ভিয়েৎনাম যুদ্ধ
ইংরেজি:
Vietnam War

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভিয়েৎনাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে সংঘটিত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ। এর অপর নাম দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের একপক্ষে ছিল উত্তর ভিয়েৎনামের জনগণ ও ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং অন্যপক্ষে ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনাবাহিনী ও মার্কিন সেনাবাহিনী।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভিয়েৎনামের জনগণ ফরাসি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য যুদ্ধ করেছিল। এই যুদ্ধকে বলা হয় প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের শেষে ভিয়েৎনাম ফারাসি শাসন থেকে মুক্ত হয়। কিন্তু ভিয়েৎনামকে তখন উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই বিভাজনে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পুষ্ট দল উত্তর ভিয়েৎনামের নিয়ন্ত্রণ পায়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েৎনাম পায় সমাজতন্ত্র-বিরোধী দল। উত্তর ভিয়েৎনামের শাসকরা উভয় ভিয়েৎনাম একত্রিত করে একটি অখণ্ড ভিয়েৎনাম গঠনের জন্য চেষ্টা শুরু করেছিল। এই সময় উত্তর ভিয়েৎনামের এই উদ্যোগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাণপণে বাধা দেওয়া শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল যে, যদি উভয় ভিয়েৎনাম মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়, তা হলে সমাজতন্ত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এবং এই সূত্রে ওই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবে একই সাথে সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। এই ভাবনা থেকে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েৎনাম সরকারকে সহায়তা দেওয়া শুরু করে এবং ক্রমে ক্রমে এই যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়ে।

দক্ষিণ ভিয়েৎনামের সাধারণ মানুষদের একটি বিশাল অংশ সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি অনুরক্ত ছিল। দক্ষিণ সরকার সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের উপর নিপীড়নমূলক আচরণ শুরু করে। এরই প্রতিবাদে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আন্দোলন শুরু হয়।  ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে 'ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট' নামে একটি দল গঠিত হয়। ধীরে ধীরে এই বিরোধিতা যুদ্ধে পরিণত হয়। প্রায় পাঁচ বৎসর ভিয়েৎনামের অভ্যন্তরীণ এই সংঘাতের পর দক্ষিণ ভিয়েৎনামের পরাজয় স্পষ্ট হয়ে উঠে।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন রোধকল্পে সেখানে সৈন্য পাঠায়। এর ফলে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ভিয়েৎনামের উল্লেখযোগ্য অঞ্চল নিজেদের অধিকারে আনতে পারলেও, বামপন্থীদের গেরিলা আক্রমণের মুখে পড়ে, মার্কিন সৈন্যরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে।


১৯৬৮
খ্রিষ্টাব্দে নিক্সন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভিয়েনামে যুক্তরাষ্ট্রের নৃশংসতা বেড়ে যায়। এই সময় মার্কিন সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করে।  এই যুদ্ধে মার্কিন বিমান বাহিনী নাপাম বোমা নিক্ষেপ করে, চরম নৃসংশতার পরিচয় দেয়। এই বৎসরের ১৬ মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে মার্কিন সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায়। ধারণা করা হয়, এই সময় প্রায় পাঁচশ লোক এতে নিহত হয়।

মার্কিন সৈন্যরা নির্মমভাবে গেরিলা এবং সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করেও এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সম্মানজনক উপায় বের করার চেষ্টা করে। এই
লক্ষ্যে তারা সমাজতান্ত্রিক যোদ্ধাদের সাথে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশ্যে এবং গোপনে বেশ কিছু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করা হয়। এই সময়ে ভিয়েৎনামের পক্ষ থেকে জুয়ান থুই, লি ডাক থো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আলোচনা করেন।  এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জানুয়ারি, প্যারিসে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে - ৮০দিনের মধ্যে ছিল মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া, যুদ্ধবিরতি কার্যকৱর করা এবং  দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া। ২৩ জানুয়ারি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, কিছু অঞ্চলে তখনও যুদ্ধ চলছিল। ইতিমধ্যে ২৯ মার্চের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা প্রত্যাহার করে। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল। এরই সূত্রে উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মে ও জুন মাস পর্যন্ত কিসিঞ্জার এবং থো শান্তি চুক্তির উত্তরণে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জুন,  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর ভিয়েতনাম যৌথভাবে প্যারিস চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাক্ষর করে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সাম্যবাদী শাসনের অধীনে দুই ভিয়েৎনাম একত্রিত হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি সরকারীভাবে ভিয়েৎনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করে।

এই যুদ্ধে প্রায় ৩২ লক্ষ ভিয়েতনামি মারা যান। এর সাথে আরও প্রায় ১০ থেকে ১৫ লক্ষ লাও ও ক্যাম্বোডীয় জাতির লোক মারা যান। আর মার্কিনীদের প্রায় ৫৮ হাজার সেনা নিহত হন।

ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময় সপ্তম নৌবহরকে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশেষ করে এই নৌবহর থেকে পরিচালিত হতো ভিয়েৎনামের অভ্যন্তরে বিমান আক্রমণ। ভিয়েৎনামের পাহাড়ি জঙ্গলময় অঞ্চলে সৈন্য সরবরাহ, সৈন্যদের রসদ যোগানো, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো জায়গায় আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা হতো নানা ধরনের প্রায় ১২০০০ হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছিল। অবশ্য প্রায় ৫০০০ হেলিকপ্টার ভিয়েৎনামী গেরিলারা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য হেলিকপ্টার ছিল-