বিষয়:
নজরুল সঙ্গীত।
গান সংখ্যা : ১৫৭৭
শিরোনাম:
বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ
সুরে।
১. পাঠ ও পাঠভেদ:
বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ সুরে।
বিষাদিত ছায়া তার চৈতালি সন্ধ্যার চাঁদের মুকুরে॥
চপলতা বিসরি' যেন বন-যৌবন
বিরহ-ক্ষীণ আজি উদাস উন্মন,
তোলে না ঝঙ্কার আর ঝরা পাতার মর্মর নূপুরে॥
যে কুহু কুহরিত মধুর পঞ্চমে বিভোর ভাবে,
ভগ্ন কণ্ঠে তার থেমে যায় সুর করুণ রেখাবে।
কোন্ বন-শিকারির অকরুণ তীর
আলো হ'রে নিল ওই উজল আঁখির —
ফেলে যাওয়া বাঁশি তা'র অঞ্চলে লুকায়ে —
গিরি-দরি-প্রান্তরে খোঁজে সে নিঠুরে॥
ভাবসন্ধান: নজরুল ইসলাম ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের বিধি
অনুসরণে সুরের গবেষণা শুরু করেছিলেন ১৯৩৯ খ্রিষ্টব্দের দিকে। এই গবেষণার সূত্রে
তিনি কিছু নতুন রাগ সৃষ্টি করেন। এই সকল নতুন রাগগুলোর মধ্য থেকে ৬টি রাগ নিয়ে
তিনি একটি গীতি-আলেখ্য রচনা করেন, যা ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারি তৎকালীন
কোলকাতা বেতারে এই গীতি-আলেখ্যটি 'নব রাগমালিকা'
নামে সম্প্রচার হয়। এই গীতি-আলেখ্যের ছয়টি রাগ ছিল- নির্ঝরিণী, বেণুকা,
মীণাক্ষী, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা ও দোলনচাঁপা। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই
জানুয়ারি 'বেতার জগত' -এর 'আমাদের কথা' বিভাগে এই গীতি-আলেখ্যটি
প্রকাশিত হয়। এই গীতি-আলেখ্যতে বনকুন্তলা রাগ ও তার গানের অবস্থান ছিল পঞ্চম।
কাজী নজরুল ইসলাম মূলত এই গানের ভিতরে দোলনচাঁপা রাগের রূপ বর্ণনা করেছেন
রূপকতার ভিতর দিয়ে। এই বিচারে এই গানটিকে বলা যায়- দোলনচাঁপা রাগের রূপকাশ্রিত
লক্ষণগীত। এই রাগের শুরুতে নিবদ্ধ 'বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে
সকরুণ সুরে'- গানটির শুরুতে নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-
'এই রাগিণীতে এলায়িত কুন্তলা বিরহিণী বন শবরী রূপ অরণ্যাশ্রয়ী লইয়া ফুটিয়া ওঠে বলিয়া ইহার নাম বনকুন্তলা। আরোহীতে পঞ্চম (পা) ধৈবত (ধা) অবলম্বন করিয়া স্থিতি বলিয়া ভূপালী হইতে স্বতন্ত্র শোনায়। আরোহীতে র্সা না ধা পা, গা রা সা রা- ইহার প্রধান রূপ, ইহাতেই ইহার অরণ্যাশ্রয়ী করুণ-রূপ ফুটে উঠে।'
গানটির স্থায়ীতে পাওয়া যায়, বিরহবিধূর করুণ রস। রাগের
বিরহ-করুণ রসের প্রকাশ ঘটেছে বনচারিণী শবরকন্যার বিলাপের ভিতর দিয়ে। বনকুন্তলা
রাগের এই করুণ রস মূর্তমান হয়ে উঠেছে, আলুথালু এলায়িত কেশে বিলাপরতা
বনচারিণী শবরকন্যার সকরুণ সুরে। শবরকন্যার ব্যথিত মনের বিষাদিত ছায়া চৈতালি
সন্ধ্যার চাঁদের আভাকে ম্লান করে দিয়েছে। অশান্ত-যৌবনের চপলতা বিসর্জন দিয়ে আজ
সে বিরহ-বিষাদে ম্লান। সে আনমনা উদাস। এখন আর তার পায়ের চপল আঘাতে শুকনো পাতার
মর্মর ধ্বনি নূপুর নিক্কনের মতো ঝঙ্কার তোলে না।
বনকুন্তলা রাগের পরিচয়
দিতে গিয়ে নজরুল উল্লেখ করেছিলেন 'আরোহীতে পঞ্চম (পা) ধৈবত (ধা) অবলম্বন করিয়া
স্থিতি বলিয়া ভূপালী হইতে স্বতন্ত্র শোনায়।' কবি সঞ্চারীতে এসে সেই ভাবটি
উপস্থাপন করেছেন। গানে বলা হয়েছে- হৃদয়বসন্তকাননে যে যৌবনের কোকিল কুহু পঞ্চম স্বরে উচ্ছলিত ছিল, তার সুর মলিন
হয়ে ভগ্ন কণ্ঠে স্তিমিত হয়েছে। পঞ্চমের সুমধুর তীব্রতর আনন্দ ম্লান হয়ে শেষ
হয়েছে রেখাব স্বরে। কবি স্বরের অবস্থানের ভিতর দিয়ে পঞ্চম থেকে রেখাবে অবনতিকে
আনন্দের অবরোহ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। কবির বর্ণনায় রাগের রূপ এবং কাব্যের
রূপকতা একাকার হয়ে যায়। কিন্তু গানটির সুর-বিন্যাসেও দেখা যায় স র গ প ধ-র
বিশেষ প্রয়োগ যেখানে ভূপালীর রাগ স্পষ্ট হয়ে উঠে, সেখান শুদ্ধ নিষাদ এবং চলনের
বিশেষ কৌশলে সুর ভূপালীকে ভুলিয়ে দেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বনকুন্তলার বিশেষ
রূপ।
আভোগে এসে পাওয়া যায়, শবর-কন্যার হৃদয়ে প্রেমানুভুতির সঞ্চার করেছিল যে
বন-শিকারি, তাঁর বিস্মৃতি শবরীকন্যার হৃদয়ে অকরুণ তীরের মতো ক্ষতবিক্ষত করেছে।
তার অবর্তমানে শবরকন্যার চোখ প্রেমের আলো নিভে গেছে, উজ্জ্বল আঁখিতার হয়েছে
ম্লান। তবু বন-শিকারির ফেলে যাওয়া বাঁশি শবরী সযত্নে আঁচলে লুকিয়ে রাখে। এর
ভিতর দিয়ে তার প্রেমের স্পর্শ অনুভব করে। সে কী গভীর আশায় এখনও
গিরি-নদী-প্রান্তরে তার প্রেমিককে খুঁজে মরে। গানের এই অংশেও বনকুন্তলার বিরহে
পাওয়া যায় গভীর অভিমান, যা রাগের বিরহবিধূর করুণ রসকে উপস্থাপন করে।
টীকা
বন-কুন্তলা= বুনো চুল, অবিন্যস্ত চুল, পরিপাটিহীন চুল।
বন-শবরী=ভারতের অরণ্যচারী শবর জাতির কন্যা হিসেবে বন-শবরী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
চাঁদের মুকুর=চাঁদের আয়না। কবি কল্পনায়, যেন বিষাদের ছায়া চাঁদের আয়নায় ধরা পড়েছে।
বন-যৌবন=অরণ্যচারী নারী প্রবল যৌবন-চাপল্যকে বন-যৌবন বলা হয়েছে।
বিরহ-ক্ষীণ=বিরহ দ্বারা ক্ষীণ
তথ্যানুসন্ধান
ক. রচনাকাল ও স্থান: ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারি, বেতারে 'নব-রাগমালিকা' অনুষ্ঠানে এই গানটি প্রচারিত হয়। ধারণা করা হয়, গানটি নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষে বা ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে রচনা করেছিলেন। এই বিচারে বলা যায়, গানটি কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৪১ বৎসর বয়সের রচনা।
খ. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:
একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০।)। ৪৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১১৭-১১৯।
নজরুল গীতি, অখণ্ড (আব্দুল আজীজ আল-আমান, সম্পাদিত)।
নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ১৫৭৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৪৭২-৪৭৩।
স্বরলিপিকার:
জগৎ ঘটক। [নবরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)]
জগৎ ঘটক। [নবরাগ (হরফ প্রকাশনী। কবির ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)]
কাজী অনিরুদ্ধ। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, পঞ্চম খণ্ড (সাহিত্যম্)]