ভাটিয়ালি
বাংলা লোকগানের প্রধান চারটি ধারার
একটি। এই ধারটির বিকাশ ঘটেছে পূর্ববাংলার ভাটি অঞ্চলে।
পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চল বলতে নদ-নদী বিধৌত নিম্নাঞ্চল বুঝায়। নদী-স্রোতের অভিমুখে উজান-ভাটি দুটি শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের নদীগুলোর জলপ্রবাহের গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর। কোনো কোনো নদী পূর্ব-পশ্চিমে বাঁক খেলেও চূড়ান্ত লক্ষ্য দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর। এই বিচারে যেকোনো নদীর স্রোত-উৎসের দিককে বলা হয় উজান এবং স্রোতের অধমুখের দিক হয় ভাটি অঞ্চল। পূর্ববাংলার ভাটি অঞ্চল প্রধান তিনটি অংশে বিভাজিত। যেমন—
উত্তর-পূর্ব ভাটি অঞ্চল: পূর্ববাংলার উত্তর-সীমান্তের গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ক্রমঢালু অঞ্চল। এই অঞ্চলের পুরাতন ও নতুন ব্রহ্মপুত্র এবং এর শাখা নদীসমূহের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাটি অঞ্চল।
মধ্য-পূর্ব ভাটি অঞ্চল: ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা এবং এদের শাখা নদীর দ্বারা সৃষ্ট ঢাকা এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের ভাটি অঞ্চল।
পূর্ব ভাটি অঞ্চল: সুরমা, কুশিয়ার, পদ্মা, মেঘনা এবং এদের দ্বারা সৃষ্ট ঢাকার পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।
আক্ষরিক অর্থে ভাটি অঞ্চলের গান হিসেবে যদি ভাটিয়ালি গানকে বিবেচনা করা যায়, তা হলে উপরোক্ত ভাটি অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিক রূপ এবং এই সকল অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন সম্পর্কে জানাটাও প্রয়োজন। এসকল ভাটি অঞ্চল একসময় জালের মতো বিছানো অসংখ্য নদ-নদী, স্রোতবাহী খাল, বিল ইত্যাদি ছিল। এই অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম বাহন ছিল নৌযান। এসকল নৌযানের ভিতর ছিল ডোঙ্গা, কোষা, ডিঙি, বজরা, গয়না, বাতনাই, পাতাম ইত্যাদি। এখনও এগুলোর অল্পবিস্তর ব্যবহার রয়েছে। এসব জলযানের ভিতরে ডোঙ্গা হলো, ছোটো ছোটো খাল বিলে ব্যক্তিগত বা পারবারিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত তালগাছ থেকে তৈরি নৌযান। এর চেয়ে একটু ভারি বাহন হিসেবে ছিল কোষা, ডিঙি। এগুলোর সাধারণ নাম নৌকা। এই নৌকাগুলো মাছ ধরা, খেয়া পারাপার ইত্যাদি এখনও ব্যবহৃত হয়। কর্মজীবি গৃহী মানুষের এসব নৌযানের চালকদের কাছে গান গাওয়ার অবসর ছিল না। মাঝিদের গানের সূত্রে যদি ভাটিয়ালি গানের উদ্ভব হয়, তাহলে তার উৎপত্তি ঘটেছে দূরগামী বজরা বা গয়না জাতীয় নৌকার মাঝিমাল্লার গান। এরা এসব নৌযান নিয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতো। ঘর-ছাড়া এসব মাঝিরা নদীতে নদীতে ভেসে বেড়াতো। চলমান নৌযানে অনেক সময়ই মাঝিদের হাল ধরে বসে থাকা ছাড়া কাজ থাকতো না। সে সময় নদীর মনোরম খোলা হাওয়া নৌকার পালের সাথে সাথে মনের পালেও হাওয়া লাগিয়ে গান গাইতো। এসব গানে থাকতো বসতবাড়ির কথা, স্ত্রী-সন্তান, পিতামাতার কথা। গানে বাধা পড়তো নানা ধরনের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা।
মনে রাখতে হবে ভাটিয়ালি কাব্য
বা ছন্দের নাম নয়। এটি সুরের নাম। এই সুরে মায়া শুধু মাঝিদের ভিতরেই থাকে নি। কালে
কালে ভাটি অঞ্চলের স্থলচর সাধারণ মানুষের গানেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এই অঞ্চলের মাঠের
রাখাল বালক, সাধারণ গৃহী কৃষক বা অন্যান্য পেশাজীবীরা ভাটিয়ালির সুরে আকৃষ্ট হয়েছে।
এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাউল, মুরশিদি, মারফতি ইত্যাদি গানেও। এই গানের সুর প্রবহমান নদীর মতও গতিময়।
কিন্তু চাঞ্চল্য নেই। আছে সুরের গভীর প্রবাহ। ভাটিয়ালি গানে পাওয়া যায় অতল জলের
আহ্বান। অনেকে ভারতীয় রাগের সন্ধান করেছেন এই গানের সুরে। বাস্তবে কোনো কোনো
ভাটিয়ালি সুরের সাথে কোনো বিশেষ রাগের রূপ মিলে যেতে পারে। কিন্তু ভাটিয়ালি গানের
সুরকাররা রাগের চেয়ে মনের অনুরাগকে মর্যাদা দিয়েছেন বেশি।
খাঁটি ভাটিয়ালি যদি মাঝিদের গান হয়, তাহলে বলতেই ভাটি খোলা গলার গান। এর অনুসঙ্গী
শব্দ হলো বাতাসের শাঁ শাঁ ধ্বনি আর নদীর জলতরঙ্গের ধ্বনি। মাঝিদের নদীর গান যখন
ডাঙায় এলো। জনপল্লীতে এই দুটি অনুষঙ্গী-ধ্বনি ছাড়া গান অনেকে রাতে-বিরেতে গাইতো। স্থলের পেশাদারি শিল্পীরা যখন এই গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন, তখন তাঁরা এই
গানের সাথে লোকজ বাদ্যযন্ত্রের সন্ধান অনুষঙ্গ নিয়েছে। তাঁরা এই গানে যুক্ত করেছেন দোতারা,
ঢোল, ঢোলক, বাঁশি, সারিন্দা, মন্দিরা ইত্যাদি।
ভাটিয়ালি গানের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে নরনারীর প্রেম। এ গানে রয়েছে যেমন মাঝিদের দীর্ঘ জলযাত্রার স্ত্রী-বিরহ, পাশাপাশি রয়েছে প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদে থাকার বেদনা, কিম্বা বন্দরে বন্দরে ঘুরতে ঘুরতে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যাওয়ার আনন্দ। কিম্বা নদী পারের কোনো সুন্দরীকে দেখে মোহাবিষ্টের গান। কলসী কাঁখে কোনো কিশোরীকে দেখে মাঝি ক্ষণিক মোহে গানে বেঁধেছেন—
আরে ও কলসী কাঁখের নারী
সোনার যৈবন হাইল্যা পড়ে বদন ভিজা শাড়ি
একা কেন আইলা ঘাটে নবীন কিশোরী
যদি কোন সওদাগরে তোমায় করে চুড়ি।
পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি সুর বাউল দর্শনকে প্রভাবিত করেছে কখনো। বাউলগানের বাণীর রহস্যময়তা এবং ভাটিয়ালি সুরের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে, 'মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে/আমি আর বাইতে পারলাম না'। ভাটিয়ালির সুরে ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, স্থানীয় লোক কাহিনীতে ময়মনসিংহ গীতিকা, কিম্বা বেহুলা-লখিন্দর লোকগাঁথায়। মধুমালা গীতি-আখ্যানের এমনি একটি জনপ্রিয় গান- 'আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখ রে।
১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের অবসান হয়। এর পর থেকে পূর্ব-মধ্য-দক্ষিণ বাংলায় মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। একই সাথে পূর্ব-বাংলার আদি লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরের গানের বিকাশ ঘটতে থাকে। প্রাথমিক স্তরে প্রেম-বিরহের ভাটিয়ালি গানের বিকাশ ঘটলেও ধীরে ধীরে এর সাথে বাউল দর্শন, আধ্যাত্মিক ভক্তিরসের গান যুক্ত হতে থাকে। এই ধারায় বিষয়ভিত্তিক গানের ভিন্নতর গানের সৃষ্টি হয়। যেমন-
মুর্শিদি গান: সুফি
দর্শন দ্বারা মুর্শিদ (গুরু) ও মুরিদের সম্পর্কের সূত্রে সৃষ্ট গান।
যেমন- নাও বাইয়া যাও কোথায় মাঝিরে/অকূল দরিয়া।
আমার দোয়া যেন পৌঁছায় রাসুলের দরগায়।
[দেখুন: মুর্শিদি]
মারফতি গান: বাংলার
সুফি মতাদর্শীদের সূত্রে সৃষ্ট আল্লাহকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে রচিত গান।
বাজলোরে মারফতের ডঙ্কা সারা দুনিয়ায় ।
ভবের পাগল মত্ত হইল গানা বাজানায় ।।
না বুঝিয়া হারাম বলে, বাতিনির কানায়,
হুহু তালে ডপকি বাজে, যে বুঝে সে শুনতে
পায় ।
বাউলাঙ্গের গান:
এসকল গানের বিষয় বাউল গানের মতো, কিন্তু সুর ভাটিয়ালি। যেমন-
মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে
আমি আর বাইতে পারলাম না
প্রেমের গান:
নারীপুরুষের প্রেমাকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্ট গান। এই পর্যায়ের গানে পাওয়া যায় মিলন,
বিরহ, বিচ্ছেদ, অভিমান ইত্যাদি উপবিভাগ।
যেমন-
বিদ্যাশেতে রইল মোর বন্ধুরে ও আমার পরাণ বন্ধুরে
তোমার সনে আমার মনের মিল যেন হয় পরপারে।
কাব্যসঙ্গীত:
ভাটিয়ালি সুরে নিবদ্ধ কাব্যগাঁথা'র গান।
মধুমালা গীতি-আখ্যানের এমনি একটি
জনপ্রিয় গান- 'আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখ রে।
দেশাত্মবোধক গান:
এই ধারায় নানা
ধরনের দেশাত্মবোধক গান, ভাটিয়ালি সুরে
রচিত হয়েছে। যেমন- আব্দুল লতিফ রচিত-
ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়।
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার
হাতে-পায়ে
সূত্র :