ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সন্ধ্যসংগীত

 


 

     আমি-হারা


       হায় হায়,
       জীবনের তরুণ বেলায়,
       কে ছিল রে হৃদয়-মাঝারে,
       দুলিত রে অরুণ-দোলায় !
       হাসি তার ললাটে ফুটিত,
       হাসি তার ভাসিত নয়নে,
       হাসি তার ঘুমায়ে পড়িত
       সুকোমল অধরশয়নে।
       ঘুমাইলে, নন্দনবালিকা
       গেঁথে দিত স্বপনমালিকা;
       জাগরণে, নয়নে তাহার
       ছায়াময় স্বপন জাগিত;
       আশা তার পাখা প্রসারিয়া
       উড়ে যেত উধাও হইয়া,
       চাঁদের পায়ের কাছে গিয়ে
       জ্যোৎস্নাময় অমৃত মাগিত।
       বনে সে তুলিত শুধু ফুল,
       শিশির করিত শুধু পান,
       প্রভাতের পাখিটির মতো
       হরষে করিত শুধু গান।
       কে গো সেই, কে গো হায় হায়,
       জীবনের তরুণ বেলায়
       খেলাইত হৃদয়-মাঝারে
       দুলিত রে অরুণ-দোলায় ?
       সচেতন অরুণকিরণ
       কে সে প্রাণে এসেছিল নামি ?
       সে আমার শৈশবের কুঁড়ি,
       সে আমার সুকুমার আমি।

 
       প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
       পথমাঝে উড়িল রে ধূলি,
       হৃদয়ের অরণ্য-আঁধারে
       দুজনে আইনু পথ ভুলি।
       নয়নে পড়িছে তার রেণু,
       শাখা বাজে সুকুমার কায়,
       ঘন ঘন বহিছে নিশ্বাস
       কাঁটা বিঁধে সুকোমল গায়।
       ধুলায় মলিন হল দেহ,
       সভয়ে মলিন হল মুখ
       কেঁদে সে চাহিল মুখপানে
       দেখে মোর ফেটে গেলে বুক।

       কেঁদে সে কহিল মুখ চাহি,
       "ওগো মোরে আনিলে কোথায় ?
       পায় পায় বাজিতেছে বাধা,
       তরুশাখা লাগিছে মাথায়।
       চারি দিকে মলিন আঁধার,
       কিছু হেথা নাহি যে সুন্দর,
       কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
       কোথা গো প্রভাতরবিকর ?"


       কেঁদে কেঁদে সাথে সে চলিল,
       কহিল সে সকরুণ স্বর,
       " কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
       কোথা গো প্রভাত রবিকর। "
       প্রতিদিন বাড়িল আঁধার
       পথ হল পঙ্কিল মলিন
  
       মুখে তার কথাটিও নাই,
       দেহ তার হল বলহীন।
অবশেষে একদিন,     কেমনে, কোথায়, কবে
        কিছুই যে জানি নে গো হায়,
        হারাইয়া গেল সে কোথায়।
 

        রাখো দেব, রাখো, মোরে রাখো,
        তোমার স্নেহেতে মোরে ঢাকো,
আজি চারি দিকে মোর      এ কী অন্ধকার ঘোর,
        একবার নাম ধরে ডাকো।
পারি না যে সামালিতে,     কাঁদি গো আকুল চিতে,
       কত রব মৃত্তিকা বহিয়া।
ধূলিময় দেহখানি     ধুলায় আনিছে টানি,
       ধুলায় দিতেছে ঢাকি হিয়া।

       হারায়েছি আমার আমারে,
       আজি আমি ভ্রমি অন্ধকারে।
কখনো বা সন্ধ্যাবেলা     আমার পুরানো সাথি
       মুহূর্তের তরে আসে প্রাণে,
       চারি দিকে নিরখে নয়ানে।
প্রণয়ীর শ্মশানেতে       একেলা বিরলে আসি
       প্রণয়ী যেমন কেঁদে যায়,
নিজের সমাধি-' পরে     নিজে বসি উপছায়া
       যেমন নিশ্বাস ফেলে হায়,
কুসুম শুকায়ে গেলে      যেমন সৌরভ তার
       কাছে কাছে কাঁদিয়া বেড়ায়,
সুখ ফুরাইয়া গেলে        একটি মলিন হাসি
       অধরে বসিয়া কেঁদে চায়,
তেমনি সে আসে প্রাণে    চায় চারি দিক-পানে,
       কাঁদে, আর কেঁদে চলে যায়।
       বলে শুধূ, "কী ছিল, কী হল,
       সে - সব কোথায় চলে গেল!"

        বহুদিন দেখি নাই তারে,
        আসে নি এ হৃদয়-মাঝারে।
মনে করি মনে আনি     তার সেই মুখখানি,
        ভালো করে মনে পড়িছে না।
হৃদয়ে যে ছবি ছিল      ধুলায় মলিন হল,
        আর তাহা নাহি যায় চেনা।
        ভুলে গেছি কী খেলা খেলিত,
        ভুলে গেছি কী কথা বলিত।
যে গান গাহিত সদা     সুর তার মনে আছে,
         কথা তার নাহি পড়ে মনে।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে     উড়িত সে মেঘ চেয়ে
           আর তাহা পড়ে না স্মরণে।
           শুধু যবে হৃদি-মাঝে চাই
           মনে পড়ে
   কী ছিল, কী নাই।


           গান-সমাপন

জনমিয়া এ সংসারে     কিছুই শিখি নি আর,
              শুধু গাই গান।
স্নেহময়ী মার কাছে      শৈশবে শিখিয়াছিনু ।
             দু-একটি তান।
             শুধু জানি তাই,
           দিবানিশি তাই শুধু গাই।
শতছিদ্রময় এই         হৃদয় - বাঁশিটি লয়ে
             বাজাই সতত
   
দূঃখের কঠোর স্বর          রাগিণী হইয়া যায়,
             মৃদুল নিশ্বাসে পরিণত।
আঁধার জলদ যেন         ইন্দ্রধনু হয়ে যায়,
             ভুলে যাই সকল যাতনা।
             ভালো যদি না লাগে সে গান
             ভালো সখা, তাও গাহিব না।

এমন পণ্ডিত কত          রয়েছেন শত শত
              এ সংসারতলে,
আকাশের দৈত্যবালা      উন্মাদিনী চপলারে
        বেঁধে রাখে দাসত্বের লোহার শিকলে।
আকাশ ধরিয়া হাতে       নক্ষত্র-অক্ষর দেখি
              গ্রন্থ পাঠ করিছেন তাঁরা,
জ্ঞানের বন্ধন যত          ছিন্ন করে দিতেছেন
              ভাঙি ফেলি অতীতের কারা।
              আমি তার কিছুই করি না,
              আমি তার কিছুই জানি না।
              এমন মহান্‌ এ সংসারে
              জ্ঞানরত্নরাশির মাঝারে
              আমি দীন শুধু গান গাই,
              তোমাদের মুখপানে চাই।
              ভালো যদি না লাগে সে গান
              ভালো সখা, তাও গাহিব না।

বড়ো ভয় হয়, পাছে       কেহই না দেখে তারে
              যে জন কিছুই শেখে নাই।
              ওগো সখা, ভয়ে ভয়ে তাই
              যাহা জানি সেই গান গাই,
              তোমাদের মুখপানে চাই।
শ্রান্ত দেহ হীনবল,       নয়নে পড়িছে জল,
              রক্ত ঝরে চরণে আমার,
নিশ্বাস বহিছে বেগে,     হৃদয়-বাঁশিটি মম
              বাজে না বাজে না বুঝি আর ।
দিন গেল, সন্ধ্যা গেল,      কেহ দেখিলে না চেয়ে ।
                  যত গান গাই ।
              বুঝি কারো অবসর নাই ।
              বুঝি কারো ভালো নাহি লাগে
 
              ভালো সখা, আর গাহিব না।


              উপহার
ভুলে গেছি কবে তুমি    ছেলেবেলা একদিন
         মরমের কাছে এসেছিলে,
স্নেহময় ছায়াময়         সন্ধ্যাসম আঁখি মেলি
         একবার বুঝি হেসেছিলে।

বুঝি গো সন্ধ্যার কাছে    শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
             ওই আঁখি দুটি
   
চাহিলে হৃদয়পানে       মরমেতে পড়ে ছায়া,
            তারা উঠে ফুটি।

আগে কে জানিত বলো       কত কী লুকানো ছিল
                    হৃদয়নিভৃতে,
তোমার নয়ন দিয়া            আমার নিজের হিয়া
             পাইনু দেখিতে।

কখনো গাও নি তুমি          কেবল নীরবে রহি
             শিখায়েছ গান
   
স্ববপ্নময় শান্তিময়            পূরবীরাগিনী-তানে
             বাঁধিয়াছ প্রাণ।


আকাশের পানে চাই,      সেই সুরে গান গাই
            একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি,       অনন্তে হারায়ে যায়
            আঁধারে পশিয়া।

       বলো দেখি কতদিন
              আস নি এ শূন্য প্রাণে।
         বলো দেখি কতদিন
              চাও নি হৃদয়পানে,
         বলো দেখি কতদিন
             শোনো নি এ মোর গান
   
         তবে সখী গান-গাওয়া
              হল বুঝি অবসান।

যে রাগ শিখায়েছিলে          সে কি আমি গেছি ভুলে ?
             তার সাথে মিলিছে না সুর ?
তাই কি আস না প্রাণে,        তাই কি শোন না গান
 
             তাই সখী, রয়েছ কি দূর ?
            ভালো সখী, আবার শিখাও,
            আরবার মুখপানে চাও,
            একবার ফেলো অশ্রুজল
            আঁখিপানে দুটি আঁখি তুলি।
তা হলে পুরানো সুর           আবার পড়িবে মনে,
            আর কভু যাইব না ভুলি।

সেই পুরাতন চোখে           মাঝে মাঝে চেয়ো সখী,
            উজলিয়া স্মৃতির মন্দির।
এই পুরাতন প্রাণে             মাঝে মাঝে এসো সখী,
           শূন্য আছে প্রাণের কুটির।
          নহিলে আঁধার মেঘরাশি
          হৃদয়ের আলোক নিবাবে,
          একে একে ভুলে যাব সুর,
          গান গাওয়া সাঙ্গ হয়ে যাবে।