ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সন্ধ্যসংগীত

 


 

     শান্তিগীত

   ঘুমা দুঃখ হৃদয়ের ধন,
   ঘুমা তুই ঘুমা রে এমন।
সুখে সারা দিনমান    শোণিত করিয়া পান
   এখন তো মিটেছে তিয়াষ ?
    দুঃখ, তুই সুখেতে ঘুমাস।

আজ জোছনার রাত্রে বসন্তপবনে,
অতীতের পরলোক ত্যজি শূন্যমনে,
    বিগত দিবসগুলি শুধু একবার
    পুরানো খেলার ঠাঁই দেখিতে এসেছে
            এই হৃদয়ে আমার
 
যবে বেঁচেছিল তারা এই এ শ্মশানে
দিন গেলে প্রতিদিন পুড়াত যেখানে
একেকটি আশা আর একেকটি সুখ,
সেইখানে আসি তারা বসিয়া রয়েছে
              অতি ম্লান মুখ।

সেখানে বসিয়া তারা সকলে মিলিয়া
           অতি মৃদু স্বরে
পুরানো কালের গীতি নয়ন মুদিয়া
           ধীরে গান করে।

         দুঃখ, তুই ঘুমা।
     ধীরে উঠিতেছে গান,
        ক্রমে ছাইতেছে প্রাণ,
নীরবতা ছায় যথা সন্ধ্যার গগন।
গানের প্রাণের মাঝে তোর তীব্র কণ্ঠস্বর
          ছুরির মতন।

      তুই থাম্‌ দুঃখ, থাম্‌।
      তুই ঘুমা দুঃখ, ঘুমা।

         কাল উঠিস আবার,
   খেলিস দুরন্ত খেলা হৃদয়ে আমার;
হৃদয়ের শিরাগুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি মোর
তাইতে রচিস তন্ত্রী বীণাটির তোর,
    সারাদিন বাজাস বসিয়া
          ধ্বনিয়া হৃদয়।
আজ রাত্রে রব শুধু চাহিয়া চাঁদের পানে,
           আর কিছু নয়।


       অসহ্য ভালবাসা

      বুঝেছি গো বুঝেছি সজনি,
          কী ভাব তোমার মনে জাগে

      বুক - ফাটা প্রাণ-ফাটা মোর ভালোবাসা
           এত বুঝি ভালো নাহি লাগে।
      এত ভালোবাসা বুঝি পার না সহিতে,
           এত বুঝি পার না বহিতে।

          যখনি গো নেহারি তোমায়

      মুখ দিয়া আঁখি দিয়া    বাহিরিতে চায় হিয়া,
          শিরার শৃঙ্খলগুলি ছিঁড়িয়া ফেলিতে চায়,
      ওই মুখ বুকে ঢাকে,  ওই হাতে হাত রাখে,
            কী করিবে ভাবিয়া না পায়,
            যেন তুমি কোথা আছ খুঁজিয়া না পায় ।
মন মোর পাগলের হেন প্রাণপণে শুধায় সে যেন,
    "প্রাণের প্রাণের মাঝে কী করিলে তোমারে গো পাই,
    যে ঠাঁই রয়েছে শূন্য, কী করিলে সে শূন্য পুরাই ।"
             এইরূপে দেহের দুয়ারে
             মন যবে থাকে যুঝিবারে,
             তুমি চেয়ে দেখ মুখ - বাগে
 
             এত বুঝি ভালো নাহি লাগে।
             তুমি চাও যবে মাঝে মাঝে
             অবসর পাবে তুমি কাজে
             আমারে ডাকিবে একবার

             কাছে গিয়া বসিব তোমার,
             মৃদু মৃদু সুমধুর বাণী
             কব তব কানে কানে রানী।
            তুমিও কহিবে মৃদু ভাষ,
            তুমিও হাসিবে মৃদু হাস,
            হৃদয়ের মৃদু খেলাখেলি
 
            ফুলেতে ফুলেতে হেলাহেলি।

            চাও তুমি দুঃখহীন প্রেম
            ছুটে যেথা ফুলের সুবাস,
            উঠে যেথা জোছনালহরী,
            বহে যেথা বসন্তবাতাস।
            নাহি চাও আত্মহারা প্রেম
            আছে যেথা অনন্ত পিয়াস,
            বহে যেথা চোখের সলিল,
            উঠে যেথা দুখের নিশ্বাস।
            প্রাণ যেথা কথা ভুলে যায়,
            আপনারে ভুলে যায় হিয়া,
            অচেতন চেতনা যেথায়,
            চরাচর, ফেলে হারাইয়া।

এমন কি কেহ নাই,  বল্‌ মোরে বল্‌ আশা,
মার্জনা করিবে মোর অতি
  অতি ভালোবাসা !


         হলাহল

     এমন ক'দিন কাটে আর !
ললিত গলিত হাস,   জাগরণ, দীর্ঘশ্বাস,
সোহাগ, কটাক্ষ, মান, নয়নসলিলধার,
মৃদু হাসি
 মৃদু কথা  আদরের, উপেক্ষার
এই শুধু, এই শুধু, দিনরাত এই শুধু

     এমন ক'দিন কাটে আর !

কটাক্ষে মরিয়া যায়, কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে,
হাসিতে হৃদয় জুড়ে, হাসিতে হৃদয় টুটে,
ভীরুর মতন আসে      দাঁড়ায়ে রহে গো পাশে,
ভয়ে ভয়ে মৃদু হাসে, ভয়ে ভয়ে মুখ ফুটে,
একটু আদর পেলে অমনি চরণে লুটে,
অমনি হাসিটি জাগে মলিন অধরপুটে,
একটু কটাক্ষ হেরি অমনি সরিয়া যায়

অমনি জগৎ যেন    শূন্য, মরুভূমি-হেন,
অমনি মরণ যেন প্রাণের অধিক ভায়।

প্রণয় অমৃত এ কি ?    এ যে ঘোর হলাহল

হৃদয়ের শিরে শিরে      প্রবেশিয়া ধীরে ধীরে
অবশ করেছে দেহ, শোণিত করেছে জল।
কাজ নাই, কর্ম নাই,    বসে আছে এক ঠাঁই,
হাসি ও কটাক্ষ লয়ে খেলেনা গড়িছে যত,
কভু ঢুলে পড়া আঁখি কভু অশ্রুভারে নত।

দূর করো, দূর করো, বিকৃত এ ভালোবাসা
জীবনদায়িনী নহে, এ যে গো হৃদয়নাশা।
কোথায় প্রণয়ে মন যৌবনে ভরিয়া উঠে,
জগতের অধরেতে হাসির জোছনা ফুটে,
চোখেতে সকলি ঠেকে বসন্তহিল্লোলময়,
হৃদয়ের শিরে শিরে শোণিত সতেজে বয়
 
তা নয়, একি এ হল, একি এ জর্জর মন !
হাসিহীন দু অধর, জ্যোতিহীন দু নয়ন!
দূরে যাও, দূরে যাও, হৃদয় রে দূরে যাও
 
ভূলে যাও, ভুলে যাও, ছেলেখেলা ভুলে যাও।
দূর করো, দূর করো, বিকৃত এ ভালোবাসা
 
জীবনদায়িনী নহে, এ যে গো হৃদয়নাশা।


         অনুগ্রহ

    এই-যে জগৎ হেরি আমি,
    মহাশক্তি জগতের স্বামী,
    এ কি হে তোমার অনুগ্রহ ?
    হে বিধাতা কহো মোরে কহো।
ওই - যে সমুখে সিন্ধু,   এ কি অনুগ্রহবিন্দু ?
ওই - যে আকাশে শোভে চন্দ্র সূর্য গ্রহ,
     ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তব অনুগ্রহ ?
     ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র একজন
     আমারে যে করেছ সৃজন,
     এ কি শুধু অনুগ্রহ করে
     ঋণপাশে বাঁধিবারে মোরে ?
     করিতে করিতে যেন খেলা
     কটাক্ষে করিয়া অবহেলা,
হেসে ক্ষমতার হাসি অসীম ক্ষমতা হতে
     ব্যয় কয়িয়াছ এক রতি
     অনুগ্রহ করে মোর প্রতি ?
শুভ্র শুভ্র জুঁই দুটি    ওই-যে রয়েছে ফুটি
ও কি তব অতি শুভ্র ভালোবাসা নয় ?
     বলো মোরে, মহাশক্তিময়,
ওই-যে জোছনা-হাসি ওই-যে তারকারাশি,
     আকাশে হাসিয়া ফুটে রয়,
     ও কি তব ভালোবাসা নয় ?
     ও কি তব অনুগ্রহহাসি
     কঠোর পাষাণ লৌহময় ?
     তবে হে হৃদয়হীন দেব,
     জগতের রাজ-অধিরাজ,
     হানো তব হাসিময় বাজ,
     মহা অনুগ্রহ হতে তব
     মুছে তুমি ফেলহ আমারে

     চাহি না থাকিতে এ সংসারে।

     ভালোবাসি আপনা ভুলিয়া,
     গান গাহি হৃদয় খুলিয়া,
     ভক্তি করি পৃথিবীর মতো,
     স্নেহ করি আকাশের প্রায়।
     আপনারে দিয়েছি ফেলিয়া
     আপনারে গিয়েছি ভুলিয়া
     যারে ভালোবাসি তার কাছে
     প্রাণ শুধু ভালোবাসা চায়।

    সাক্ষী আছ তুমি অন্তর্যামী
    কতখানি ভালোবাসি আমি,
দেখি যবে তার মুখ   হৃদয়ে দারুণ সুখ
    ভেঙে ফেলে হৃদয়ের দ্বার,
    বলে, "এ কী ঘোর কারাগার !"

     পরাণ বলে, 'পারি নে সহিতে,
     এ দুরন্ত সুখেরে বহিতে।"
আকাশে হেরিলে শশী আনন্দে উথলি উঠি
    দেয় যথা মহাপারাবার
    অসীম আনন্দ উপহার,
তেমনি সমুদ্র-ভরা আনন্দ তাহারে দিই
    হৃদয় যাহারে ভালোবাসে,
হৃদয়ের প্রতি ঢেউ উথলি গাহিয়া উঠে
    আকাশ পুরিয়া গীতোচ্ছ্বাসে।
ভেঙে ফেলি উপকূল পৃথিবী ডুবাতে চাহে,
    আকাশে উঠিতে চায় প্রাণ
 
আপনারে ভুলে গিয়ে হৃদয় হইতে চাহে
     একটি জগতব্যাপী গান।
     তাহারে কবির অশ্রু হাসি
     দিয়েছি কত-না রাশি রাশি,
     তাহারি কিরণে ফুটিতেছে
     হৃদয়ের আশা ও ভরসা
     তাহারি হাসি ও অশ্রুজল
     এ প্রাণের বসন্ত বরষা।

‍‍     ভালোবাসি, আর গান গাই

     কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়
     রাত্রি এত ভালো নাহি বাসে,
     উষা এত গান নাহি গায়।

    ভালোবাসা স্বাধীন মহান,
    ভালোবাসা পর্বতসমান।
    ভিক্ষাবৃত্তি করে না তপন
    পৃথিবীরে চাহে সে যখন

    সে চাহে উজ্জ্বল করিবারে,
    সে চাহে উর্বর করিবারে,
    জীবন করিতে প্রবাহিত,
    কুসুম করিতে বিকশিত।
    চাহে সে বাসিতে শুধু ভালো
    চাহে সে করিতে শুধু আলো
    স্বপ্নেও কি ভাবে কভু ধরা,
    তপনেরে অনুগ্রহ করা ?
    যবে আমি যাই তার কাছে
    সে কি মনে ভাবে গো তখন
    অনুগ্রহ ভিক্ষা মাগিবারে
    এসেছে ভিক্ষুক একজন ?
    অনুগ্রহ পাষাণমমতা
    করুণার কঙ্কাল কেবল,
    ভাবহীন বজ্রে গড়া হাসি

    স্ফটিককঠিন অশ্রুজল।
    অনুগ্রহ বিলাসী গবিত,
    অনুগ্রহ দয়ালু কৃপণ
 
    বহু কষ্টে অশ্রুবিন্দু দেয়

    শুষ্ক আঁখি করিয়া মন্থন।

    নীচ হীন দীন অনুগ্রহ
    কাছে যবে আসিবারে চায়
    প্রণয় বিলাপ করি উঠে

    গীতগান ঘৃণায় পলায়।

    হে দেবতা, অনুগ্রহ হতে
    রক্ষা করো অভাগা কবিরে,
    অপযশ অপমান দাও

    দুঃখ জ্বালা বহিব এ শিরে।
    সম্পদের স্বর্ণকারাগারে,
    গরবের অন্ধকার-মাঝ,
    অনুগ্রহ রাজার মতন
    চিরকাল করুক বিরাজ।
    সোনার শৃঙ্খল ঝংকারিয়া
    গরবের স্ফীত দেহ লয়ে
    অনুগ্রহ আসে নাকো যেন
    আমাদের স্বাধীন আলয়ে।

    গান আসে ব'লে গান গাই,
    ভালোবাসি ব'লে ভালোবাসি,
    কেহ যেন মনে নাহি করে
    মোরা কারো কৃপার প্রয়াসী।
    নাহয় শুনো না মোর গান,
    ভালেবাসা ঢাকা রবে মনে।
    অনুগ্রহ করে এই কোরো

    অনুগ্রহ কোরো না এ জনে।