গণ
বাংলা ভাষার প্রতিটি ক্রিয়াপদ কোন না কোন সুনির্দিষ্ট ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন হয়। এই সকল ক্রিয়াপদ সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি বিশেষ বিধি অনুসারে সম্পন্ন হয়। এই বিধির ভিত্তি হিসাবে দুটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই বিষয় দুটি হলো— গণ এবং কাল-পুরুষ-সাধু/চলিত রীতির অভিন্ন সূত্র। এই দুটি বিষয় পরস্পরের এতটাই পরিপূরক যে, পৃথকভাবে বিষয় দুটি আলোচনা করা যায় না। সাধারণ বিচারে 'গণ' হলো— বিশেষ শর্তাধীনে ক্রিয়ামূলের বিভাজিত একক। এই শর্তগুলি হলো—
১. এই জাতীয় ক্রিয়ামূল থেকে অবশ্যই কোনো না কোনো ক্রিয়াপদ তৈরি হবে।
২. ক্রিয়াপদ তৈরির সময় কাল-পুরুষ-সাধু/চলিত রীতির অভিন্ন সূত্রে— একটি সাধারণ বানান রীতি অনুসৃত হবে।
৩. উৎপন্ন ক্রিয়াপদের সাধারণ বানান রীতি অনুসারে ক্রিয়ামূলের শ্রেণি বিভাজন হবে এবং এর প্রতিটি ভাগকে এক একটি গণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
এই তিনটি শর্তানুসারে গণের স্বরূপ পর্যাবেক্ষণ

প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ্যে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত
ক্রিয়ামূলের বানান পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, উৎপন্ন ক্রিয়াপদে {সাধারণ বর্তমান, উত্তম পুরুষ, সাধু/চলিত}-অনুসারে, শেষ ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ই-কার যুক্ত হয়। তা হলে,
কর এবং নাচ্ পৃথক গণ হিসাবে বিবেচনা না করে একই গণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।


কাল, পুরুষ ও সাধু/চলিত রীতির অভিন্নতার সূত্র যে ছকটির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে তার নমুনা নিচে দেওয়া হলো।

কাল, পুরুষ ও সাধু/চলিত রীতির অভিন্নতার সূত্র-এর ছক

চলিত রূপ 
কালের নাম নাম পুরুষ মধ্যম উত্তম
সাধারণ
(সে)
সম্ভ্রমাত্মক
(তিনি)
সম্ভ্রমাত্মক
(আপনি)
সাধারণ
(তুমি)
তুচ্ছ
(তুই)
আমি
বর্তমান
মোট
সাধারণ            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
অনুজ্ঞা           ক্রিয়াপদ হয় না
অতীত সাধারণ            
নিত্যবৃত্ত            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
ভবিষ্যৎ সাধারণ            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
অনুজ্ঞা ক্রিয়াপদ হয় না ক্রিয়াপদ হয় না ক্রিয়াপদ হয় না     ক্রিয়াপদ হয় না
সাধু রূপ 
কালের নাম নাম পুরুষ মধ্যম উত্তম
সাধারণ
(সে)
সম্ভ্রমাত্মক
(তিনি)
সম্ভ্রমাত্মক
(আপনি)
সাধারণ
(তুমি)
তুচ্ছ
(তুই)
আমি
বর্তমান সাধারণ            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
অনুজ্ঞা            ক্রিয়াপদ হয় না
অতীত সাধারণ            
নিত্যবৃত্ত            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
ভবিষ্যৎ সাধারণ            
ঘটমান            
পুরাঘটিত            
অনুজ্ঞা ক্রিয়াপদ হয় না ক্রিয়াপদ হয় না ক্রিয়াপদ হয় না       ক্রিয়াপদ হয় না

 


উপরের ছক অনুসারে বিচারে- আমরা ক্রিয়াপদের জন্য ঘর পাই ১৪৪টি।
                    চলিত রীতির জন্য = ১২ ´ ৬=৭২
                 চলিত রীতির জন্য = ১২ ´ ৬=৭২ ১৪৪টি

কিন্তু এই ১৪৪টি ঘরের সবগুলোতে ক্রিয়াপদ বসে না। আবার মধ্যম পুরুষের সম্ভ্রান্তবাচক এবং নাম পুরুষের সম্ভ্রান্তবাচক ঘরের ক্রিয়াপদ একই থাকে। এই বিচারে বর্জিত ঘরের সংখ্যা দাঁড়ায়=

                  অনুজ্ঞার বর্জিত ঘর           ১০টি
       সম্ভ্রান্তবাচকের একক ঘর অনুসারে    ২৪টি
                                                     ৩৪টি

      ফলে ক্রিয়াপদের সংখ্যা চূড়ান্ত সংখ্যা দাঁড়ায়

                           ঘর সংখ্যা                  ১৪৪
                           বর্জিত ঘর                   ৩৪
                                                        ১১০

অসমাপিকা ক্রিয়াপদকে এই তালিকার সাথে যুক্ত করলে সাধারণভাবে আরও  কিছু ক্রিয়াপদ যুক্ত হতে পারে। সাধারণবভাবে এর সংখ্যা ৬টি (চলতি রূপে ৩টি + সাধু রূপে ৩টি) বাড়তে পারে।   

গণের সম্পূর্ণতা-অসম্পূর্ণতা
কাল, পুরুষ ও সাধু/চলিত রীতির অভিন্নতার সূত্রে ক্রিয়ামূলগুলির শ্রেণীবিভাজন করা হবে- ক্রিয়ামূলগুলি থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াপদের প্রকৃতি অনুসারে। প্রাথমিকভাবে ক্রিয়ামূলগুলিকে এই সূত্রে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

  • সম্পূর্ণ গণ : যে সকল গণের ক্রিয়ামূল থেকে- 'কাল, পুরুষ ও সাধু/চলিত রীতির অভিন্নতার সূত্র'-এর ছকের সকল ঘর পূরণ করা সম্ভব হয়, সে সকল গণ সম্পূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হবে। ।

  • অসম্পূর্ণ গণ : যে সকল গণের ক্রিয়ামূল থেকে- 'কাল, পুরুষ ও সাধু/চলিত রীতির অভিন্নতার সূত্র'-এর ছকের সকল ঘর পূরণ করা সম্ভব হয় না, সে সকল গণ অসম্পূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হবে।

গণের শ্রেণিবভাজন
ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াপদের প্রকৃতি অনুসারে যে গণ-বিভাজন করা হয়ে থাকে, তা বাংলা ব্যাকরণ মাত্রেই বেশ আড়ম্বর করে আলোচনা করা হয়। তবে এই গণবিভাজন প্রকৃতি অনেকাংশই রাজশেখর বসু এবং সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের রীতিকে অনুসরণ করা হয়। ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-সহ অনেকেই  আবার এই বিষয়কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন নি।

সত্যিকার অর্থে গণ-বিভাজন করার জন্য যেমন সকল ধরনের ক্রিয়াপদ উৎপন্নকারী ক্রিয়ামূলের যথাযথ মর্যাদায় আলোচনা করা উচিৎ ততটা কেউই করেন নি। এই অভাব পূরণের লক্ষ্যে এই অধ্যায়ের অবতারণা। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে পূর্ববর্তী ব্যাকরণ প্রণেতাদের অনুসরণ করা সম্ভব হয় নি। এমন কি প্রচলিত গণ বিভাজনের রীতিতেও কিছু পরিবর্তন চলে এসেছে।

প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণগুলোতে একইভাবে পাওয়া যায় না। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণ ও অভিধান অনুসারে উদাহরণ দেওয়া হলো। যেমন-

১. চলন্তিকা । রাজশেখর বসু। (১৪০৮ নতুন মুদ্রণ)। এটি একটি অভিধান। এর পরিশিষ্টের ক্রিয়ারূপ অংশে গণের সংখ্যা রয়েছে ১৯টি।
২. বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। (ফাল্গুন ১৩৪২)। এটি একটি ব্যাকরণ বই। এতে গণ সংখ্যা আছে ২০টি।
৩. ভাষা-প্রকাশ ও বাঙ্গালা ব্যাকরণ (বৈশাখ ১৩৯৬। মে ১৯৮৯)। এটি একটি ব্যাকরণ বই। এতে মূল গণ সংখ্যা ৭টি। এই ৭টি গণ উপবিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়াও নঞর্থক ধাতুকে পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রচলিত ব্যাকরণের রীতিনীতি অনুসরণ করেই এই গণগুলোকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। নিচে এর নমুনা তুলে ধরা হলো।

গণবিভাজন
ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াপদের বানান নির্ভর করে, ক্রিয়ামূলের বানান প্রকৃতির উপর। এই বিচারে ক্রিয়ামূলগুলিকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগ দুটি হলো

  • ১. স্বরান্ত ক্রিয়ামূল: যে সকল ক্রিয়ামূলের শেষে কোনো স্বরবর্ণ রয়েছে। যেমন খা, যা, দি, নি ইত্যাদি
            দেখুন : স্বরান্ত ক্রিয়ামূল ভিত্তিক গণ

    ২. ব্যঞ্জনান্ত ক্রিয়ামূল : যে সকল ক্রিয়ামূলের শেষে কোনো স্বরবর্ণ থাকে না। ফলে ক্রিয়ামূলের শেষে হসন্তযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে। যেমন কর্, চল্, উঠ ইত্যাদি।
           দেখুন : ব্যঞ্জনান্ত ক্রিয়ামূল ভিত্তিক গণ

সূত্র :

  • চলন্তিকা। রাজশেখর বসু। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ। ১৪০৮।
  • বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১।
  • বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। মার্চ ২০০৫।
  • বাঙ্গালা ব্যাকরণ। শক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। ফাল্গুন ১৩৪২
  • বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। সাহিত্য সংসদ। নভেম্বর ২০০০।
  • বাঙ্গালা শব্দকোষ। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ভূর্জপত্র। দোলযাত্রা ১৩৯৭।
  • ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপম। মে ১৯৮৯।
  • শব্দবোধ অভিধান। আশুতোষ দেব। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০।