বাংলায় মোগল-বার ভুঁইয়াদের সংঘর্ষ

মূলত ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় মোগল-আফগান সংঘাত অব্যাহত ছিল। ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে আসেন রাজা মানসিংহ। এই সময় মোগল-আফগান সংঘাতের নতুন পর্ব শুরু হয়। এই পর্বের প্রধান প্রতিপক্ষের এক দিকে ছিলে বাংলার মোগল শাসক রাজা মানসিংহ, অন্যদিকে ছিল বাংলার বার ভূঁইয়ারা। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলার সকল ভুঁইয়াদের পরাজিত হয় এবং মোগল।

 

বাংলা বার ভুঁইয়া

বাংলার আফগান শাসক দাউদের সাথে মোগল বাহিনীর শেষ যুদ্ধ হয়  ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে। এই যুদ্ধে দাউদ পরাজিত হয়ে বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর ভিতর দিয়ে বাংলার কর্‌রানি বংশের শাসন শেষ হয়ে যায়। এরপর বাংলার সুলতানদের ঔদাসিন্যের সূত্রে, বাংলা বিভিন্ন অঞ্চলের ভূস্বামীরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। এদের অনেকেই শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করা শুরু করে। ভূমির অধিকারী এই অর্থে এদের বলা হতো ভৌমিক। এই শব্দ থেকেই পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে ভুঁয়া বা ভুঁইয়া। সমগ্র বাংলাদেশে সে সময়ে বহু ভুঁইয়া বিভিন্ন অঞ্চলে শাসন করলেও অপেক্ষাকৃত উল্লেখযোগ্য ভুঁইয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আকবরের সভাসদ সে সময়ের বাংলাকে নির্দেশ করেছিলেন 'বার ভুঁইয়ার দেশ। এঁরা ছিলেন

মানসিংহের সাথে প্রথম বার ভুঁইয়াদের যুদ্ধ হয় ঈষা খাঁ'র। যুদ্ধে ঈষা খা জয়ী হলেও মানিসিংহের সাথে তিনি সম্প্রীতিমূলক সন্ধি করেন। এরপর মানসিংহ বিক্রমপুরের ভুঁইয়া কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালান। কেদার রায় পরাজিত হন এবং বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই সূত্রে বিক্রমপুরের শ্রীপুর অঞ্চল মোগল শাসনাধীনে চলে যায়।

এই সময় সোনারগাঁয়ের শাসক ছিলেন ঈশা খাঁ-এর পুত্র মুসা খাঁ।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈশা খাঁ'র মৃত্যুর পর তিনি সোনারগাঁও-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শাসক হন। মানসিংহ সন্ধির শর্তানুসারে তাঁকে বিরক্ত করেন নি। মূলত কেদার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্যের একটি অংশও মুসা খাঁ অধিকার করেন।


১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর অসুস্থ হয়ে পড়লে, মানসিংহ দিল্লিতে ফিরে যান। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মানসিংহের নামেই স্থানীয় মোগল শাসকরা শাসন করতেন। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় মোগল শাসক হিসেবে আসেন ইসলাম খাঁ। ইসলাম খাঁ প্রথম বড় ধরনের অভিযান চালান মুসা খাঁর বিরুদ্ধে। পথিমধ্যে ইসলাম খাঁ খুলনা-যশোহর অঞ্চলে ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে আক্রমণের উদ্যোগ নিলে, তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন এবং মুসা খাঁ-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সাহায্য করার অঙ্গীকার করেন।

 

১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান তৎকালীন বাংলার সীমান্ত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন।

 

১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ক্রমাগত আক্রমণের মুখে, মুসা খাঁর সামরিক শক্তি হ্রাস পায়। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে মোগল বাহিনী যাত্রাপুর ও ডাকচারা দুর্গ দখল করে নেয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোগলরা ঢাকা থেকে সোনারগাঁও আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুসা খাঁ পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে, মোগলবাহিনীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।

 

১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেই মোগলরা ময়মনসিংহের ভুঁইয়া উসমানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। প্রবলভাবে বাধা দেওয়ার পরেও উসমান পরাজিত হন এবং তিনি পালিয়ে শ্রীহট্টের আফগান ভুঁইয়া বায়জিদ কর্‌রানির আশ্রয়ে চলে যান।

 

১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মুসা খাঁর সাথে যুদ্ধের সময় তিনি চুক্তি অনুসারে মোগলদের সাহায্য করেন নি, এই অজুহাতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। বাখেরগঞ্জের ভুঁইয়া রামচন্দ্র ছিলেন প্রতাপাদিত্যের জামাতা। রামচন্দ্র যাতে প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন, সে কারণে ইসলাম খাঁ একই সাথে রামচন্দ্র-এর বিরুদ্ধে অপর একটি সেনাদল পাঠান।  প্রতাপাদিত্য যশোহর রক্ষার জন্য তাঁর পুত্র উদয়াদিত্যকে নিয়োগ করেন আর নিজে তাঁর রাজ্যের রাজধানী ধুমঘাট প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধে প্রথমে উদয়াদিত্য এবং পরে প্রতাপাদিত্য পরাজিত বন্দী হন। পরে বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান পুনরায় উসমানের রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধের প্রথম থেকেই উসমান ক্রমাগত জয়লাভ করতে থাকেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তীরবিদ্ধ হয়ে উসমানের মৃত্যু হলে, আফগান সৈন্যরা মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর ভিতর দিয়ে বাংলার ভুঁইয়াদের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।