মঙ্গোলিয়া
Mongolia
![]() |
পতাকা |
মধ্য
এশিয়ার
একটি স্থলবেষ্টিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মঙ্গোলিয়ার মোট আয়তন
১৫,৬৪,১১৬ বর্গ কিঃমিঃ (৬,০৩,৯০৯ বর্গ মাইল)। এর উত্তরে রাশিয়া ও দক্ষিণ, পূর্ব
এবং পশ্চিমে গণচীন অবস্থিত। এর রাজধানীর নাম উলানবাটোর। এর পূর্ব নাম ছিল উর্ঘাট।
জনসংখ্যা: ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে দেশটির লোক সংখ্যা ৩০,৮১,৬৭৭
জন। দেশটির জনসংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ২ জন। নগরেগুলোতে বাস করে প্রায়
৫৯%।
ধর্ম: অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সামান্য কিছুই সনাতনধর্মী মানুষ আছে।
মঙ্গোলিয়ার ভাষা
মঙ্গোলিয়ান ভাষার মূলত এই ভাষার খালখা উপভাষা হলো মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রভাষা।
মঙ্গোলিয়ার প্রায় ৯০ ভাগ লোক এই উপভাষায় ভাষায় কথা বলে। মঙ্গোলীয় ভাষা তিনটি
ভিন্ন ধরনের লিপিতে লেখা হয়। এগুলো হলো- খ্রিষ্টীয় ১৩শ শতকে উদ্ভাবিত ঐতিহ্যবাহী
মঙ্গোলীয় লিপি, ১৯৪০-এর দশকে সাম্যবাদের সাথে আগত সিরিলীয় লিপি, এবং অধুনা ১৯৯০
খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি শব্দ ও পদগুচ্ছ লেখার কাজে ব্যবহৃত হয় লাতিন লিপি।
মঙ্গোলীয় ভাষা ছাড়াও আরও ১০টি ভাষা মঙ্গোলিয়াতে প্রচলিত রয়েছে। চীন ও রাশিয়ার
মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে এই দুই ভাষার প্রভাব রয়েছে এই ভাষায়। এছাড়া ম্যান্ডারিন চীনা
ভাষায় ৩৫ হাজার, ও রুশ ভাষায় ৪ হাজার লোক কথা বলেন।
মঙ্গোলিয়ার ভূপ্রকৃতি:
মঙ্গোলিয়া পাহাড় ও সমতলভূমির
মিশ্রিত একটি দেশ। দেশটি মোট তিনটি পাহাড় রয়েছে। এর ভিতরে সর্বিচ্চ
পর্বতমালাটি হলো আলতাই (২০০০-৩০০০ মিটার)। এই পাহাড়টি পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম
মঙ্গোলিয়ার উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর বিস্তৃত। এরপরে রয়েছে খানগাই
পর্বতমালা। এই পর্বতমালাটি মধ্য ও উত্তর-মধ্য মঙ্গোলিয়াতে অবস্থিত। এই পর্বতমালা
ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে উচ্চ সমতল ও ঢালের সমন্বয়ে বিস্তৃত প্রান্তর সৃষ্টি করেছে। এই
প্রান্তরে অরণ্য ও চারণভূমি দেখতে পাওয়া যায়। অন্য পার্বত্য এলাকটি রয়েছে রুশ
সীমান্তের কাছে। এর নাম খেনতিল পর্বতমাল। এর উচ্চতা খুব বেশি নয়। পার্বত্য এলাকা
বাদ দিলে দেখা যায়- পূর্ব মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ এলাকা সমতল। এই সমতলভূমি এটি গোবি
মরুভূমির সাথে মিশে গেছে। মূলত দেশটির এক-তৃতীয়াংশ ভূভাগ এই গোবি মরুভূমি অধিকার
করে আছে।
জলবায়ু: মঙ্গোলিয়াকে শীতপ্রধান দেশ বললেই চলে। কারণ গ্রীষ্মকালে এখানে
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৬-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতরে থাকে। অন্যদিকে শীতকালে
তাপমাত্রা -২৬ থেকে -৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভিতরে উঠানামা করে। দেশটিতে বার্ষিক গড়
বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ২০৮ মিলিমিটার।
নদী:
সেলেঙ্গে নদী মঙ্গোলিয়ার প্রধান নদী। এছাড়া ছোটখাট ঝর্না ও অপ্রশস্ত নদী রয়েছে
কিছু।
অর্থনীতি: আদিকাল থেকে মঙ্গোলিয়ানদের পেশা পশুপালন। এই কারণে মঙ্গোলিয়ানদের প্রধান উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় রয়েছে দুগ্ধ, মাংস, উল। বর্তমানে মঙ্গোলিয়ায় কৃষি, বস্ত্র ও খনিজপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। খনিজ সম্পদের ভিতরে রয়েছে কয়লা, সোনা, ইউরেনিয়াম উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ। এদের মুদ্রার নাম টুগৃক।
মঙ্গোলিয়ার ইতিহাস: মঙ্গোলিয়ার
সুপ্রাচীন অতীত সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী
মঙ্গোলিয়ার আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো। এরা ছিল দুর্ধষ যোদ্ধা। এরা মূলত
ছিল অশ্বারোহী তীরন্দাজ যোদ্ধা। দ্রুতবেগে এরা কোনো অঞ্চল আক্রমণ করে ব্যাপক হত্যা
ও লুট তরাজের মধ্য দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতো। এই সময় মঙ্গোলিয়ার কোনো একক কোনো
রাজশক্তির উদ্ভব হয় নি। এশিয়ান স্তেপের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী আদি জিয়োংনু (Xiongnu)
গোষ্ঠীর নেতা মোডু চানিয়ু (Modu Chanyu)
খ্রিষ্টপূর্ব ২০৯ অব্দে একটি শক্তিশালী সেনাবহিনী তৈরি করে জিয়োংনু সাম্রাজ্য
স্থাপন করেন। এই সময় ইয়ুয়েঝি (Yuezhi)
নামক একটি গোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসবাস করতো।
জিয়োংনু সম্রাট এদের পরাজিত করে, মধ্য এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য
বিস্তার করতে সক্ষম হন। এরই মধ্য দিয়ে বর্তমান মঙ্গোলিয়ার প্রাথমিক রূপ ফুটে
উঠেছিল। ক্রমে ক্রমে এরা সাইবেরিয়া, মধ্য মঙ্গোলিয়া, বর্তমান চীনের গানসু এবং
জিংজিয়াং প্রদেশ নিয়ে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ২১৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনের কিন
সাম্রাজ্যের রাজা, জিয়োংনু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে- তারা এই আক্রমণ
সাফল্যের সাথে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এই সময়ে এই অঞ্চলের দুটি প্রধান রাজশক্তি ছিল
চীনের হান সাম্রাজ্য এবং মঙ্গোলিয়ার জিয়োংনু সাম্রাজ্য।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে হান রাজবংশের রাজা গাওজু
(Gaozu), জিয়োংনু
সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বাইডেং-এর যুদ্ধে জিয়োংনু সেনাবাহিনী
সম্রাট গাওজুর সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এরপর সম্রাট গাওজু, সন্ধির জন্য
সম্রাট মোডুর কাছে কনে হিসেবে একজন রাজকন্যাকে প্রেরণ করে। মোডু চীনা রাজকন্যাকে
বিবাহ করে এবং হান সাম্রাজ্য আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৫ অব্দে গাওজু
মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র লিউ ইং রাজত্ব লাভ করেন। খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ১৯৫ অব্দে
মোডু তার গাওজু'র বিধবা স্ত্রী সম্রাজ্ঞী লু ঝি-কে দাবি করেন। তবে মোডু'র এই দাবি
পূরণ করা হয় নি। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৮ খ্রিষ্টাব্দে লিউ ইং-এর মৃত্যর পর, সম্রাট হন
কিয়ানশাও। প্রতি নয় বৎসর অন্তর হান সম্রাট মোডুকে প্রীতি উপহার পাঠাতেন এবং
যুদ্ধবিরতি চুক্তি নবায়ন করতেন। প্রতিবারই সম্রাট মোডুকে উপহারের পরিমাণ বাড়ানো
হতো। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ মোডু মৃত্যুবরণ করেন। মোডুর মৃত্যর পর, আঞ্চলিক
বিভাজনের সূত্রে জিয়োংনু সাম্রাজ্য দুটি ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়।
১৪৭ থেকে ২৪৩ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত এরপর
জিয়ানবেই (Xianbei state)
শাসকগোষ্ঠী তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের এদের
পরাজিত করে রৌরান খাগানাতে (Rouran
Khaganate) রাজ্য স্থাপন
করে।
৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এরা তাঁদের এদের রাজত্ব বজায় রাখতে সক্ষম
হয়েছিল। এরপর শুরু হয় তুর্কিক (Turkic)
শাসনামল। এদের শাসনকাল ছিল ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মঙ্গোলিয়ার শাসন চলে যায়
খিতান রাজ্যের হাতে (Khitan state)
রাজ্যের হাতে। এদের শাসনকাল ছিল ৯০৬ থেকে ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
এরপর ধীরে ধীরে মঙ্গোলিয়ার শাসকদের ক্ষমতা অনেকাংশে লোপ পায়।
মঙ্গোলিয়া তখন অনেকাংশ
হয়ে পড়েছিল বড় বড় গোষ্ঠীদের অধীনস্থ শাসন ব্যবস্থায়। এরপর মঙ্গোলিয়া রাজনৈতিক
অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন
চেঙ্গিশ খান। তিনি বিচ্ছিন্ন
গোষ্ঠীর শক্তিকে একত্রিত করে একটি প্রবল
রাজশক্তিতে পরিণত করেছিলেন। শুরু দিকে
চেঙ্গিশ খানকে নানা প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে বড় হয়ে উঠতে হয়। বিশেষ করে, তিনি
বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সাথে সংগ্রাম করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। ১২০৪
খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিস খানের বাহিনী মঙ্গোলীয় জাতির পশ্চিম অঞ্চলের শেষ উপজাতির
সঙ্গে লড়াই হয়। দু'পক্ষের মধ্যে লড়াই চলেছিল প্রায় এক মাস ব্যাপী। এই
যুদ্ধে চেঙ্গিস খানের বাহিনী জয়লাভ করে। এই উপজাতির সর্বোচ্চ নেতা আত্মসমর্পন করলে,
চেঙ্গিস খানের নাম গোটা মঙ্গোলীয় মালভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি গোটা মঙ্গোলীয়
মালভূমির জমি তার আত্মীয়স্বজন ও ছোট-বড় নেতাদের মাঝে বণ্টন করে দেন। এছাড়া ১৬ বছর
বেশি এবং ৭০ বছর কম বয়সী পুরুষ মানুষদের তিনি সেনাবাহিনীতে নেন। এই সৈনরা শান্তির
সময় তারা চাষাবাদ করতো এবং যুদ্ধের সময় করতো যুদ্ধ।
চেঙ্গিশ খানের আমলে মঙ্গোলিয়ার
বেশিরভাগ অংশ ছিল
চীনের অধীনে। তিনি
চীন সম্রাটের সাথে যুদ্ধ করেন
এবং চীনা বাহিনীকে পরাজিত করে, স্বাধীন মঙ্গোলিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি
দিগ্বিজয়ের জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ১২২৫ ভিতরে তিনি পীত সাগর
থেকে শুরু করে ইরান, ইরাক, এবং দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল
মঙ্গোলদের শাসনাধীনে চলে আসে।
চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর তাঁর
উত্তরসূরীদের সাথে চীন সম্রাটের সীমান্ত সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। পরে
কুবলাই খান
ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র চীন মঙ্গোল শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হন এবং তাঁর মাধ্যমে চীনের
ইউয়ান রাজবংশের সূচনা হয়।
১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে
ইউয়ান রাজবংশের পতন
হলে মঙ্গোলদের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে চীন মঙ্গোলিয়া দখল
করে নেয়। এরপর মঙ্গোলিয়া চীনের প্রদেশে পরিণত হয়। পরে মঙ্গোলিয়া দুটি ভাগে বিভাজিত
হয়ে গিয়েছিল। এর ভাগ ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন, অপর ভাগ ছিল স্বাধীন মঙ্গোলিয়া। পরে
চীন ও রাশিয়ার সীমান্ত মীমাংশার সময়, মঙ্গোলিয়া উভয় রাষ্ট্রে মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে
পরিণত হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে মাঞ্চু রাজবংশের পতনের পর, রাশিয়ার দ্বারা মঙ্গোলিয়ায়
জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন স্বাধীন মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার সহায়তায় মঙ্গোলিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন মঙ্গোলিয়ায় রাশিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯৩৯
খ্রিষ্টাব্দে জাপান মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মঙ্গোলিয়া
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে, রুশ প্রভাবাধীনে থেকে যায়। ১৯৬১
খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘে যোগ দেয়।