খুমি (নৃগোষ্ঠী)
ইংরেজি : khumi
সমনাম: খামি

বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমারে উল্লেখযোগ্য একটি প্রাচীন নৃ-জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রামের বান্দরবান জেলায় এবং মায়ানমারের আরাকান পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম মায়ানমারে বসবাস করে। ভারতে বাংলাদেশে সংলগ্ন পাহাড়ি অঞ্চলে এদের দেখা যায়।

এরা মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। এদের চওড়া মুখমণ্ডল, চ্যাপ্টা নাক ও দীর্ঘ চোয়াল। গায়ের রঙ পীতাভ, শ্যামলা, কালো হয়ে থাকে। আকারে নাতিদীর্ঘ। চুল মোঙ্গীলয় ধরনের সটান হয়ে থাকে। দেহ মাংসবহুল স্থূল ধরনের।

খুমি ভাষায় ‘খা’ অর্থ মানুষ এবং ‘মি’ অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। এই বিচারে খামি শব্দের অর্থ হলো সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। এই খামি শব্দ থেকে খুমি শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। আরাকানিরা খুমিদের বলে খোমি, যার অর্থ কুকুর জাতি। আরাকানি ভাষায় ‘খি’ বলতে কুকুরকে বোঝায় এবং ‘মি’ হচ্ছে জাতির প্রতীক।

ধারণা করা হয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা আরাকান থেকে এদেশে আসে। এরা আরকান থেকে খ্যাং নামক অপর এক জাতি তাদেরকে আরাকান থেকে বিতাড়ন করে। তবে এখনও কিছু খুমি আরাকানের কোলাদাইন নদীর তীরে বসবাস করছে। বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রুমা, রোয়াগংছড়ি এবং থানচি উপজেলায় খুমিরা বাস করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান পকেটবুক ১৯৯৯ অনুযায়ী, এদের মোট লোকসংখ্যা ১,২৪১ জন। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুসারে সকলদেশ মিলে এদের লোক সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।

খুমিদের বিশ্বাস তাদের পূর্বপুরুষরা কোনো এক আদি নদীর উৎপত্তিস্থলে বাস করত। সেই কারণে এরা নদীর তীরে এবং পাহাড়ের উপরে বাস করে। এরা বেশ স্বাধীনচেতা। অনেকে এদেরকে লু্ণ্ঠনপরায়ণ, যোদ্ধা জাতি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এদের গ্রামগুলি বেশ সুরক্ষিত। প্রতিটি গ্রামে একটি মাত্র প্রবেশদ্বার থাকে। এই প্রবেশদ্বারে অস্ত্র হাতে পাহারাদার থাকে। এদের মূল অস্ত্র ধারলো দা, বর্শা ইত্যদি। এদের গ্রামগুলো একটু গভীর জঙ্গলে হয়। এরা মূলত জঙ্গলে গাছের উপর বসবাসের জন্য ঘর বানায়।

খুমি পুরুষরা সাধারণত নিম্নাঙ্গে সুতা বা পশুর লোমের তৈরি লম্বা সাদা কাপড় পরিধান করে। এই কাপড় এরা লেংটির মতো করে পড়ে। তবে শরীরের সামনের ও পিছনের দিকে লেংটি ঝুলানো থাকে। মাথায় সাদা পাগড়ি জাতীয় কাপড় বেঁধে রাখে।  খুমি মেয়েরা ওয়াঙলাই নামে ৯-১৪ ইঞ্চি চওড়া আকারের কাপড় নিম্নাঙ্গে পরে। তবে মেয়েদের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকে। এরা গলায় রুপা এবং পুঁতির গহনা পরে। এরা নিজেদের পোশাক লেংটি এবং ওয়াঙলাই নিজেরাই বয়ন করে।

এদের প্রধান খাদ্য ভাত। এই ভাতের জন্য প্রয়োজনীয় চাল উৎপন্ন করে জুমচাষের মাধ্যমে। এছাড়া  বন্য ফলমূল আহার করলেও এরা এগুলো চাষ করার পরিবর্তে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে। প্রায় সকল ধরনের বন্য পশু এরা আহার করে। এই তালিকায় বাঘ, হরিণ, গরু, শুকর, কুকুর, শিয়াল, মোরগ, ভালুক, মহিষ, সাপ ইত্যাদি সবই রয়েছে।

মদ তাদের সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ। সাধারণত ভাত পচিয়ে এরা মদ তৈরি করে। ধর্মীয় এবং সামাজিক বিভিন্ন কাজে এবং অনুষ্ঠানে মদ্যপানের রেওয়াজ আছে।

খুমিরা পিতৃতান্ত্রিক। এদে দুটি গোত্র রয়েছে। গোত্র দুটি হলো
আওয়া খুমি এবং আফিয়া খুমি। ধারণা করা হয় উভয় গোত্রই এক সময় কোলাদাইন নদীর তীরে বসবাস করত। অনেক খুমি বাড়িতে কৃতদাস অথবা চাকর রাখে। খুমি গৃহকর্তাদের যদি পুত্রসন্তান না থাকে তাহলে মৃত্যুর পূর্বে তারা সমস্ত সমপত্তি কৃতদাসকে দান করে যায়। খুমিরা সমগোত্রে বিয়ে করে না। তারা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার অনুমতি দেয় এবং এটি তাদের সমাজে একটি গ্রহণযোগ্য রীতি। কমবয়সীদের মধ্যে বিবাহপূর্ব অবাধ মেলামেশা বা যৌনতা নিন্দনীয় নয়। তবে অবাধ মেলামেশা বা যৌন সম্পর্কের কারণে কোন মেয়ে গর্ভবতী হলে সমাজ সংশ্লিষ্ট যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেয়।

খুমিদের ধর্মের তিনটি ভাগ রয়েছে। এই ভাগগুলো হলো বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সনাতন। পূর্বভারত এবং মায়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হলে, এই অঞ্চলের বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর ভিতর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পড়ে। খুমিদের ভিতরেও বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রভাব পড়ে। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের সকল রীতিনীতি খুমি বৌদ্ধরা মান্য করে না। তাই বৌদ্ধ খুমিদের ভিতরে সনাতন ধর্মের একটি বড় প্রভাব থেকেই গেছে। সনাতন ধর্মের খুমিরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে, এরা পাথিয়ান নামক একক স্রষ্টার উপাসনা করে। এদের অপর দুই প্রধান দেবতা হলেন নাদাগ (গৃহদেবতা) এবং বোগলি (পানির দেবতা)। জুমচাষ এবং ফসল কাটার পূর্বে এরা নাদাগ পূজা উদযাপন করে। এই পূজার উৎসবে নদীতীরে এরা একটি কুকুর, একটি বন্য শুকর এবং বেজোড় সংখ্যায় মোরগ-মুরগি বলি দেয়। এরা মুরংদের মতো গো-বধ পূজার উৎসব পালন করে। বলির পশু খাওয়ার পূর্বে, রান্না করা মাংসের কয়েকটি টুকরা নদীর তীরে রেখে দেওয়া হয়। খ্রিষ্টান মিশনারিদের দ্বারা কিছু খুমি খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে।

খুমিরা মৃত্যুর পর শব দাহ করে, পরে হাড় ও ছাই সংগ্রহ করে টুকরা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রেখে দেয় এবং পরবর্তীতে উৎসবমুখর আচারানুষ্ঠানের মাধ্যমে তা জঙ্গলে পুঁতে রাখে। শবদেহ যেখানে পোড়ানো হয় সেখানে একটি বাড়ি তৈরি করে সেই বাড়িতে মৃত ব্যক্তির অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ করা হয়।

এদের একটি কথ্য ভাষা আছে তবে লিখিত কোন লিপি নেই। তাদের ভাষা অন্যরা শিখুক সেটা তারা চায় না এবং তারাও অন্য কোন ভাষা শিখতে আগ্রহী নয়। বর্তমানে খুমি ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়। ভাষা-পরিবারের বিচারে, এদের ভাষা সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার-এর অন্তর্ভুক্ত। নিচের এদের ভাষার শ্রেণিবিভাজন দেখানো হলো।

ভাষা পরিবার: সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার
ভাষা পরিবার:
তিব্বত-বর্মীয়
শাখা: সাল
উপ-শাখা: কুকি-চিন-নাগা

গোষ্ঠী: কুকি-চীন
উপগোষ্ঠী: দক্ষিণাঞ্চলীয়

প্রাতিষ্ঠানিক নাম: চীন খুমি বা খুমি চীন (Chin, Khumi  বা Khumi Chin)। সাধারণ নাম খুমি

আএসও: 639-3
ভাষা সংকেত:

cnk – Khumi
cek – Eastern Khumi


তথ্যসূত্র:
http://www.ethnologue.com/language/cnk
http://en.wikipedia.org/wiki/Khumi_language
বাংলাপেডিয়া