অস্ট্রিয়ার পতাকা |
ভৌগোলিক অবস্থান:
৪৮°১২'
উত্তর
১৬°২১'
পূর্ব।
এর উত্তরে
জার্মানি
ও চেক প্রজাতন্ত্র, পূর্বে স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণে স্লোভেনিয়া ও ইতালি,
এবং পশ্চিমে সুইজারল্যান্ড
ও লিশ্টেন্ষ্টাইন।
আয়তন:
৮৩.৮৭৯ বর্গকিলোমিটার (৩২,৩৮৬ বর্গমাইল)।
জনসংখ্যা: ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অনুমানিক হিসাব ৮৮,৫৭,৯৬০।
জাতিগোষ্ঠী: ৮১.১% অস্ট্রীয়, ৭.০ যুগোশ্লাভ, ৪% তুর্ক এবং ৭.৯% অন্যান্য।
ভাষা: সরকারি ভাষা জার্মান। তবে এটি আঞ্চলিক জার্মান ভাষা হিসেবে বিবেচিত
হয়ে থাকে। এই কারণে এই ভাষাকে বলা হয় অস্ট্রীয় জর্মান। আঞ্চলিকতার বিচারে
অস্ট্রীয় জার্মান ভাষাকে প্রধান
দুটি উপভাষায় ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- গুলিকে আলেমানীয় উপভাষা ও দক্ষিণ
বাভারীয় উপভাষা। অস্ট্রীয় জার্মান ভাষার বাইরে
অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলো হলো- ২.৩% তুর্কি,
২.২% সার্বিয়ান, ১.২% ক্রোয়েশিয়, ৫.৩% হাঙ্গেরিয় ও অন্যান্য।
ধর্ম: অস্ট্রিয়া মূলত
রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম প্রধান দেশ। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট
জনসংখ্যার ৭৩.৬% লোক রোমান ক্যাথোলিক। এর বাইরে রয়েছে লুথেরান
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে এরা ছিলেন মোট
জনসংখ্যার ৪.৭%। এদের বেশির ভাগই দক্ষিণ অস্ট্রিয়ার কের্নটেন অঙ্গরাজ্যে বাস
করে। এরপরে রয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বী। এদের সংখ্যা ৪.২%। এছাড়াও অস্ট্রিয়াতে
স্বল্পসংখ্যক হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও ইহুদী বাস করেন।
ভূপ্রকৃতি: অস্ট্রিয়াকে তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। এদের ভিতর
বৃহত্তম অংশটিতে (প্রায় ৬২%) রয়েছে আল্পস পর্বতমালার অপেক্ষাকৃত নবীন পাহাড়গুলো।
এই অংশের পূর্বে পানোনীয় সমভূমি এবং দানিউব নদীর উত্তরে আছে বোহেমীয় অরণ্য নামের
একটি পুরানো কিন্তু অপেক্ষাকৃত নীচু গ্রানাইট পাথরের পার্বত্য অঞ্চল।
সাধারণভাবে বলা হয় অস্ট্রিয়া মূলত আল্পস পর্বতমালায় অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। আল্পসের
তিনটি প্রধান শাখা, উত্তর চুনাপাথরীয় আল্পস, কেন্দ্রীয় আল্পস, ও দক্ষিণ
চুনাপাথরীয় আল্পস অস্ট্রিয়ার পশ্চিম থেকে পূর্ব জুড়ে বিস্তৃত। ৩৭৯৭ মিটার
উচ্চতাবিশিষ্ট গ্রোস্গ্লকনার অস্ট্রিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। অস্ট্রিয়ার মাত্র
২৮% অঞ্চল সমতল বা অপেক্ষাকৃত কম পাহাড়ি অঞ্চল।
দানিয়ুব উপত্যকার উত্তরে অস্ট্রিয়ার প্রায়
১০% এলাকা জুড়ে অবস্থিত একটি গ্রানাইট মালভূমি এলাকা।
ইতিহাস: অস্ট্রিয়ার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ৯৭৬
খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা ভিত্তিক ভূস্বামীরা শাসন
করতেন।
৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে লেওপোল্ড ফন বাবেনবের্গ
নামক জনৈক শাসক
বর্তমান অস্ট্রীয় এলাকার বেশির ভাগ অংশের নিজের অধিকারে আনেন। ১২৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রথম
রুডলফ হাব্স্বুর্গ বংশের প্রথম রাজা হিসেবে অস্ট্রিয়ার প্রকৃত রাজতন্ত্রের পত্তন
ঘটান।
হাব্স্বুর্গ রাজবংশের রাজারা প্রায় ৭৫০ বছর অস্ট্রিয়া শাসন করেন। রাজনৈতিক
বিবাহ সম্পাদনের মাধ্যমে হাব্স্বুর্গেরা মধ্য ইউরোপের এক বিরাট এলাকা দখলে সক্ষম
হন। তাদের ভূসম্পত্তি এমনকি আইবেরীয় উপদ্বীপ (বর্তমান স্পেন) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৬শ ও ১৭শ শতকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের আক্রমণের ফলে অস্ট্রীয় এলাকাটি ধীরে ধীরে
দানিউব নদীর অববাহিকার কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় অংশটিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্ৎস ইয়োজেফ (প্রথম)
সিংহাসনে আরোহণ করেনে এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর অস্ট্রীয় ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক
ঘটনা ঘটে। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যের ভেতরে হাঙ্গেরি আগের চেয়ে বেশি
রাজনৈতিক স্বাধীনতা পায়, ফলে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় দ্বৈত রাজ্যব্যবস্থার আবির্ভাব
ঘটে।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুন, বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ
আর্চডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড
(Archduke
Franz Ferdinand)
নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এছাড়াও এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ডের স্ত্রী সোফি ব্লাক হ্যান্ড নামক
সার্বিয়ান গুপ্ত জাতীয় সংস্থার সদস্যদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা।
এর ভিতর দিয়ে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
সর্ভিয়ার জনৈক নাগরিক এই যুবরাজকে গুলি করে হত্যা করেছিল। অস্ট্রিয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়ার শাসকদের দায়ী করে। কিন্তু সার্বিয়া এই দাবি অস্বীকার করলে, ২৮শে জুলাই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরে এর সাথে যুক্ত হয় উভয় রাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ। অষ্ট্রিয়ার পক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জারমান, বুলগেরিয়া এবং তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য। অন্যদিকে সার্বিয়ার পক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, বেলজিয়াম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য সার্বিয়ার পক্ষের নাম দেওয়া হয়েছিল মিত্রশক্তি।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর
মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানি আত্মসমপর্ণ করলে, এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সূচনা হয়।
এরপর ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন জার্মানির সাথে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে মিত্র
বাহিনীর মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি হয় এবং প্রথম বিশযুদ্ধটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। এই
যুদ্ধের পরে অস্ট্রীয়
সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। ঐ সময় অস্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যার
সীমানা ও বর্তমান অস্ট্রিয়ার সীমানা মোটামুটি একই রকম। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে সাঁ জেরমাঁ-র
চুক্তির ফলে হাব্স্বুর্গ রাজবংশ সরকারিভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং অস্ট্রীয়
প্রজাতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯১৮ থেকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অস্ট্রিয়াতে রাজনৈতিক সংঘাত বৃদ্ধি পায়। ১৯২০-এর
দশকের শেষে এবং ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে আধা-সামরিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলি হরতাল ও সহিংস
সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বেকারত্বের হার বেড়ে ২৫% হয়ে যায়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে
কর্পোরেশনবাদী স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে জুলাই মাসে অস্ট্রীয়
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক (নাৎসি) দল কু-এর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের
ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির সামরিক আগ্রাসনের হুমকির মুখে অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর
কুর্ট শুশনিগ অস্ট্রীয় নাৎসিদের সরকারে নিতে বাধ্য হন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ
জার্মানি অস্ট্রিয়াতে সৈন্য পাঠায় এবং দেশটিকে জার্মানির অংশভুক্ত করে নেয়। সে সময়
বেশির ভাগ অস্ট্রীয় এই জার্মানির এই দখলকে সমর্থন করেছিল।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলের মধ্যে অস্ট্রিয়ার অধিকাংশ ইহুদীকে হয়
হত্যা করা হয় অথবা নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়। সিন্তি, জিপসি, সমকামী এবং
অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বীদেরও একই পরিণাম ঘটে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের আগে
অস্ট্রিয়াতে ২ লক্ষ ইহুদী বাস করত। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এদের অর্ধেকের বেশি
দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। জার্মানরা ইহুদীদের ব্যবসা ও দোকানপাটে লুটতরাজ চালায়।
প্রায় ৩৫ হাজার ইহুদীকে পূর্ব ইউরোপে গেটো বা বস্তিতে পাঠানো হয়। প্রায় ৬৭ হাজার
ইহুদীকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। যুদ্ধশেষে এদের মাত্র ২ হাজার বেঁচে
ছিল।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মিত্রশক্তির কাছে জার্মানির পরাজয়ের পর, অস্ট্রিয়াকে চারভাগে ভাগ করে
মিত্রশক্তির শাসনে রাখা হয়। ১৯৫৫
খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর অস্ট্রিয়াকে পূর্ণ
স্বাধীনতা পায়।