(Assam District Gazetteers) বা অন্যত্র শ্রীহট্টকে ইংরেজিতেই প্রথম ‘সিলহেট’ (Sylhet) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।১. প্রাচীন গৌড়ের রাজা 'গুহক' তার কন্যা শীলাদেবীর নামে একটি হাট স্থাপন করেন। এ কারণে 'শীলাহাট' থেকে সিলট বা সিলেট নামের পরিচিতি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
২. হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে দক্ষপত্নী সতীর হাড় বা হড্ড উপমহাদেশের ৫১টি স্থানে পতিত হয়েছিল। সতীর দু'টি হাড় সিলেটে পতিত হয়েছিল। সতীর অপর নাম 'শ্রী'। শ্রীর হড্ড- এই অর্থে শ্রীহড্ড। লোকমুখে এই নামটি শ্রীহট্টে পরিণত হয়েছে। এই কাহিনির অন্যরূপ ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। কাহিনীতে পাওয়া যায় দক্ষযজ্ঞের পর, সতীর খণ্ডিত দেহের হাত এই অঞ্চলে পতিত হয়েছিল। এই স্থানে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সতীর 'শ্রীহস্ত' নাম থেকে কালক্রমে শ্রীহট্ট নামে পরিণত হয়। অন্যমতে শ্রী'র (সতী) স্মরণে হট্ট (বাজার) চালু হয়েছিল।
৩. প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ কামাখ্যা তন্ত্র অনুযায়ী প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে প্রাচীন শ্রীহট্ট ছিল। অর্থাৎ শ্রীহট্ট ছিল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত। যোগিনী তন্ত্রে শ্রীহট্টের সীমার বিবরণ এরকম:
- পূর্ব্বে স্বর্ণ নদীশ্চৈব দক্ষিণে চন্দ্রশেখর
- লোহিত পশ্চিমে ভাগে উত্তরেচ নীলাচল
- এতন্মধ্যে মহাদেব শ্রীহট্ট নামো নামতা।
- ৪. খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক এরিয়ান লিখিত বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম "সিরিওট" বলে উল্লেখ আছে। এছাড়া, খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে এলিয়েনের বিবরণে "সিরটে", এবং পেরিপ্লাস অব দ্যা এরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থে এ অঞ্চলের নাম "সিরটে" এবং "সিসটে" এই দুইভাবে লিখিত হয়েছে।
- ৫. ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সিলেটকে শি-লি-চা-ত-ল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
৬. খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম পরিব্রাজক মনিষী আল্ বেরুনীর 'কিতাবুল হিন্দ' গ্রন্থে সিলেটকে 'সীলাহেত' বলে উল্লেখ করা হয়।
৭. ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে আউলিয়া শাহ জালাল গৌড় রাজ্য অধিকার করেন। কথিত আছে হযরত শাহজালাল যখন শ্রীহট্টের দিকে অগ্রসর হন, তখন তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ তাঁকে থামানোর জন্য শ্রীহট্ট সীমান্তে তার কথিত জাদু ক্ষমতার দ্বারা পাথরের দেয়াল বা পাহাড়ের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। হযরত শাহজালালও তার অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে ‘শিল হট্’ বলতেই সেই শিল বা পাথরের প্রতিবন্ধক হটে যায় বা অপসারিত হয়। এ থেকেই এই ভূমির অন্য নাম হয়েছে শিল-হট থেকে সিলেট।
৬. অন্য মতে ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশে মুসলিম সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। মুসলিম শাসকদের দলিলপত্রে "সিলাহেট", "সিলহেট" ইত্যাদি নাম লিখেছেন। এই সূত্রে একসময় সিলেট নামটি প্রচলিত হয়েছে।৭. ব্রিটিশ আমলেই পুরনো সরকারি নথিপত্রে যেমন আসাম গেজেটিয়ারে
পৌরাণিক যুগে এই অঞ্চল প্রাচীন কামরূপ
রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সময় সিলেটের লাউড় পর্বতে কামরূপ রাজ্যের
উপ-রাজধানী ছিল বলে জানা যায়। সম্ভবত এই সময় দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী
এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পর জয়ন্তীয়া, লাউড় ও
গৌড় নামে তিনটি স্বতন্ত্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সে সময়ের গৌড় রাজ্যই সিলেট অঞ্চলে
ছিল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে সিলেট বিভাগের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু
অংশ ত্রিপুরা রাজ্যের আধিকার্ভুক্ত হয়েছিল। এই সময় সিলেটের দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেকাংশ
হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে বিক্রমপুরের চন্দ্রবংশীয় রাজা মহারাজা শ্রীচন্দ্র
কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি এই অঞ্চল জয় করেছিলেন।
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য
দিয়ে এই অঞ্চল মুসলিম-শাসন সম্প্রসারিত হয়।
১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে আউলিয়া শাহ জালাল (রাঃ) গৌড় রাজ্য অধিকার করে। এই অঞ্চলে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। পরে শাহ জালালের নামানুসারে সিলেট শহরের
নামকরণ করা হয় জালালাবাদ।
১৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দে গৌড় পুরোপুরি মুসলিম
শাসনাধীনে চলে যায়। আকবরের শাসনামলে লাউর মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়।
১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্ট, লাউর এবং জয়ন্তীয়া মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে ভৌগোলিক সীমারেখায় এ
অঞ্চলের অনেক পরিবর্তন ঘটে।
১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্ট ও লাউর
ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে আসে।
১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ প্রথম গঠিত হয় সিলেট জেলা গঠিত
হয়। এই সময় এই জেলাটি ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জয়ন্তীয়া ইষ্টইন্ডিয়া
কোম্পানির অধিকারে আসে।
১৮৫৭ খ্রিষ্তাব্দে বিদ্রোহের সময়ে সিলেটে বিদ্রোহীরা ব্রি্রটিশ বেনিয়াদের
বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়। নানকার বিদ্রোহ সিলেটের ইতিহাসে একটি
গুরম্নত্বপূর্ণ ঘটনা। নানকাররা ছিল জমিদারদের ভূমিদাস। নানাকার বিদ্রোহসহ আরও
কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হলে
১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট জেলা ছিল ঢাকা
বিভাগের অন্ত্রভুক্ত। এই বছরেই এই অঞ্চল ভারতের আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তখন জেলাটি আসামের জেলাতে পরিণত করা হয়।
১৯২৭ সালে সিলেটের রাজনীতিবিদগণ (এম.এল.এ গণ) প্রাদেশিক পরিষদে বাংলায় কথা বলার
অধিকার আদায় করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের বড় অংশ নবসৃষ্ট পূর্ব-পাকিস্তানের
অন্তরভুক্ত হয়। এই সময় করিমগঞ্জ, পাথারকান্দি, বদরপুর ইত্যাদি অঞ্চল সিলেট থেকে
বিচ্যূত হয়ে আসাম তথা স্বাধীন ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা হিসেবে
অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
১৯৮৩-৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বৃহত্তর সিলেট জেলার চারটি মহকুমাকে জেলা
হিসেবে ঘোষণা করে। এই জেলাগুলো হলো-
সিলেট জেলা, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট এই চারটি
জেলাকে নতুন বিভাগীয় প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে সিলেট বিভাগ ঘোষণা করা হয়।
এই সময় সিলেট শহরটিকে
সিলেট বিভাগ-এর প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
[দেখুন:
সিলেট বিভাগ ]