ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সন্ধ্যসংগীত

 


 

            পরিত্যক্ত

চলে গেল, আর কিছু নাই কহিবার।
চলে গেল, আর কিছু নাই গাহিবার।
শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে
    দীনহীন হৃদয় আমার, শুধু বলিতেছে,
"চলে গেল সকলেই চলে গেল গো,
বুক শুধু ভেঙে গেল দলে গেল গো। "

বসন্ত চলিয়া গেলে বর্ষা কেঁদে কেঁদে বলে,
    "ফুল গেল, পাখি গেল

আমি শুধু রহিলাম, সবই গেল গো। "
দিবস ফুরালে রাতি স্তব্ধ হয়ে রহে,
      শুধু কেঁদে কহে,
"দিন গেল, আলো গেল, রবি গেল গো

কেবল একেলা আমি, সবই গেল গো ।"

উত্তরবায়ুর সম      প্রাণের বিজনে মম
      কে যেন কাঁদিছে শুধু
      "চলে গেল, চলে গেল,
       সকলেই চলে গেল গো।"

উৎসব ফুরায়ে গেলে   ছিন্ন শুষ্ক মালা
     পড়ে থাকে হেথায় হোথায়

তৈলহীন শিখাহীন ভগ্ন দীপগুলি
          ধুলায় লুটায়

একবার ফিরে কেহ দেখে নাকো ভুলি,
           সবে চলে যায়।

পুরানো মলিন ছিন্ন বসনের মতো
        মোরে ফেলে গেল,
কাতর নয়নে চেয়ে রহিলাম কত

        সাথে না লইল।
 

তাই প্রাণ গাহে শুধু, কাঁদে শুধু, কহে শুধু,
       "মোরে ফেলে গেল,
সকলেই মোরে ফেলে গেল,
      সকলেই চলে গেল গো।"

একবার ফিরে তারা চেয়েছিল কি ?
        বুঝি চেয়েছিল।
একবার ভুলে তারা কেঁদেছিল কি ?
        বুঝি কেঁদেছিল।
        বুঝি ভেবেছিল

লয়ে যাই নিতান্ত কি একেলা কাঁদিবে ?
       তাই বুঝি ভেবেছিল।
       তাই চেয়েছিল।

       তার পরে ? তার পরে !
       তার পরে বুঝি হেসেছিল।
একফোঁটা অশ্রুবারি মুহূর্তেই শুকাইল।
       তার পরে ? তার পরে !
               চলে গেল।
       তার পরে ? তার পরে !
ফুল গেল, পাখি গেল, আলো গেল, রবি গেল,
      সবই গেল, সবই গেল গো 

      হৃদয় নিশ্বাস ছাড়ি কাঁদিয়া কহিল,
      "সকলেই চলে গেল গো,
       আমারেই ফেলে গেল গো।"


সুখের বিলাপ

অবশ নয়ন নিমীলিয়া
সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া,
"এমন জোছনা সুমধুর,
বাঁশরি বাজিছে দূর দূর,
লেগেছে মৃদুল, ঘুমঘোর।
নদীতে উঠেছে মৃদু ঢেউ,
গাছেতে নড়িছে মৃদু পাতা,
লতায় ফুটিয়া ফুল দুটি
পাতায় লুকায় তার মাথা
মলয় সুদূর বনভূমে
কাঁপায়ে গাছের ছায়াগুলি
লাজুক ফুলের মুখ হতে
ঘোমটা দিতেছে খুলি খুলি।
এমন মধুর রজনীতে
     একেলা রয়েছি বসিয়া,
যামিনীর হৃদয় হইতে
      জোছনা পড়িছে খসিয়া। "

হৃদয়ে একেলা শুয়ে শুয়ে
সুখ শুধু এই গান গায়,
" নিতান্ত একেলা আমি যে
কেহ, কেহ, কেহ নাই হায়। "
আমি তারে শুধাইনু গিয়া,
" কেন, সুখ, কার কর আশা ?"
সুখ শুধু কাঁদিয়া কহিল,
" ভালোবাসা, ভালোবাসা গো।
সকলি, সকলি হেথা আছে

কুসুম ফুটেছে গাছে গাছে,
আকাশে তারকা রাশি রাশি,
জোছনা ঘুমায় হাসি হাসি।
সকলি, সকলি হেথা আছে 

সেই শুধু, সেই শুধু নাই,
ভালোবাসা নাই শুধু কাছে। "

   অবশ নয়ন নিমীলিয়া
   সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া,
" এই তটিনীর ধারে, এই শুভ্র জোছ্‌নায়,
এই কুসুমিত বনে, এই বসন্তের বায়,
   কেহ মোর নাই একেবারে,
   তাই সাধ গেছে কাঁদিবারে।
   তাই সাধ যায় মনে মনে

   মিশাব এ যামিনীর সনে,
   কিছুই রবে না আর প্রাতে,
   শিশির রহিবে পাতে পাতে।
   সাধ যায় মেঘটির মতো
   কাঁদিয়া মরিয়া গিয়া আজি
   অশ্রুজলে হই পরিণত । "

   সুখ বলে, " এ জন্ম ঘুচায়ে
   সাধ যায় হইতে বিষাদ। "
   " কেন সুখ, কেন হেন সাধ ?"
   " নিতান্ত একা যে আমি গো
   কেহ যে, কেহ যে নাই মোর । "
   " সুখ, কারে চায় প্রাণ তোর ?
   সুখ, কার করিস রে আশা ?"
   সুখ শুধু কেঁদে কেঁদে বলে,
   " ভালোবাসা, ভালোবাসা গো। "

 


             হৃদয়ের গীতিধ্বনি

ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার ?
শীত নাই গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত শরৎ নাই,
দিন নাই রাত্রি নাই
  অবিরাম অনিবার
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার ?
বিরলে বিজন বনে      বসিয়া আপন মনে
ভূমি-পানে চেয়ে চেয়ে, একই গান গেয়ে গেয়ে

দিন যায়, রাত যায়, শীত যায়,  গ্রীষ্ম যায়,
          তবু গান ফুরায় না আর ?

মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকানো ফুল,
পড়িছে শিশিরকণা, পড়িছে রবির কর,
পড়িছে বরষা-জল ঝরঝর ঝরঝর,
কেবলি মাথার 'পরে করিতেছে সমস্বরে
বাতাসে শুকানো পাতা মরমর মরমর

বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে একই গান একই গান একই গান।

পারি নে শুনিতে আর একই গান একই গান।
কখন থামিবি তুই, বল্‌ মোরে বল্‌ প্রাণ !
      একেলা ঘুমায়ে আছি

      সহসা স্বপন টুটি
      সহসা জাগিয়া উঠি
      সহসা শুনিতে পাই
          হৃদয়ের এক ধারে
      সেই স্বর ফুটিতেছে,
      সেই গান উঠিতেছে

      কেহ শুনিছে না যবে
      চারি দিকে স্তব্ধ সবে
সেই স্বর সেই গান অবিরাম অবিশ্রাম
অচেতন আঁধারের শিরে শিরে চেতনা সঞ্চারে ।

দিবসে মগন কাজে, চারি দিকে দলবল,
       চারি দিকে কোলাহল।
সহসা পাতিলে কান   শুনিতে পাই সে গান,
      নানাশব্দময় সেই জনকোলাহল।
তাহারি প্রাণের মাঝে    একমাত্র শব্দ বাজে

এক সুর, এক ধ্বনি,    অবিরাম অবিরল

যেন সে কোলাহলের হৃদয়ম্পন্দন  ধ্বনি
 
সমস্ত ভুলিয়া যাই,   বসে বসে তাই গনি।

ঘুমাই বা জেগে থাকি, মনের দ্বারের কাছে
কে যেন বিষণ্ন প্রাণী দিনরাত বসে আছে

       চিরদিন করিতেছে বাস,
তারি শুনিতেছি যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
এ প্রাণের ভাঙা ভিতে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে
ঘুঘু এক বসে বসে গায় একস্বরে,
     কে জানে কেন সে গান গায়।
বলি সে কাতর স্বরে স্তব্ধতা কাঁদিয়া মরে,
    প্রতিধ্বনি করে হায়-হায়।

হৃদয় রে, আর কিছু শিখিলি নে তুই,
          শুধু ওই গান !
প্রকৃতির শত শত রাগিণীর মাঝে
           শুধু ওই তান !

       তবে থাম্‌ থাম্‌ ওরে প্রাণ,
পারি নে শুনিতে আর একই গান, একই গান ।


       দুঃখ-আবাহন

       আয় দুঃখ, আয় তুই,
    তোর তরে পেতেছি আসন,
হৃদয়ের প্রতি শিরা টানি টানি উপাড়িয়া
বিচ্ছিন্ন শিরার মুখে তৃষিত অধর দিয়া
বিন্দু বিন্দু রক্ত তুই করিস শোষণ ;
জননীর স্নেহে তোরে করিব পোষণ।
হৃদয়ে আয় রে তুই হৃদয়ের ধন।

নিভৃতে ঘুমাবি তুই হৃদয়ের নীড়ে;
       অতি গুরু তোর ভার

দু-একটি শিরা তাহে যাবে বুঝি ছিঁড়ে,
           যাক ছিঁড়ে।
জননীর স্নেহে তোরে করিব বহন
দুর্বল বুকের 'পরে করিব ধারণ,
একেলা বসিয়া ঘরে     অবিরল একস্বরে
     গাব তোর কানে কানে ঘুম পাড়াবার গান।
     মুদিয়া আসিবে তোর শ্রান্ত দু - নয়ান।
প্রাণের ভিতর হতে উঠিয়া নিশ্বাস,
শ্রান্ত কপালেতে তোর করিবে বাতাস,
     তুই   নীরবে ঘুমাস ।

আয়, দুঃখ, আয় তুই, ব্যাকুল এ হিয়া।
দুই হাতে মুখ চাপি হৃদয়ের ভূমি-' পরে
         পড়্‌ আছাড়িয়া ।
সমস্ত হৃদয় ব্যাপি একবার উচ্চস্বরে
অনাথ শিশুর মতো ওঠ্‌ রে কাঁদিয়া
        প্রাণের মর্মের কাছে
    একটি যে ভাঙা বাদ্য আছে
দুই হাতে তুলে নে রে,    সবলে বাজায়ে দে রে
     নিতান্ত উন্মাদ-সম ঝন্‌ ঝন্‌ ঝন্‌ ঝন্‌।
ভাঙ্গে তো ভাঙ্গিবে বাদ্য, ছেঁড়ে তো ছিঁড়িবে তন্ত্রী

নে রে তবে তুলে নে রে, সবলে বাজায়ে দে রে
     নিতান্ত উন্মাদ-সম ঝন্‌ ঝন্‌ ঝন্‌ ঝন্‌।
     দারুণ আহত হয়ে দারুণ শব্দের ঘায়,
যত আছে প্রতিধ্বনি     বিষম প্রমাদ গনি
            একেবারে সমস্বরে
            কাঁদিয়া উঠিবে যন্ত্রণায়

            দুঃখ, তুই আয় তুই আয়।

           নিতান্ত একেলা এ হৃদয়।
           আর কিছু নয়,
কাছে আয় একবার,    তুলে ধর্‌ মুখ তার,
           মুখে তার আঁখি দুটি রাখ্‌
           একদৃষ্টে চেয়ে শুধু থাক্‌।
           আর কিছু নয়,
           নিরালয় এ হৃদয়
           শুধু এক সহচর চায়।
      তুই দুঃখ তুই কাছে আয়।
কথা না কহিস যদি     বসে থাক্‌ নিরবধি
           হৃদয়ের পাশে দিনরাতি।
যখনি খেলাতে চাস    হৃদয়ের কাছে যাস,
           হৃদয় আমার চায় খেলাবার সাথি।

           আয় দুঃখ হৃদয়ের ধন,
           এই হেথা পেতেছি আসন।
           প্রাণের মর্মের কাছে
           এখনো যা রক্ত আছে
           তাই তুই করিস শোষণ।