সাঁওতাল বিদ্রোহ
ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত, সাঁওতালদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ব্রিটিশরা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে অভিহিত করেছিল।

সাঁওতালদের অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হলেও এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। বঙ্গদেশের বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও, পরে তা অন্যান্য অঞ্চলের সাঁতালদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল।

বঙ্গদেশে
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার আগে, সাঁওতালরা নিজেদের সরল ও সাদাসিধে
জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ ছিল। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর, কোম্পানি তাদের শাসন ও শোষণ সুদৃঢ় করার জন্য জমিদারি প্রথা চালু করে। এই সূত্রে তৈরি হয় ব্রিটিশ এবং জমিদারদের দালাল, সুদখোর মহাজন, সরকারি আমলা। অভাবের সুযোগে মহাজনরা সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করত। সরলমনা সাঁওতালদের ধান-চাল ধার দেওয়ার সময় ওজনে ফাঁকি দিত। আর সাঁওতালদের ধান-চাল পরিশোধ করার, সময় কয়েক গুণ বেশি ফসল নিতো। একবার মহাজনের কাছ থেকে দেনা করলে, দশগুণ পরিশোধ করেও
সাঁওতালরা ঋণ থেকে মুক্তি পেত না। জমিদাররা সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া হারে খাজনা আদায় করতো। কোনো কোনো অঞ্চলে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল নীলকরদের অত্যাচার। এরা ধানী জমিতে জোর করে নীলের চাষ করাতো। উত্তরবঙ্গে রেলপথ নির্মাণের জন্য আগত ইউরোপীয়রা সাঁওতাল মেয়েদের ভোগ করতো। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জমিদারদের পাইকরা অত্যাচারের করতো।

১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুন ভাগনাদিহির মাঠে
সিধু ও কানুর নেতৃত্বে, প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়। এই সমাবেশেই সিধু ও কানু সাঁওতালদের বিদ্রোহের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের বার্তা সাঁওতাল পল্লীগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে, হাজার হাজার সাঁওতাল এদের সাথে যোগদান করে। প্রথম দিকে বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত। এর ফলে এই অঞ্চলে সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ সৈন্যরা এই বিদ্রোহ দমন করতে এলে বিদ্রোহীরা দেশীয় তীর-বল্লম জাতীয় অস্ত্রের দিয়ে বাধা দেয়। এরপর এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে। এই সময় স্থানীয় জমিদাররা ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। দেওঘর অঞ্চল থেকে এরা কোম্পানির শাসন উৎখাত করে। মহেশপুরে পঞ্চাশ হাজার সাঁওতাল কোম্পানি সৈন্যের গতিরোধ করে। এক রেজিমেন্ট সৈন্য নিয়োগ করার পরও কোম্পানি এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়। এই সময় কোম্পানি সরকার বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

প্রাথমিকভাবে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এই বিদ্রোহ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও, সেপ্টেম্বরের শেষদিকে আবার প্রবলভাবে কোম্পানির সৈন্যদের আক্রমণ করতে থাকে। ফলে এ অঞ্চলে কোম্পানি সামরিক আইন জারি করে। এরই মধ্যে সাঁওতাল একটা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, নতুন সাঁওতাল রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হবে। শুধু বলদচালিত লাঙলের ওপর দুই পয়সা আর মহিষচালিত লাঙলের ওপর দুই আনা খাজনা ধার্য হবে।

এই বিদ্রোহের সময় স্থানীয় নিম্ন আয়ের পেশাজীবী মানুষ যোগদান করে। কামার-কুমার, তেলি, চামার, ডোম ও উত্তরবঙ্গের মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতালদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এরা বাংলা, বিহার ও ছোট নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছয় মাস পর্যন্ত বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। একটি যুদ্ধে মেজর বুরাফ নামক এক ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের হাতে পরাজিত হলে, কোম্পানি এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী (৫৫ নম্বর রেজিমেন্ট) পাঠায় । ইংরেজ গোলন্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুকের লড়াই বেশি দিন চলতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত সাঁওতালরা পরাজয় বরণ করে। সিধু, কানুসহ নেতৃস্থানীয় সাঁওতালদের ফাঁসি দেওয়া হয়। ৩৬টি সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস এবং প্রায় পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহের পর ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল ও দামিন-ই-কো এলাকাসমেত বীরভূম ও ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে, সাঁওতাল পরগনা নামের একটি নতুন জেলা গঠন করে। এই সময় মহাজনদের দেওয়া সব ঋণ বাতিল হয়। সাঁওতালরা জমির মালিকানা অর্জন করে।


সূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ। প্রথম খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর, ১৯৭২।
http://en.wikipedia.org/wiki/Anti-Comintern_Pact