- আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরি' গ্রন্থে "হুগলি" নামটির সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় এবং উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম) ও হুগলি বন্দর দু’টির ব্যবধান ছিল মাত্র আধ ক্রোশ এবং দুই বন্দরই ছিল বিদেশিদের প্রভাবাধীন। আইন-ই-আকবরি-র অল্পকাল পরে লেখা পর্তুগিজ লেখক ফারিয়া সোউজারের গ্রন্থে "গোলিন" নামটি পাওয়া যায়।
- ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে হিউগেস ও পার্কারের পত্রাবলিতে হুগলিকে "গোল্লিন" নামে অভিহিত করা হয়েছে।
- ১৬৬০ ওলন্দাজ লেখক মাথুজ ফান দেন ব্রুক এই অঞ্চলটিকে "Oegli" ও "Hoegli" নামে উল্লেখ করেছেন। এই দুটি নাম "হুগলি" নামটির প্রায় অনুরূপ।
হুগলিতে পরতুগিজ বসতি
স্থাপন ও তাদের দুঃশাসন
১৫১৭ সালে পর্তুগিজরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বঙ্গদেশে আসে।
১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পর্তুগিজরা বঙ্গদেশে তাদের বাণিজ্যের সম্প্রসারণে বিশেষ
উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ শাহের দেওয়া সনদের বলে পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামে
বৈধভাবে ব্যবসা শুরু করে।
এই সময় ভাগরথীর অগভীর জলে তাদের বড় বড় বাণিজ্যিক-জাহাজ প্রবেশ
করতে পারতো না। তাই তারা মুচিখোলা নামক স্থানে বড় বড় জাহজগুলো নোঙর করতো। তারপর ছোটো
ছোটো নৌকায় তাদের পণ্য সপ্তগ্রামে নিয়ে আসতো। এরপর ধীরে ধীরে গঙ্গার গতিপথ
পরিবর্তিত হতে থাকলে, সপ্তগ্রামে পণ্য পরিবহনে ব্যাপক অসুবিধার সৃষ্টি হতে থাকে। এই
অসুবিধা দূরীকরণের জন্য ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রায়ো নামক জনৈক পর্তুগিজ ব্যবসায়ী
বর্তমান হুগলি অঞ্চলে একখণ্ড জমি ক্রয় করেন। এই স্থানের তিন দিকে নদী ও বিল থাকায়,
এই স্থানে পণ্যের সরবরাহ সহজ হয়ে পড়েছিল। এই সূত্রে ধীরে ধীরে এই স্থানটি
পর্তুগিজদের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
কালক্রমে একটি বন্দর নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এই সময় বাবুগঞ্জ, ব্যান্ডেল, পিপুলবাতি
অঞ্চলে বিভিন্ন আদিবাসি জনগোষ্ঠীর মানুষ এসে নগরকেন্দ্রিক নানা পেশায় যোগদান করেছিল।
এদের ভিতরে ছিল- নাগর, ধানুক, ঢাঁই, কোচ. পলে ইত্যদি জনগোষ্ঠীসমূহ। এরা নিম্নস্তরে
পেশায় কাজ করতো। এছাড়া সম্রাট আকবরের আনুকুল্য লাভকারী পর্তুগিজরে কোনো কোনো
ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করতো। এছাড়া এরা গঙ্গার দুই পারে
বসতি স্থাপন করার সুবাদে নৌপথে চলাচলকারী সকল নৌকাতে শুল্ক আদায় করতো। মাঝে মাঝে
স্থানীয় বালক-বালিকাদের অপহরণ করে দাস-ব্যবসা করতো। সুযোগ পেলেই পার্শ্বর্তী
গ্রামগুলোতে লুণ্ঠন করতো। এক্ষেত্রে তারা নরহত্য এবং ধর্ষণের মতো অপকর্মও করতো।
ভাগীরথী নদীর দুই পারে পর্তুগিজদের এই লুণ্ঠন কাজ চলতো বলে- এক সময় ভাগরথী নদীকে 'দস্যু-নদী'
বলা হতো।
বাণিজ্যিক কারণে হুগলীর আশপাশ জুড়ে বিদেশী বণিকদের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র পরিণত
হয়েছিল। যেমন ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর দিনেমার বণিকরা বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ হুগলি বন্দরে ব্যবসা শুরু করে। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগরে ফরাসিদের
বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ৭মে চুঁচুড়া ইংরেজদের দখলে চলে যায়। ১৯৫০
খ্রিষ্টাব্দের ২রা মে চুঁচুড়া শহর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারের কর্তৃত্বাধীন আসে।
১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা প্রশাসনিক কারণে হুগলি জেলা তৈরি করেছিল। তখন হাওড়া হুগলি জেলার অংশ ছিল।
১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে হাওড়া স্বতন্ত্র জেলা
তৈরি করা হয়েছিল।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন এই জেলার ঘাটাল ও চন্দ্রকোনা থানা মেদিনীপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে
হুগলী নদীর
পারে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি জেল।
১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান
জেলার কিয়দংশ বিচ্ছিন্ন করে হুগলী জেলা গঠিত হয়েছিল। এই জেলার উত্তরাংশের কয়েকটি
পরগণা আবার হুগলী জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে
জেলাটিতে ৪টি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো- চুঁচুড়া সদর, চন্দননগর, শ্রীরামপুর ও আরামবাগ।
সূত্র :