটি,
 সায়াহ্নকিরণ জলে করিত গো ঝিকিমিকি।
 লহরীরা শৈল-'পরে, শৈবালগুলির তরে
 দিন রাত্রি খুদিতেছে নিকেতন শিলাসার।
 ফুল-ভরা গুল্মগুলি সলিলে পড়েছে ঝুলি,
 তরঙ্গের সাথে সাথে ওঠে পড়ে শতবার।
 বিভলা মেদিনীবালা জোছনামদিরা-পানে,
 হাসিছে সরসীখানি কাননের মাঝখানে,
 সুরেশ যতনে অতি বাঁধি তরুশাখাগুলি
 নৌকা নিরমিয়া এক সরসে দিয়াছে খুলি—
 চড়ি সে নৌকার 'পরে,  জ্যোৎস্নাসুপ্ত 
		সরোবরে
 সুরেশ মনের সুখে ভ্রমিত গো ফিরি ফিরি,
 ললিতা থাকিত শুয়ে কোলে তার মাথা থুয়ে,
 কখন বা মধুমাখা গান গেয়ে ধীরি ধীরি।
 কখন বা সায়াহ্নের বিষণ্ণ কিরণজালে,
 অথবা জোছনা যবে কাঁপে বকুলের ডালে,
 মৃদু মৃদু বসন্তের স্নিগ্ধ সমীরণ লাগি,
 সহসা ললিতাহৃদি আকুলি উঠিত যদি,
 সহসা দুয়েক কথা স্মরণে উঠিত জাগি,
 সহসা একটি শ্বাস বাহিরিত আনমনে,
 দুইটি অশ্রুর রেখা দেখা দিত দুনয়নে—
 অমনি সুরেশ আসি ধরি তার মুখখানি
 কহিত করুণ স্বরে কত আদরের বাণী।
 মুছাইত আঁখিধারা যতন করিয়া অতি,
 শরতমেঘের মত হৃদয়-আঁধার যত
 মূহূর্ত্তে ছুটিত আর ফুটিত হাসির জ্যোতি।
 অমনি সে সুরেশের কাঁধে মুখ লুকাইয়া
 আধো কাঁদি আধো হাসি হৃদয়ের ভাররাশি
 সোহাগের পারাবারে দিত সব বিসর্জিয়া।
 
 পঞ্চম সর্গ
 নারিকেল-তরুকুঞ্জে বসিয়া দোঁহায়
 একদা সেবিতেছিল প্রভাতের বায় 
		—
 সহসা দেখিল চাহি     প্রাণপণে দাঁড় বাহি
 তরণী আসিছে এক সে দ্বীপের পানে,
 দেখিয়া দোঁহার হিয়া     উঠিল গো উথলিয়া
 বিস্ময়হরষ আর নাহি ধরে প্রাণে!
 হরষে ভাবিল দোঁহে দেশে যাবে ফিরে,
 কুটীর বাঁধিবে এক বিপাশার তীরে।
 দুখ শোক ভুলি গিয়া     একত্রে দুইটি হিয়া
 সুখে জীবনের পথে করিবে ভ্রমণ,
 একত্রে দেখিবে দোঁহে সুখের স্বপন।
 
 উঠিল তরণী-'পরে,        অনুকুলবায়ুভরে
 স্বদেশে 
		করিল আগমন—
 বাঁধিয়া পরণশালা          না 
		জানিয়া কোন্ জ্বালা
 করিতেছে 
		জীবনযাপন।
 নির্ঝর কানন নদী          
		দ্বীপের কুটীর যদি
 তাহাদের পড়িত 
		স্মরণে,
 দুটিতে মগন হয়ে         অতীতের 
		কথা লয়ে
 ফুরাতে নারিত 
		সারাক্ষণে।
 আধ' ঘুমঘোরে প্রাতে,     পল্লবমর্ম্মর-সাথে
 শুনি বিপাশার 
		কলস্বর—
 স্বপনে হইত মনে          দূর 
		সে দ্বীপের বনে
 শুনিতেছে 
		নির্ঝরঝর্ঝর!
 দ্বীপের কুটীরখানি          
		কল্পনায় মনে আনি
 ভাবিত সে 
		শূন্য আছে পড়ি,
 ভগ্ন ভিতে উঠে লতা,      গৃহসজ্জা হেথা হোথা
 প্রাঙ্গণে 
		যেতেছে গড়াগড়ি,
 হয়ত গো কাঁটাগাছে        এত দিনে 
		ঘিরিয়াছে
 ললিতার সাধের 
		কানন—
 এত দিনে শাখা জুড়ি       ফুটেছে মালতীকুঁড়ি
 দেখিবার নাই কোন জন।
 সেই যে শৈলেতে উঠি      বসিয়া রহিত দুটি,
 নারিকেলকুঞ্জটির 
		কাছে—
 চারি দিকে শিলারাশি,       ছড়াছড়ি পাশাপাশি
 তাহারা তেমনি রহিয়াছে।
 মজিয়া কল্পনামোহে,       কত কি ভাবিত দোঁহে,
 মাঝে মাঝে উঠিত নিশ্বাস,
 অতীত আসিত ফিরে,      গায়ে যেন ধীরে ধীরে
 লাগিত সে দ্বীপের বাতাস।
 একদা চাঁদিনী রাতি,       দুজনে প্রমোদে 
		মাতি
 গেছে এক বিজন কাননে—
 ভ্রমিতে ভ্রমিতে তথা,       কহিতে কহিতে কথা
 কত দূরে গেল আন্মনে।
 সহসা যে বিভাবরী,        আইল আঁধার করি—
 গগনে উঠিল মেঘরাশি,
 পথ নাহি দেখা যায়,       ক্ষণে ক্ষণে ঝলকায়
 বিদ্যুতের পরিহাসহাসি।
 প্রতি ব্রজগরজনে,          
		ললিতা শঙ্কিতমনে
 সুরেশে জড়ায় দৃঢ়তর।
 অবসন্ন পদ তায়,         প্রতি পদে 
		বাধা পায়,
 তরাসেতে তনু থর থর।
 ঝলিল বিদ্যুৎ-শিখা,       ভগ্ন এক অট্টালিকা
 অদূরেতে প্রকাশিল তথা—
 কক্ষ এক হতে তার,      মুমূর্ষু আলোকধার
 কহে কি রহস্যময় কথা!
 চলিল আলয়-পানে,      দোঁহে আশ্বাসিত প্রাণে,
 সহসা জাগিল নীরবতা—
 উঠিল সঙ্গীতস্বর,         বালার 
		হৃদয়-'পর
 প্রবেশিল দু-একটি কথা—
 "পাগলিনী, তোর লাগি কি আমি করিব বল্।
 কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল।"
 কাঁপিছে বালার বুক,      নীল হয়ে গেছে মুখ,
 কপোলে বহিছে ঘর্ম্মজল—
 ঘুরিছে মস্তক তার,         চরণ 
		চলে না আর,
 শরীরে নাইক বিন্দুবল।
 তবুও অবশমনে           
		অলক্ষিত আকর্ষণে
 চলিল সে ভীষণ আলয়ে—
 অঙ্গন হইয়া পার         খুলি এক 
		জীর্ণ দ্বার
 গৃহে পদার্পিল ভয়ে ভয়ে।
 ভগ্ন ইষ্টকের 'পরে,      দীপ মিট্ মিট্ করে,
 বিদ্যুৎ ঝলকে বাতায়নে—
 ভেদি গৃহভিত্তি যত,     বটমূল শত শত
 হেথা হোথা পড়িছে নয়নে।
 বিছানো শুকানো পাতা,    শুয়ে আছে রাখি মাথা,
 পুরুষ একটি শ্রান্তকায়—
 অতি শীর্ণদেহ তার,        এলোথেলো 
		জটাভার,
 মুখশ্রী বিবর্ণ অতি ভায়।
 জ্যোতিহীন নেত্র তাঁর,      পাতাটিও তুলিবার
 নাই যেন আঁখির শকতি—
 দ্বারে শুনি পদধ্বনি         
		হৃদয়ে বিসময় গণি
 তুলে মুখ ধীরে ধীরে অতি।
 সহসা নয়নে তার জ্বলিল অনল,
 সহসা মুহূর্ত্ততরে দেহে এল বল।
 "ললিতা" "ললিতা" বলি করিয়া চীৎকার—
 দু-পা হয়ে অগ্রসর কম্পবান কলেবর
 শ্রান্ত হয়ে ভুমিতলে পড়িল আবার।
 করুণ নয়নে অতি      ললিতা-মুখের প্রতি
 অজিত রহিল স্তব্ধ একদষ্টে চাহি 
		—
 দীপশিখা অতি স্থির,    স্তব্ধ গৃহ সুগভীর
 চারি দিকে একটুকু সাড়াশব্দ নাহি।
 দুই হাতে আঁখি চাপি,     থর থর কাঁপি কাঁপি
 মূর্চ্ছিয়া ললিতা বালা পড়িল অমনি!
 বাহিরে উঠিল ঝড়, গর্জ্জিল অশনি—
 জীর্ণ গৃহ কাঁপাইয়া     ভগ্ন বাতায়ন দিয়া
 প্রবেশিল বায়ুচ্ছ্বাস গৃহের মাঝারে,
 নিভিল প্রদীপ, গৃহ পূরিল অঁধারে।
 |