ওরাঁও
ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়। উড়িষ্যা ছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড,
মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড় এবং পশ্চিমবঙ্গে এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভারতের বাইরে
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী জেলা) নেপাল
এবং ভুটানে এদের দেখা যায়।
বাংলাদেশে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের লোকগণনায় দেখা যায় যে, উত্তরবঙ্গ ছাড়াও ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলায় কিছুসংখ্যক ওরাওঁ আদিবাসী রয়েছে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ওরাওঁ জনসংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার।
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়:
প্রায় ৬৫ হাজার বৎসর আগে,
আফ্রিকা থেকে নরগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ ধীরে ধীরে অন্যান্য
মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই দলটি
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। এই দলের একটি বড় অংশ
ভারতবর্ষের প্রবেশ করেছিল। ওরাঁও সম্প্রদায় আদি
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড মানব গোষ্ঠীরই একটি ক্ষুদ্র অংশ। এদের গায়ের রং কালো, নাক
অনুচ্চ, চুল কালো
ও কুঞ্চিত, উচ্চতা মাঝারি।
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড মানব হিসেবে এদের সাথে বিশেষ নৃতাত্ত্বিক ঘনিষ্ট সম্পর্ক
রয়েছে মুণ্ডা, মালপাহাড়ি ও সাঁওতালদের সাথে। কিন্তু ভাষার দিক থেকে দ্রাবিড় ভাষা
পরিবারভুক্ত। এই কারণে অনেকে এদেরকে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড-দের
শাখা হিসেবে বিবেচনা করতে চান না।
নামকরণ:
ডা: গ্রিয়াসন এর মতে কুঁড়ুখরা প্রয়োজনের অধিক ব্যয় করতো। ওরাঁও শব্দ উরণ এর
অর্থ অপব্যয়কারী। এই উরন শব্দ থেকে ওরাওঁ শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। ডা: হান এর মতে
হিন্দুরা তাদের ওরাঁও বলে ওরগোড়আ শব্দের উপভ্রংশ হিসেবে। ওরগোড়আ শব্দের অর্থ বাজ
পাখি। বাজ পাখি যেমন একবার ধরে তা আর কোন মতেই ছাড়ে না, তেমনি কুঁড়ুখরা এক জবানির
লোক। তারা নিজেদের ভাষায় বলে 'অন কাত্থানুম সায় কাত্থা আউর সায় কাত্থা ঘি অন
কাত্থা' অর্থাৎ এক কথায় শত কথা আর শত কথায় এক কথা।
ওরাঁওদের ধর্ম
একেশ্বরবাদী এবং বহুদেবতার সংমিশ্রণে এদের ধর্মমত প্রচলিত।
এরা
প্রধান উপাস্য শক্তি হলো ‘ধার্মেস’। ধার্মেস এক এবং অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান
দেবতা। এরা মনে করে, এই জগৎ পূর্বে অন্ধকারময় ছিল এবং ঊর্ধ্বে ও নিম্নে ছিল কেবল
জল। ধার্মেস প্রথমে জলজ ও পরে স্থলজ প্রাণী সৃষ্টি করলেন এবং সবশেষে তিনি মাটির
পুতুল বানিয়ে সেগুলোতে জীবন দান করে মানুষ সৃষ্টি করেন। এই সর্বশক্তিমান সত্তার অবস্থান
সূর্যে। তাই ধর্মীয় প্রায় সকল অনুষ্ঠানে এরা সূর্যকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন
করে। এছাড়া এরা ফসলাদি, অরণ্য,
মহামারী ইত্যাদির জন্য কিছু দেবতাকে মান্য করে। নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি
এরা কিছু স্থানীয় হিন্দুদের দেবতাদেরও পূজা করে। দীর্ঘদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
পাশাপাশি বাস করার কারণে, হিন্দু ধর্মের অনুরূপ কিছু পূজা এদের ধর্মে প্রবেশ করেছে।
উত্তর বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘ভাদু’ উৎসবের সঙ্গে এদের ‘করম’ উৎসবের
মিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কদম শাখাকে ঘিরে অনুষ্ঠিত এ উৎসবটি মূলত বৃক্ষপূজা। ভারতবর্ষে
খ্রিষ্টানদের আসার পর, পাদরীদের প্রচেষ্টায় এদের একাংশ খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে।
এরা ধান চাষকে সামনে রেখে ‘হরিয়ারি’ নামক পূজা করে। এছাড়া ‘সরহৃল’ নাম পূজা-উৎসব
করে ভূমির উর্বরতার জন্য। এছাড়া গাছ, ফুল ও ফলের পূজা তথা উদ্ভিদের পূজাও করে। এরা যাদুশক্তিতে
বিশ্বাস করে। এদের নানাধরনের পূজার ভিতরে বৈশাখে ব্রত-পূজা করে বসুন্ধরা ব্রত নামে
আর
ভাদ্রমাসে ভাদরি পূজা করে। অগ্রহায়ণে এদের পূজার নাম সেঁজুতি আর ফাল্গুনে
সূর্যপূজা করে ইতু পূজা নামে। ইতু পূজা অবশ্য এরা গ্রহণ করেছে সনাতন হিন্দু ধর্ম
থেকে। চৈত্র মাসে সরহৃল পূজা সম্পূর্ণই কৃষিকে সামনে রেখে।
এদের নিজেদের পৌরাণিক কাহিনি মতে, কুঁড়ুখদের আদি পিতা-মাতা ভাই-বোন উরস অর্থাৎ পবিত্র রক্তে জন্ম গ্রহণ করেছে। এই কারণে বংশধরগণ ওরাঁওগণ ঠাকুর নামে পরিচিতি ছিল। সেকালে তারা ব্রাহ্মণদের মতই শ্রদ্ধেয় ছিল। তারা আপন গোষ্ঠীর “খুট” দেবতা এবং ডাণ্ডা কাট্টনা বা ভেলোয়ফারি পূজা অনুষ্ঠান নিজেরাই করতো।
এদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হলো কারাম। ভাদ্র মাসের একাদশীতে এ উৎসব পালন করা হয়। কথিত আছে, একবার উরাঁওরা শত্রুর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাবার সময়, ঘতনাক্রমে শত্রুদের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়ে। তখন তাদের আর বাঁচার পথ ছিল না। তখন কারাম গাছ তার পেটের মধ্যে তাদের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করে। অন্য মতে, একটি পরিবারের সাত ভাই ও এক বোন ছিল। ভাইয়েরা ব্যবসার কাজে গেলে তাদের স্ত্রীরা বোনের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। তারা তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করার পর জঙ্গলে ফেলে আসে। ফলে তাদের দুর্দিন শুরু হয়। তখন থেকে তারা কারাম পূজা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে, ভাইয়েরা ফিরে এসে সকল কাজ-কর্ম ফেলে কারাম পূজা শুরু করে। তাই বড় ভাই একদিন সেই কারাম গাছের শাখা কেটে নদীতে ফেলে দেয়। এই কারণে তাদের জীবনে নানা প্রকার অভিশাপ নেমে আসে। এরপর কারাম শাখাগুলো আবার খুঁজে নিয়ে তারা পূজা শুরু করে। এরফলে তাদের সুদিন শুরু হয়। সেই থেকে উরাঁওরা কারাম পূজা করে আসছে।
মৃতদেহ চিতার আগুনে ভস্মীভৃত করে। মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও শেষকৃত্যের অনুষঙ্গ হিসেবে ফুল ও পাতার নৈবেদ্য প্রদানের প্রথাও প্রচলিত। আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশের রীতিও সমাজে রয়েছে।
সামাজিকতা
ওঁরাওদের সমাজজীবনে সঙ্গীতের একটি বিশাল
প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন ব্রত বা উৎসবে মেয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচ-গান করে। বেশির সময়
পুরুষরা অনুষঙ্গী বাদ্যযন্ত্র বাজায়। ওরাওঁদের সামাজিক
জীবনের একটা গুরূত্বপূর্ণ দিক ‘ধুমকুরিয়া’ নামক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে ওরাওঁ তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের
সাথে
মেলামেশার সুযোগ লাভ করে এবং ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী ও সঙ্গিনী নির্বাচনের অবকাশ তৈরি হয়।
এদের বিবাহ পারিবারিক ব্যবস্থার মাধ্যমে হলেও পাত্রপাত্রীর মতামত সেখানে প্রাধান্য পায়।
তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক
বিবাহ সমাজে সমর্থন পায় না। এদের মধ্যে বিধবা বিবাহ কিংবা ঘরভাঙ্গা বিবাহ
প্রচলিত আছে। বিবাহ বিচ্ছেদও সামাজিকভাবে স্বীকৃত। পুরুষ একাধিকবার বিয়ে করতে
পারে, তবে কোন পুরুষ একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারে না। তবে একই গোত্রের ভিতর
বিবাহ নিষিদ্ধ। ভাইয়ের শশুর শাশুড়ীকে নিজ শশুড়-শাশুড়ীর সমতুল্য মান্য করে। তারা
ভাইয়ের শালাকে ইয়ার এবং শালীকে গুই বলে সম্বন্ধ জুড়ে। স্বামীর বড় ভাইকে
দেবতাতুল্য সম্মান করে, তার ছায়াও স্পর্শ করে না। একই ভাবে স্ত্রীর বড় দিদি
স্বামীর বোয়াসিন হয়, এবং বড় বোনের মতই মান্য করে।
পোশাক
এদের পোশাক অত্যন্ত সাদাসিধা। মেয়েরা মোটা শাড়ি পড়ে। আগে মেয়েরা শরীরের কোনো
অন্তর্বাস পরতো না। বর্তমানে বাঙালি মেয়েদের মতই শাড়ির সাথে ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে।
তবে মেয়েদের ভিতর সাজগোজ পছন্দ করে। ফুল এদের প্রধান অলঙ্কার। নারী-পুরুষ উভয় শরীরে
উল্কিচিহ্ন ধারণ করে। আগে পুরুষরা নেংটি জাতীয় কাপড় কোমড়ে জড়িয়ে রাখতো। বর্তমানে
এরা ধুতি, লুঙ্গি,
গামছা পড়ে। একালের শিক্ষিত সচ্ছল পুরুষরা সার্ট-প্যান্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে।
খাদ্য:
এদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সাথে শাক-সবজি, মাছ বা মাংস আহার করে। এছাড়া ঘরে তৈরি মদ ‘পচাই’ তাদের প্রধান পানীয়।
সাধারণত ভাত পচিয়ে ‘পচাই’ তৈরি করে।
পেশা:
আদিতে এরা ছিল সম্পূর্ণ বনচারী। বর্তমানে এরা পুরোপুরি কৃষিজীবী। হালচাষের মূল
কাজটি পুরুষেরা করে। মেয়েরা শস্য ছাড়াই ও গৃহস্থালী অন্যান্য কাজ করে। বর্তমানে
শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকেই চাকরি বা ব্যবসা করে থাকে।