বিষয়: রবীন্দ্রসঙ্গীত
শিরোনাম: আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
পাঠ ও পাঠভেদ:
-
গীতবিতান অখণ্ড (বিশ্বভারতী, কার্তিক ১৪১২ )-এর পাঠ: স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম সংখ্যক গান।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা,
অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর
মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি
মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল
রে,
তোমারি ধুলামাটি
অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে,
পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা
ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন
কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার
চাষি ॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম
এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধূলা,
সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার
ফাঁসি॥
MS.No.229
পাঠভেদ:
তথ্যানুসন্ধান
-
ক. রচনাকাল ও স্থান:রবীন্দ্রনাথের ৪৪ বছর বয়সের রচনা।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী গ্রন্থে এরূপ
উল্লেখ করেছেন- বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ই আগষ্ট ১৯০৫-কলিকাতার টাউন হলে যে
সভা হয়, সেই সভা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের নতুন সঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা বাউল সুরে গীত হয়েছিল।
জাতীয় সঙ্গীতাবলীর মধ্যে এই সঙ্গীতটি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ ৭ই সেপ্টেম্বর (১৩১২ সনের ২২শে ভাদ্র) তারিখের সঞ্জীবনী পত্রিকায়
এই গানটি রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তারপর বঙ্গর্শন (নব
পর্যায়) মাসিকপত্রের আশ্বিন (১৩১২ সন) সংখ্যায়ও উহা প্রকাশিত হয়েছিল। -গল্পভারতী ১৩৭৮ বৈশাখ। পৃষ্ঠা ১০২৩।
বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনে এ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
মূল গানটির প্রথম ১০ ছত্র- বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এই গানের সুর নিয়ে একসময় কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এর সুর নির্ধারিত হয়েছিল। এই বিষয়ে- সন্জিদা খাতুন তাঁর - "তাঁর আকাশ-ভরা কোলে গ্রন্থের "আমার সোনার বাংলা" নামক প্রবন্ধে লিখেছেন- "বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে "আমার সোনার বাংলা"-র সুর আর স্বরলিপি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রায় দেন, যে সুর গেয়ে দেশকে স্বাধীন করা হয়েছে, তাই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর। ঘটনা এই যে, সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ড থেকে যে সুর শুনে শিল্পীরা গানটি তুলেছিলেন, সে সুর থেকে নিজেরাই খানিকটা সরে যান। আর সেই সুরই গাওয়া হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কাল থেকে এ পর্যন্ত।"
"বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আমাদের ভুলের অপরাধকে মুছে দিয়েছিল। আজও সেই সুরে "আমার সোনার বাংলা" গেয়ে চলেছি আমরা।"
-
খ.প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:
-
গ্রন্থ:
-
কাব্যগ্রন্থ
-
গান
-
গীতবিতান
-
প্রথম খণ্ড, প্রথম সংস্করণ (বিশ্বভারতী ১৩৩৮)। গান (১৩১৫) গ্রন্থ
থেকে গৃহীত হয়েছিল। পৃষ্ঠা: ২৭৫-২৭৬।
[নমুনা:
প্রথমাংশ,
শেষাংশ]
- প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ (বিশ্বভারতী ১৩৪৮)
- অখণ্ড সংস্করণ, তৃতীয় সংস্করণ (বিশ্বভারতী ১৩৮০)। স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম সংখ্যক গান।
-
চয়নিকা (ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস ১৩১৬)। শিরোনাম: সোনার বাংলা। বাউলের সুর। পৃষ্ঠা:
৪৪৪-৪৪৫। [নমুনা:
প্রথমাংশ,
শেষাংশ]
-
বাউল
[মজুমদার লাইব্রেরি ১৩১২। শিরোনাম: সোনার বাংলা। বাউলের সুর। পৃষ্ঠা: ৯-১১।
[নমুনা:
প্রথমাংশ,
দ্বিতীয়াংশ,
শেষাংশ]
- সঙ্গীত প্রকাশিকা (আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ)। শিরোনাম-সোনার বাংলা। বাউলের সুর। ইন্দিরাদেবীকৃত স্বরলিপিসহ মুদ্রিত হয়েছিল।
স্বদেশ (১১ আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ)।
-
স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ (৪৬) খণ্ডের ৩য় গান হিসাবে গৃহীত হয়েছে। পৃষ্ঠা ৯-১৬।
[নমুনা]
-
পত্রিকা:
- সঞ্জীবনী (২২ ভাদ্র ১৩১২)
- বঙ্গদর্শন (১৩১২) সোনার বাংলা
গ. সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
- ভাঙা গান: একটি বাউল গানের সুর ভেঙে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেছিলেন। আর মূল গানটি তিনি পেয়েছিলেন সরলাদেবী'র (রবীন্দ্রনাথের বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা) কাছ থেকে। সরলাদেবী তাঁর জীবনের ঝরাপাতা (দ্বিতীয় দে'জ সংস্করণ এপ্রিল ২০০৯, বৈশাখ ১৪১৬) গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন— 'কর্তাদাদামহাশয় চূঁচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলুম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত— তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম—অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে একখানি নিজের গান রচনা করতেন। "কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ", যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে" "আমার সোনার বাংলা" প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝিদের কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান"।'
কিন্তু অন্যসূত্র থেকে, এই গানটির সংগ্রহের ইতিহাস অন্যরকমভাবে পাওয়া যায়। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী তৃতীয় খণ্ডে [প্রথম সংস্করণ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা ১২৯] লিখিত তথ্যানুসারে জানা যায়— ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সদলবলে শিলাইদহে আসেন। এসময় তাঁর সাথে ছিল স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা বেলা, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, মৃণালিনী দেবীর সহচরী ও বলেন্দ্রনাথ। এই সময় এঁরা একটি বোটে (সদলবলা থাকার উপযোগী বড় নৌকা) থাকতেন। এই বোটে এসে নিয়মিতভাবে স্থানীয় কিছু গায়ক এঁদেরকে গান শুনিয়ে যেতেন। এই জন্য গায়করা দুই আনা করে সম্মানী পেতেন। এই সময় বলেন্দ্রনাথ সুনা-উল্লা নামক জনৈক গায়কের কাছ থেকে কিছু গান রাখেন। তাঁর সংগৃহীত গানের সংখ্যা ছিল ১২টি। এই সংগৃহীত গানের একটি ছিল গগন ডাকহরকরার লেখা 'আমি কোথায় পাবো তারে'। পরবর্তী সময়ে এই গানের সুর অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ 'আমার সোনার বাংলা' রচনা করেছিলেন।
মূল গানটি গগন হরকরার বাউল গান। গানটি হলো-
[
শ্রবণ নমুনা: অমর পাল]
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী, পেল মন হত খুসি
দিবানিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিবাই কেমন করে
(মরি হায় হায়রে)
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে দেখ্-না তোরা হৃদয় এসে
দেখ্-না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি, যার প্রেমে জগৎ সুখী, হেরিলে জুড়ায় আঁখি,
সামান্যে কি দেখিতে পারে তারে।
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে
(মরি হায় হায় রে)
ও সে না জানি কি কুহক জানে, অলক্ষে মন চুরি করে,
কটাক্ষে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে, তবু না পেলাম তারে, প্রেমের লেশ নাই অন্তরে
তাইতে মোরে
দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায়, না জেনে তায়, গগন ভেবে মরে (মরি হায় হায় রে)
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস
কৃপা করে বলে দে রে
আমার সুহৃদ হয়ে বলে দে রে।
ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে বলে দে রে।
[সূত্র:
শতগান
৫৯ সংখ্যক গান, সরলাদেবী [সুবর্ণ সংস্করণ,১৪১৮ বঙ্গাব্দ,২০১১ খ্রিষ্টাব্দ] সরলাদেবী-কৃত স্বরলিপি-সহ মুদ্রিত।]
স্বরলিপি: [নমুনা] সূত্র: স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ
খণ্ড
স্বরলিপিকার: ইন্দিরাদেবী। (স্বরবিতান-৪৬ এ গৃহীত মূল গান)
- শান্তিদেব ঘোষ। (স্বরবিতান-৪৬ এর সুরান্তরে গৃহীত স্বরলিপিটি সুচিত্রা মিত্র-কর্তৃক গীত গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসারে।)
সুর ও তাল:
- গানটি
স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ
(৪৬) (৪৬, মাঘ ১৪১৫) খণ্ডের ৩য় গান হিসাবে গৃহীত হয়েছে। পৃষ্ঠা ৯-১৬।
এই গানের বিকল্প সুর মুদ্রিত হয়েছে স্বরবিতান ষট্চত্বারিংশ(৪৬) খণ্ডের
সুরভেদ/ছন্দোভেদ পত্র। পৃষ্ঠা: ৮৭-৮৯।
-
স্বরবিতান-৪৬ এ মুদ্রিত স্বরলিপিতে রাগ ও তালের উল্লেখ নেই। বাউল গানের সুরে এর সুর নিবদ্ধ।
তাই গানটিকে বাউলাঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করা যায়। স্বরলিপিটি ৩।৩ মাত্রা ছন্দে দাদরা তালে নিবন্ধ।
- অঙ্গ: বাউল তাল: দাদরা [রবীন্দ্রসংগীত:
রাগ-সুর নির্দেশিকা। সুধীর চন্দ। প্যাপিরাস, ডিসেম্বর ২০০৬
। পৃষ্ঠা: ৩১]।
-
অঙ্গ: বাউল।
তাল: দাদরা। [রাগরাগিণীর
এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত, প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, জুলাই ২০০১], পৃষ্ঠা:
৫৯।
বিষায়াঙ্গ: স্বদেশ
সুরাঙ্গ:
বাউলাঙ্গ
গ্রহস্বর: মা।
লয়: মধ্য।