ভঙ্গিল পর্বত
ইংরেজি:
Fold
Mountain
সমনাম : ভাঁজ পর্বত
পর্বতের শ্রেণিগত নাম।
ভূ-ত্বকের শিলা স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে। এই শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে যে পর্বত গঠিত হয়
তাকে ভঙ্গিল বা ভাঁজ পর্বত বলে। এই জাতীয় পর্বতের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি মতবাদ আছে।
এর ভিতরে দুটি মতবাদকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। যেমন−
মহীখাত তত্ত্ব
(Geosyncline Theory):
এই মতবাদ অনুসারে, একসময় বিশালাকারের কোনো গহ্বর ছিল। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় এদের
বলা হয় মহীখাত বা অগভীর সমুদ্র । কালক্রমে পলি পড়ে পড়ে এই অগভীর সমুদ্রকে প্রায়
ভরাট করে ফেলেছিল। এর ফলে ভূ-স্তরে নিম্নমুখী ও পার্শ্বমুখী চাপে, অগভীর
সমুদ্রের সঞ্চিত পলিতে ভাঁজ পড়তে থাকে। পরবর্তী কালে এইসব ভাঁজগুলো দৃঢ়ভাবে
সংবদ্ধ ও উঁচু হয়ে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি করেছে।
পাতসংস্থান
বা পাতসঞ্চালন তত্ত্ব
(Plate Tectonic Theory):
পাতসঞ্চালন তত্ত্ব অনুসারে, পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে
২০০
কিলোমিটার পুরু
অশ্মমণ্ডল (lithosphere)
রয়েছে।
এই অঞ্চলটি সুদৃঢ় পাথরের তৈরি হলেও বেশ কিছু ব্লকে বিভাজিত। এই
ব্লকগুলোকে
পাত
(Plate)
বলা হয়। এর নিচে রয়েছে
এ্যাস্থোনোস্ফিয়ার
(asthenosphere)
নামক
নমনীয় চটচটে
পদার্থ সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর এরও নিচে রয়েছে
চটচটে ঘন সুপের মতো ঊর্ধ্ব গুরুমণ্ডল (outer
mantle)।
এই অংশের উপরে
অশ্মমণ্ডলের
ভাসমান পাতসমূহ। পৃথিবীর উপরিভাগ কোনো না কোনো পাতের উপরে রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এই পাতগুলোর নামকরণ করেছেন নানা নামে। যেমন−
ইউরেশিয়ান প্লেট, আফ্রিকান প্লেট, ভারতীয় প্লেট, প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট
প্রভৃতি। ভয়ংকর উষ্ণতার
কারণে
ভূগর্ভের ম্যাগমা স্তরে
সৃষ্ট পরিচলন স্রোত এবং
পৃথিবীর আহ্নিক গতির
ফলে পাতগুলোর সঞ্চালিত হয়।
অবশ্য পাতগুলোর এই সঞ্চালন গতি অত্যন্ত মন্থর। এর গতি বছরে প্রায় ১০
মিলিমিটার। এইসব গতিশীল পাতগুলোর মধ্যে যে-কোনো দুটি পাত যখন পরস্পরের মুখো
মুখি হয়, তখন ওই দুটি পাতের সংযোগ রেখা বরাবর উপসাগর, সাগর কিংবা মহাসাগরের
তলদেশে সঞ্চিত পাললিক শিলাস্তরের দুদিক থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। আর এই চাপে
শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ার ফলে শিলাচ্যুতি ঘটে এবং ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় এবং ভঙ্গিল
পর্বত তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পাতসঞ্চালনের ফলে ভঙ্গিল পর্বত দু’ভাবে সৃষ্টি হতে পারে, যেমন—
১.
প্রচণ্ড ভূমিকম্পের ফলে
পৃথিবীর ওপরকার কোনো জায়গা বসে গিয়ে বা উঁচু হয়ে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে ছোটো
ছোটো ভাঁজের সৃষ্টি হয় । ভূমিকম্প যতই বাড়তে থাকে, ভাঁজগুলো ততই বড়ো ও উঁচু
হয়ে পরস্পরের কাছে চলে এসে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি করে ।
প্রচণ্ড পার্শ্ব চাপের ফলেও ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে ভাঁজ সৃষ্টি হয় । চাপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজগুলো বড়ো ও উঁচু হয়ে পরস্পরের কাছে এসে ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি করতে পারে।
ভঙ্গিল পর্বতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কোমল পাললিক শিলায় ঢেউয়ের মতো ভাঁজ পড়ে ভঙ্গিল পর্বতের
সৃষ্টি হয়। ভঙ্গিল পর্বতের উপরের দিকের ভাঁজকে ঊর্ধ্বভঙ্গ
(Anticline) ও
নিচের দিকের ভাঁজকে অধোভঙ্গ
(Syncline) বলে।
এই ভাঁজগুলো বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন−
প্রতিসম ভাঁজ, অপ্রতিসম ভাঁজ, উপরিপাত ভাঁজ ইত্যাদি।
২. ভঙ্গিল পর্বতগুলি সাধারণত পাললিক শিলায় গঠিত হলেও অনেক সময় ভঙ্গিল পর্বতে আগ্নেয়
এবং রূপান্তরিত শিলার সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। কারণ, ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টির সময়
শিলাস্তরে ফাটল সৃষ্টি হলে, সেই ফাটল দিয়ে ভূগর্ভের ম্যাগমা লাভারূপে ভূপৃষ্ঠে
বেরিয়ে আসে যা ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে । এর পর কালক্রমে
প্রচন্ড চাপ ও তাপের ফলে আগ্নেয় শিলা ও পাললিক শিলা রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয়।
৩. প্রবল ভূ-আলোড়নের জন্য ভঙ্গিল পর্বতে ভাঁজ ছাড়াও অনেক চ্যুতি বা ফল্ট দেখা যায়।
৪. প্রধানত সমুদ্র গর্ভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বলে ভঙ্গিল পর্বতে জীবাশ্ম দেখা যায়।
৫. ভঙ্গিল পর্বতগুলো সাধারণত প্রস্থের তুলনায় দৈর্ঘে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়।
৬. ভঙ্গিল পর্বতগুলো সাধারণত বহু শৃঙ্গবিশিষ্ট ও ছুঁচালো হয়।
৯. ভঙ্গিল পর্বতের গঠন স্থায়ী নয়।
ভঙ্গিল পর্বতের উদাহরণ:
ভারতের হিমালয়
ইউরোপের আল্পস ও জুরা
আফ্রিকার আটলাস
উত্তর আমেরিকার রকি
দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ