ভিয়েৎনাম
ইংরেজি:
Vietnam।
সরকারী নাম ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
এই দেশটি ইন্দোচীন উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে
চীন গণপ্রজাতন্ত্র, পশ্চিমে
লাওস ও কম্বোডিয়া, দক্ষিণ ও পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগর। স্থানাঙ্ক: ২১°২′উত্তর ১০৫°
৫১ ′পূর্ব। মোট আয়তন ৩,৩১,২১০ বর্গ কিলোমিটার (১,২৮,৫৬৫ বর্গমাইল)।
এর রাজধানী হ্যানয়। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে শহরের সীমানা বাড়িয়ে
পার্শ্ববর্তী হা তাই প্রদেশের পুরোটা এবং হোয়া বিনহ এবং ভিং ফুক প্রদেশের কিছু অংশ
হানয়ের অংশে নেওয়া হয়েছে। দেশের বৃহত্তম শহর হো চি মিন সিটি।
ভাষা : ভিয়েতনামের সরকারী ভাষা ভিয়েৎনামিজ। এছাড়াও ভিয়েতনামে আরও প্রায়
৭০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে তাই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাতে ১০ লক্ষাধিক ব্যক্তি কথা
বলেন।
খমের ভাষা এবং মুওং ভাষা-তে আরও প্রায় ১০ লক্ষ করে লোক কথা বলেন। চীনা ভাষার
ইউয়ে উপভাষাতে প্রায় ৫ লক্ষ লোক কথা বলেন। দীর্ঘদিন ফরাসি উপনিবেশ থাকার কারণে
ফরাসি ভাষা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়।
এই দেশটির আকৃতি অনেকটা ইংরেজি এস (s) অক্ষরের মত। এটি উত্তরে
চীন গণপ্রজাতন্ত্রের সীমান্ত
থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে থাইল্যান্ড উপসাগর পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৫০০
কিলোমিটার বিস্তৃত। দেশের সবচেয়ে সরু অংশ দা নাং বন্দর শহরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত।
এখানে পূর্বের সাগর থেকে পশ্চিমের সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার।
ভিয়েতনাম ৫৮টি প্রদেশ এবং ৫টি মিউনিসিপাল শহর নিয়ে গঠিত। মিউনিসিপালিটিগুলি হলো−
কান থাও, হাইফং, দা নাং, হানয় এবং হো চি মিন শহর।
চারটি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে ভিয়েৎনাম গঠিত। এই অঞ্চলগুলো হলো−
ভিয়েৎনামের নদ-নদী:
ভিয়েতনামের দুইটি প্রধান নদী হল উত্তরের লোহিত নদী এবং দক্ষিণের মেকং নদী।
দুইটি নদীই সম্পূর্ণ নাব্য। লোহিত নদী দক্ষিণ চীন থেকে উৎপত্তি লাভ করে
দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ভিয়েতনামের উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য উচ্চভূমিতে
প্রবেশ করে সাগরে পতিত হয়েছে। অন্য দিকে চীনের তিব্বত উপত্যাকা থেকে উৎপন্ন
মেকং নদী
এবং টোনলের সাথে মিলিত হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ব্যাস্যাক
(Bassac)
নামক একটি শাখা নদী বের হয়ে ভিয়েৎনামে প্রবেশ করেছে। উত্তর দিক দিয়ে মূল
মেকং নদী
কিছুটা ঘুরে ভিয়েৎনামে প্রবেশ করেছে। আর এই দুই নদীর স্রোত ধারা মিলিত হয়ে তৈরি
করেছে মেকং বদ্বীপ। উভয় নদী দক্ষিণ চীন সাগরে পতিত হয়েছে।
অতীতে মেকং ব-দ্বীপ অববাহিকাতে চাষাবাদ বেশ
কষ্টসাধ্য ছিল। সে সময় দক্ষিণ চীন সাগরের লবণাক্ত পানি প্রায়ই নিম্নভূমিগুলিকে
প্লাবিত করতো। সাগরের পানি প্রবেশ রোধ করার জন্য ফরাসিরা ২০শ শতকে এখানে বাঁধ
নির্মাণ করে। বর্তমানে বাঁধ ও খালের সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে মেকং ও লোহিত নদীর
ব-দ্বীপগুলিতে প্লাবন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভিয়েতনামের অন্যান্য নদীর মধ্যে হুয়ে
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হুওং নদী এবং ভিনহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয় কালং
নদী উল্লেখযোগ্য।
ভিয়েৎনামের সামুদ্রিক তটভূমি:
ভিয়েৎনামের দক্ষিণ ও পূর্বে দক্ষিণ অংশ জুড়ে রয়েছে চীন সাগর। এর সমুদ্র তটরেখা
উত্তরে চীন সীমান্ত থেকে দক্ষিণে থাইল্যান্ড উপসাগরে ক্যাম্বোডিয়ার সাথে সীমান্ত
পর্যন্ত ৩,৪৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির পূর্বে এবং লোহিত
নদীর ব-দ্বীপের উত্তরে পর্বতমালা সাগরের একেবারে তীর ঘেঁষে উঠে গেছে। এর ফলে জাহাজ
পরিবহনের জন্য অনুকূল এবং বেশ কিছু সুরক্ষিত প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় সৃষ্টি হয়েছে।
এদের মধ্যে দা নাং, কুই ন্হোন এবং ন্হা ট্রাং বন্দর শহরগুলি উল্লেখযোগ্য।
পর্বতগুলি উপকূল এলাকায় সুন্দর পটভূমির সৃষ্টির কারণে দা নাং ও ন্হা ট্রাং
ভিয়েতনামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলির অন্যতম। বাকী তটভূমিগুলি মূলত
নদীর বয়ে নিয়ে আসা পলি নিয়ে গঠিত সমতল, ত্রিভুজাকৃতির ব-দ্বীপ।
ভিয়েৎনামের সামুদ্রিক জলবায়ু:
ভিয়েৎনামের জলবায়ু মূলত উষ্ণ ও আর্দ্র। মধ্য ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঋতুভেদে
জলবায়ুর পরিবর্তন সামান্য লক্ষ্য করা যায়। এখানে মূলত শুষ্ক ও বর্ষা এই দুই ধরনের
ঋতু বিদ্যমান।
মেকং নদীর অববাহিকায় জানুয়ারিতে তাপমাত্রা ১৭-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জুলাই
মাসে ২২-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। মধ্যভাগের উপকূলে তাপমাত্রা জানুয়ারিতে
১৮-২৮ ডিগ্রি এবং জুলাইতে ২৪-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। উত্তরের সমভূমিতে ঋতুভেদে
জলবায়ুর পার্থক্য অনেক বেশি এবং রাতের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। এই অঞ্চলে
জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি বা তার নিচে থাকে। জুলাই মাসে তাপমাত্রা
২৫-ঊর্ধ্ব ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। ভিয়েৎনামে প্রায় সারা বৎসরই প্রচুর
বৃষ্টিপাত হয়। দক্ষিণ ও মধ্য তবে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালীন সময়ে
বৃষ্টিপাত বেশি হয়।
মেকং নদীর
অববাহিকাতে মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয়। মধ্য
ভিয়েৎনামে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। উত্তর ভিয়েৎনামেও
প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। মধ্যভাগের উপকূলে মাঝে মাঝে
টাইফুন আঘাত হানে।
পরিবহন ব্যবস্থা
ভিয়েৎনামে মোট ২,৬৫২ কিমি দীর্ঘ রেলপথ ও ১৭,২৯৫ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়কপথ আছে।
১৭টি বেসামরিক বিমানবন্দর আছে, যার মধ্যে ৩টি আন্তর্জাতিক। ভিয়েৎনামের
সড়কব্যবস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভাল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রেলব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল।১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে
ভিয়েৎনাম সরকার দেশের ট্রাকব্যবস্থা ও রেলব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করার কাজ হাতে নেয়।
তবে এখনও দেশের বেশির ভাগ পণ্য নদী ও খালপথে বার্জের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিবহনের জন্য বন্দরগুলির মধ্যে হাইফং, দা নং, এবং হো চি মিন শহর
উল্লেখযোগ্য।
সামাজ ও সংস্কৃতি
চাষাবাদ
চীনা ও ভিয়েতনামীয় রাজতন্ত্রের সময় ভিয়েতনামের সমাজ ছিল কৃষিভিত্তিক। ধান ছিল
এর প্রধান উৎপন্ন কৃষিদ্রব্য। ভিয়েৎনামের ভৌগোলিক গঠন সরু ও দীর্ঘ। এর ভূমিরূপও
বিচিত্রধরনের। তাই এদের চাষাবাদের প্রকৃতিও একই রকমের নয়। এর সমভূমিগুলিতে নিবিড়
কৃষিকাজ হয়। এই অঞ্চলে মূলত ধান উৎপাদন করা হয় । এই কারণে ভিয়েৎনামে একটি
কৃষিভিত্তিক সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠেছে প্রাচীনকলা থেকে। এখনও এখানকার অধিকাংশ লোক
গ্রামে বাস করেন। ২০০৩ সালের হিসাব অনুযায়ী শহরে ২৬% লোকের বাস। তবে শহরমুখী
জনসংখ্যার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে, ফলে হো চি মিন সিটি, হানয় এবং অন্যান্য এলাকার
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় কৃষির আধিপত্য বজায় থাকলেও
সাধারণ চাষাবাদের চেয়ে কৃষিদ্রব্য রপ্তানির উপর জোর দেওয়া হয়। ফলে ধানের
পাশাপাশি কফি, চা, রবার এবং অন্যান্য ক্রান্তীয় শস্য উৎপাদন শুরু হয়।
ভিয়েৎনামের ইতিহাস
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে দেখা যায়, পাথরযুগে এই অঞ্চলে
হোমো এরেক্টাসরা
প্রায় ৫ লক্ষ বৎসর আগে
বসতি স্থাপন করেছিল এই অঞ্চলে। এই বিচারে এরা এই অঞ্চলে বাস করতো
পিকিং মানবদের কাছাকাছি সময়ে। এরপর
এই অঞ্চলে
হোমো স্যাপিয়েন্সরা
আসে প্রায় দেড় লক্ষ বৎসর আগে। এরা দীর্ঘদিন ধরে
এই অঞ্চলে নিজেদের সভ্যতা গড়ে তোলে। ভিয়েতনামীয় জাতির লোকেরা আদিতে লোহিত নদীর
উপত্যকায় বাস করত। খ্রিষ্টপূর্ব ২২১ অব্দে চীনের ছিন রাজবংশ এই এলাকা দখল করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ২১০ অব্দে ছিন রাজবংশের পতনের পর, তাদের দক্ষিণাঞ্চলের সেনাপতি চাও
থুও (ভিয়েতনামে ট্রিয়েউ দা নামে পরিচিত) সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকা
নিয়ে একটি রাজত্ব গড়ে তোলেন। এই রাজ্যের নাম ছিল ভিয়েৎ। পরবর্তীতে সময়ে আরও কিছু
এলাকা দখল করে এই রাজ্যের সম্প্রসারিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১১১ অব্দে চীনা হান
রাজবংশীয় রাজারা ভিয়েৎ দখল করে নেয়। এই সময় ভিয়েৎ-এর জনগণ চৈনিক আধিপত্যের বিপক্ষে
চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু করে। এরই ভিতরে ঙো কুইয়েন নামক একজন নেতা একটি সেনাবাহিনী
তৈরি করে চীনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েৎরা চীনাদের
হটিয়ে স্বাধীন হয়। কিছুদিন ভিয়েৎরা শান্তিতে থাকলেও নিজেদের ভিতরে দ্বন্দ্বের
সৃষ্টি হয়। এইন সূত্রে ভিয়েৎদের ভিতরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এরই ভিতর ১০১০
খ্রিষ্টাব্দে লি রাজবংশের রাজারা জয়লাভ করে এবং একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তুলতে
সক্ষম হয়। সে সময় এই রাজ্যের নাম হয় দাই ভিয়েৎ। ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দ লি দের পরাজিত
করে হয় ট্রান রাজবংশের লোকেরা ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই রাজবংশের পুরো সময়টাতে চীনের
রাজাদের সাথে যুদ্ধ হয়। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলরা চীন দখল করে নিলে, সাময়িকভাবে দাই
ভিয়েৎ রাজ্যের লোকেরা চীনা আক্রমণ থেকে রেহাই পায়। মঙ্গোলরা চীনে ইউয়ান রাজবংশের
সূচনা করে। কিছুদিনের ভিতর এরা নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে দাই
ভিয়েৎ রাজ্য আক্রমণ করে। কিন্তু দাই ভিয়েৎ রাজ্য দখল করতে ব্যর্থ হয়। এই অবসরে দাই
ভিয়েৎ রাজ্যের রাজা দক্ষিণে অবস্থিত চাম্পা রাজ্য দখল করে নেয়। ফলে দাই ভিয়েৎ
রাজ্যের পরিধি এবং শক্তি উভয়ই বৃদ্ধি পায়। ১৪০৭ খ্রিষ্টাব্দে শক্তিশালী চীনা মিং
রাজবংশ ভিয়েতনাম দখল করে। তবে দুই দশকের এরা চীনাদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা
পুনরুদ্ধার করে। এরপর শুরু হয় লে রাজবংশের শাসন। এটি প্রায় তিন শতক শাসন করে। তবে
সপ্তদশ শতকে রাজ্যটি প্রশাসনিকভাবে কার্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে এই অঞ্চলে
ইউরোপীয় শক্তির আধিপত্য বিস্তারকে সহজ করে দেয়।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স ইন্দোচীনের কিছু
অংশ দখল করে নেয়। এরপর থেকে এরা ভিয়েৎনাম
দখলের চেষ্টা করতে থাকে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে অভ্যন্তরীণ
কোন্দলের ভিয়েতনাম উত্তরে টঙ্কিন, মধ্যাঞ্চলে আন্নাম ও দক্ষিণে কোচিন চায়না নামে
তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
এই সুযোগের ফরাসিরা ভিয়েৎনাম দখল করে নেয়। এরা দেশটিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে, অঞ্চলগুলিকে
ক্যাম্বোডিয়া ও লাওসের সাথে যুক্ত করে ইন্দোচীন ইউনিয়ন তথা ফরাসি ইন্দোচীন গঠন
করে।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েতনামে বেশ কিছু মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির উদ্ভব হয়।
এরা ফ্রান্সের কবল থকে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে হো চি
মিঙের নেতৃত্বে ইন্দোচায়না কমিউনিস্ট পার্টি নামে ভিয়েৎনামীরা সংঘবদ্ধ হয়।
পরবর্তীকালে দলটি তিন ভাগে ভেঙে আলাদা আলাদাভাবে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে কাজ
চালিয়ে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ), ভিয়েৎনামের
সমাজাতান্ত্রিক দল ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা জাপানিদের প্রতিরোধ করতে মিত্রশক্তিকে সহযোগিতা করে।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে হো চি মিং−
ভিয়েত মিং বা স্বাধীনতা লীগ
প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর, দেশটিতে ভিয়েৎ মিং ব্যাপক
জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই সময় এরা একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলে।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে ভিয়েৎনামে একটি
গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এর দুই সপ্তাহ পর হ্যানয় দখলকারী বিদ্রোহীরা ভিয়েৎনামের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করে। এর পাশাপাশি তারা ভিয়েৎনামকে একটি প্রজাতন্ত্র
হিসেবে ঘোষণা করে। এই সময় রাজা বাও দাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অবশ্য সে সময় তাঁকে
নতুন শাসন ব্যবস্থার উপদেষ্টার পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ২রা
সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। আর ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে
ভিয়েতনাম সরকারকে ফ্রান্স স্বীকৃতি দেয় এবং ফরাসি ইউনিয়নের অধীনে ভিয়েৎনামকে
তারা মুক্ত দেশ হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু জুন মাসে ফ্রান্সের সাবেক রাজা বাও দাইকে রাষ্ট্রের
প্রধান ঘোষণা করে। ফলে ভিয়েত মিং গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। দীর্ঘ নয় বছর যুদ্ধ করার
পর, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে দিয়েন বিয়েন ফু সামরিক ঘাঁটিতে, ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে
এবং ভিয়েত মিং চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়।
এরপর
ভিয়েৎনামকে সাময়িকভাবে দুইটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি উত্তর ভিয়েৎনাম ও
দক্ষিণ ভিয়েৎনাম নামে বিভক্ত হয়। উত্তর ভিয়েতনামে একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার
গঠিত হয়এবং দক্ষিণ ভিয়েৎনামে সমাজতন্ত্র-বিরোধী সরকার শাসন করা শুরু করে। এর পরে
প্রায় ২০ বছর ধরে উত্তর ভিয়েৎনামের নেতৃত্বে ভিয়েৎনাম একত্রীকরণের একটি আন্দোলন
শুরু হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েৎনামের সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তা ব্যর্থ
করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এরই সূত্রে শুরু হয়
ভিয়েৎনাম যুদ্ধ। এই
যুদ্ধের সময়কাল ধরা হয় ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত। এই যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ডেমক্রেটিক, সোশ্যালিস্ট ও
মার্কসবাদীরা আইনজীবী নুয়েন হু তো-এর নেতৃত্বে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে (এনএলএফ)
একত্রিত হয়। সে সময়ই সায়গনের সামরিক সরকারও আমেরিকার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় প্রতিরোধ
যুদ্ধ শুরু করে। উল্লেখ্য, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সায়গনে আমেরিকার ৫ লাখ ৮০ হাজার সেনা
ছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দেই হো চি মিন মারা যান।
প্রায় ১৫ বছরব্যাপী যুদ্ধে মার্কিন সরকারের ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে।
এই যুদ্ধে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের
৭০ ভাগ গ্রাম একদম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে মার্কিন
সৈন্যরা
পরাজয় মেনে নেয়। ১৯৭৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা সরিয়ে নেয় এবং দুই
বছর পরে দক্ষিণ ভিয়েৎনাম উত্তর ভিয়েৎনামের অধীনে চলে যায়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে
এনএলএফ (ভিয়েতকং) সায়গনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। আর এর নাম বদলে তাদের প্রয়াত
নেতার নাম অনুসারে হো চি মিন সিটি রাখা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২রা জুলাই
সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েৎনাম নামে পুরো অঞ্চলটির পুনএকত্রীকরণ ঘটে।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ভিয়েৎনামীরা পল পটের
কাম্বোডিয়া সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে পল পটকে সরিয়ে দিয়ে
ভিয়েৎনামপন্থী হেঙ্গ সামরিন কাম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করে। চীনা জনগণকে
ভিয়েৎনামিকরণ প্রচারণা থেকে বাঁচাতে গিয়ে, চীন ভিয়েৎনামের উত্তরাঞ্চলে হামলা
চালায়। পরে চীন অবশ্য তাদের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েৎনামে জাতিসংঘ
সাহায্য করতে গেলে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান সাহায্য প্রদানে বাধা দেন।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের পরে হ্যানয় কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়।
পাশাপাশি এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৮৬
খ্রিষ্টাব্দে সিপিভির সাধারণ সম্পাদক লি ডুয়ান মারা যান। ভিয়েৎনাম কংগ্রেস
নুয়েন ভ্যান লিন-কে নতুন সম্পাদক মনোনীত করে।
আশির দশকে ভিয়েৎনামিরা গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয় এবং দেশটিতে বহুদলীয় সংসদীয়
ব্যবস্থার দাবি উঠতে থাকে। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে নন-কমিউনিস্ট প্রার্থীরাও
অংশ নেন। সে বছরই হংকংয়ে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার ভিয়েতনামি উদ্বাস্তুকে বৃটেন
বের করে দেয়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে সিপিভির নতুন সাধারণ সম্পাদক হন দু মুয়োই।
সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের পরও সিপিভি একদলীয় ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তবে
এই সময় শর্ত সাপেক্ষ বেসরকারি উদ্যোগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর
মাসে,
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কম্বোডিয়ার সঙ্গে ভিয়েতনামের চলমান অচলাবস্থার নিরসনের
চেষ্টা করা হয়। পরে প্যারিসে এই বিষয়ে উভয় দেশের ভিতর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই সূত্রে চীনের সাথে ভিয়েৎনামের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথকে সুগম করে। নভেম্বর
মাসে ব্রিটেন ৬৪
হাজার ভিয়েতনামিজ উদ্বাস্তুকে হংকংয়ের ক্যাম্পগুলোতে আবারো ফিরিয়ে নেয়।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল নতুন সংবিধান রচিত হয় এবং এই অনুসারে স্বতন্ত্র
প্রার্থীদেরও নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। কিন্তু জুলাই নির্বাচনে দাঁড়ানো ৯০ ভাগ প্রার্থীই
জয়ী হয়। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভো ভ্যান কিয়েট-এর সহযোগী জেনারেল লি দুক আন
প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারিকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের
স্বাধীনতার কারণে ভিয়েৎনামের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৩
ভাগ।
সে সময় প্রচুর ধান উৎপাদনের কারণে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল দারুণভাবে সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে
পরিণত হয়।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাথে ভিয়েৎনামের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে
সেপ্টেম্বরে ট্রান দাক লুয়োং ভিয়েৎনামের প্রেসিডেন্ট এবং ফ্যান ভ্যান খাই
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ডিসেম্বর মাসে সিপিভির শীর্ষ তিনটি পদে পরিবর্তন আনা
হয়।
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিলের অনাবৃষ্টিতে ভিয়েৎনামের চা বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ফলে দেশটির
রফতানি খাত মুখ থুবরে পড়ে। এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে
ভিয়েতনাম এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন (এপেক)-এর পূর্ণ সদস্য পদ পায়। এই
বৎসরের ডিসেম্বর মাসে চীনের সাথে ভিয়েতনামের
সীমান্ত-চুক্তি হয়৷
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাইফুন ও অতিবৃষ্টির কারণে ভিয়েৎনামে
ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। সে সময় ভিয়েতনামের সর্বত্র
দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সিপিভি সংশ্লিষ্ট তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তার
বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ১৯৯৯
খ্রিষ্টাব্দে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী নো জুয়ান লক-এর পদত্যাগ দাবি উঠে। ২০০০
খ্রিষ্টাব্দে
সিপিভি পলিটব্যুরো স্বীকার করে নেয় যে, দলটির সদস্যরা নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে
জড়িয়ে গেছে। পরে দুর্নীতি কমাতে
স্বায়ত্তশাসিত পর্যবেক্ষক কমিটি গঠন করার পাশাপাশি দলীয় নেতাদের সম্পত্তির বিবরণ
দেয়ার নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়। এই বৎসরে নভেম্বরে ভিয়েতনাম সফরে প্রেসিডেন্ট
বিল ক্লিনটন ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময় দেশটিতে অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকসমূহ ধ্বংস করার
জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিলে সিপিভির নতুন সাধারণ সম্পাদক
মনোনীত হন নোং দাক মান। ২০০২ খ্রিষ্টব্দের মে মাসে রাশিয়া, ক্যাম রান উপসাগর থেকে তাদের
নৌঘাঁটি প্রত্যাহার করে নেয়। জুলাইতে ট্রান দাক লুয়োং প্রেসিডেন্ট এবং ফ্যান
ভ্যান খাই দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদে পুনির্নর্বাচিত হন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের জুনে হো
চিন মিন সিটির শীর্ষ ছয় অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিতে বার্ড
ফ্লু-এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়৷ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে ১৬ জন
মারা যায়৷