হার্ডিঞ্জ
ব্রিজ
ইংরেজি :
Hardinge
Bridge।
স্থানীয় নাম: সাঁড়ার পুল।
বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিঃ মিঃ দক্ষিণে, পাকশী রেল-স্টেশন সংলগ্ন পদ্মা নদীর তীর এবং কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারার পদ্মার তীরের মধ্যবর্তী একটি রেলসেতু। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু হিসেবে পরিচিত। এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৫৮৯৪ ফুট। এর স্প্যান সংখ্যা ১৫। এর উপর দু'টি ব্রড-গেজ রেললাইন রয়েছে। সেতুটি নির্মাণকাল ১৯০৯-১৯১৫। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের (Lord Hardinge) নামানুসারে এই সেতুর নামকরণ করা হয়।
সেতু নির্মাণের লক্ষ্য ও নির্মাণকাল
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে এই সেতু নির্মাণের আগে, আসামের সাথে কলকাতার যোগাযোগের জন্য
বড় বাধা ছিল পদ্মা নদী। এই সময় পদ্মার এক পাড়ে ছিল ভেড়ামারার (বর্তমানে কুষ্টিয়া
জেলার অংশ) দামুকদিয়া-রাইটাঘাট, অন্য পারে ছিল পাবনা জেলার পাকশির সাঁড়াঘাটা। মূলত
পাকশির ঘাটটি ছিল বেশ জমজমাট। সে সময়ে এই দুটি ঘাটকে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ
নৌবন্দরের সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে পদ্মা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর নদী হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিশেষ করে বর্ষার সময়ে এই ভয়ঙ্কর রূপ বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। প্রতি বৎসরই বহু
বাণিজ্যিক এবং যাত্রীবাহী লঞ্চ, ইষ্টিমার, বজরা ডুবে যেতো। সে সময়ে দার্জিলিং ও
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে দেশী-বিদেশী পর্যটক যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের
সুবিধার্থে কাঠিহার থেকে রেলপথ আমিনগাঁ আমনুরা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে
অবিভক্ত ভারত সরকার, পদ্মা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাব
অনুসারে, সেতুটির নির্মাণ কার্যক্রম যেভাবে অগ্রসর হয়, তা হলো–
![]() |
|
উদ্বোধন করছেন ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। |
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথমে মালগাড়ি (ট্রেন) চালানো হয়। সেতুর আপ লাইনে পরীক্ষামূলক প্রথম ট্রেন চালানো হয় ২৫শে ফেব্রুয়ারি। ৪ঠা মার্চ সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এই দিন থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করে। উদ্বোধন করেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ।
এই সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১
লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা। এর মধ্যে স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭৯৬ টাকা,
ল্যান্ড স্প্যানের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮৪৯ টাকা, নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ
৮ হাজার ৩৪৬ টাকা ও দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ টাকা।
সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
সেতুর ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মার্টির
নিচে। এর মধ্যে ১৫ নম্বর স্তম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানি নিম্নসীমা থেকে ১৫৯
দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থাৎ সমুদ্রের গড়
উচ্চতা থেকে ১৪০ ফুট নিচে। সে সময় পৃথিবীতে এ ধরনের ভিত্তির মধ্যে এটাই ছিল গভীরতম।
বাদবাকি ১৪টি কুয়া বসানো হয়েছে ১৫০ ফুট মাটির নিচে।
এই সেতু নির্মাণের কৌশল এবং সৌন্দর্যের বিচারে চিফ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট উইলিয়াম গেইলসকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
![]() |
|
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বরে পাক-বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হার্ডিঞ্জ সেতু |
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে
পাক-ভারত বিভাজনের সময়, সেতুটি পূর্ব-পাকিস্তানে পড়ে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর
মাসের ১০ তারিখের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে ঢাকার
দিকে পিছু হটতে থাকে। ১১ই
ডিসেম্বর রাতে মিত্র বাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে, পাকিস্তানী সৈন্যরা
হার্ডিঞ্জ ব্রীজ দিয়ে পাবনার দিকে চলে যায়। এই সময় তারা মিত্র বাহিনীর অগ্রগতি রোধ
করার জন্য মাইন দ্বারা সেতুটি ক্ষতিগ্রস্থ করে।
এর ফলে ১২ সংখ্যক
স্প্যানটি সেতু থেকে খুলে নদীতে পড়ে যায়। এছাড়া ৯ সংখ্যক স্প্যানটির নিচের দিকটা
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ব্রিটিশ সরকার অতি দ্রুততার সাথে তাদের নিজ খরচে এবং
বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকোকে-
মাধ্যমে এর স্প্যান উদ্ধার করে। সেতুটি মেরামতের জন্য, ভারত বিশেষভাবে সহায়তায় করে।
সেতুটির মেরামতে ভারতের পূর্ব
রেলওয়ে শ্রী এইচকে ব্যানার্জি, চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী আরকে এসকে সিংহ রায়, ডিভিশনাল
ইঞ্জিনিয়ার, শ্রী পিসিজি মাঝি, এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া
বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী,
ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মো. ইমাম উদ্দিন আহমেদ, ডিভিশনাল সুপার এম রহমান প্রমুখ।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর পুনরায় এই সেতুর উপর দিয়ে রেল চলাচল শুরু হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ
রেলওয়ে এই সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।