ভারতীয় সঙ্গীত
বৃহদ্দেশী রচনাকাল (৫০০-৬০০ খ্রিষ্টাব্দ)
৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর গ্রামরাগ
ক্রমবিবর্তনের ধারায় স্বতন্ত্র সুরশৈলী ভিত্তিক বিন্যাসে রাগ-রূপ তৈরি করেছিল।
নারাদীয় শিক্ষা, ভরতের নাট্যশাস্ত্র, কোহল, দত্তিল প্রমুখের সাঙ্গীতিক মতের
অনুক্রমিক ধারায় যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় রূপরেখা তৈরি হয়েছিল, বৃহদ্দেশীতে এঁদের
মতামতের সমন্বিত রূপ উপস্থাপিত হয়েছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়
এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে নাদ, শ্রুতি, শ্রুতিতে স্বরের বিন্যাস, স্বরের উৎপত্তি,
গ্রাম, মূর্ছনা, তান, বর্ণ, অলংকার, গীত, জাতি ইত্যাদি নিয়ে
আলোচনা করা হয়েছে। মূলত পূর্বর্তী লেখকদের গ্রন্থাদি অনুসরণে এসকল আলোচনা করা
হয়েছে। যেমন
মার্গ সঙ্গীতের স্বর নির্ধারিত হতো শ্রুতিকে ভিত্তি করে।
ষড়্জ ও মধ্যম গ্রাম অনুসারে স্বর নির্ধারণে শ্রুতি বিভাজন
ভিন্নতা দেখা যেতো। কোহলের উদ্ধৃতি দিয়ে মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে- পশুপাখির
কণ্ঠস্বর থেকে স্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন। স্বর এবং পশুপাখিগুলো হলো- ময়ুর
থেকে ষড়্জ, চাতক থেকে ঋষভ,
ছাগ থেকে গান্ধার, ক্রৌঞ্চ থেকে মধ্যম, কোকিল থেকে
পঞ্চম, বর্ষাকালের ব্যাঙ থেকে ধৈবত এবং হাতি
থেকে নিষাদ।
বৃহদ্দেশীতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ১৮টি জাতি গানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
বৃহদ্দেশী জাতিসমূহকে শুদ্ধ এবং বিকৃত এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে উভয়
জাতির সংজ্ঞা এবং লক্ষণ সমূহকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
- শুদ্ধ জাতি:
স্বরাদির নূনতা
ঘটবে না এবং তার, অংশ, গ্রহ, ন্যাস স্বর
থাকবে।
- বিকৃত জাতি: ন্যাস
ছাড়া শুদ্ধ জাতির দুই বা ততোধিক লক্ষণের বিচ্যতি হবে।
বৃহদ্দেশীতে
জাতিগুলোকে যে ভাবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছে, তা নিচে তুলে ধরা হলো।
ষড়জ ও মধ্যম গ্রামের সামগ্রিক শ্রেণিকরণ
- ষড়্জ গ্রামজাত জাতি: মোট ৭টি জাতি। এগুলো হলো-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী,
ষড়্জকৈশিকী,
ষড়্জোদীচ্যবতী এবং
ষড়্জমধ্যমা।
এই রাগগুলো শুদ্ধ ও বিকৃত হিসেবে বিভাজিত ছিল।
- শুদ্ধ জাতি: এই জাতীয় গানে একটি মাত্রা জাতি শুদ্ধভাবে
পরিবেশিত হতো। শুদ্ধ শ্রেণির জাতিগুলো ছিল-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী
(নিষাদবতী)।
- বিকৃত জাতি: একাধিক জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতিগানে বিকৃত
জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ষড়জ্ গ্রামের বিকৃত জাতিতে একাধিক জাতির
মিশ্রণ থাকলেও ষাড়জী জাতির প্রাধান্য রাখা হতো। যাড়্জী জাতির অন্তর্গত
বিকৃত জাতিগুলো হলো-
মধ্যম গ্রামজাত জাতি: মোট ১১টি জাতি। এগুলো হলো-
আন্ধ্রী,
কর্মারবী,
কৈশিকী,
গান্ধারপঞ্চমী,
গান্ধারী,
নন্দয়ন্তী,
মধ্যমা,
পঞ্চমী,
রক্তগান্ধারী,
গান্ধারোদীচ্যবা
ও মধ্যমোদীচ্যবা
। এই রাগগুলো শুদ্ধ ও বিকৃত হিসেবে বিভাজিত ছিল।
বৃহদ্দেশীতে
সাত প্রকার গীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো-
চোক্ষ,
ভিন্নকা,
গৌড়িকা, রাগগীতি,
সাধারণী, ভাষা ও
বিভাষা। তিনি সে সময়ের প্রচলিত রাগগুলোর প্রকৃতি অনুসারে
গ্রামরাগ এবং অন্যান্য দেশী রাগগুলোকে শ্রেণিকরণে 'গীত' শব্দটিকে
শব্দ-ঊর্ধ্বক্রমবাচকতার সোপানে বিন্যস্ত করেছিলেন। এই শ্রেণি বিভাজনের উচ্চধাপে ছিল
গ্রাম। এরপর নিম্নক্রমিক ধারাটি ছিল- গ্রামরাগ> জাতিরাগ> গীত> গ্রামরাগ ভিত্তিক গীত>
রাগ। যেমন-
-
চোক্ষ:
এখানে চোক্ষ শব্দের অর্থ হলো- শুদ্ধ। এই গীতের অন্তর্ভুক্ত রাগগুলো
হলো-
শুদ্ধষাড়ব,
পঞ্চমী,
কৈশিকমধ্যম,
চোক্ষসাধারিত এবং
চৌক্ষকৈশিক। এই
রাগগুলোর উদ্ভব হয়েছিল গ্রামরাগ থেকে। আবার গ্রামরাগগুলোর উৎপত্তি ঘটেছিল গ্রাম
থেকে। যেমন-
-
শুদ্ধষাড়ব: মধ্যম গ্রামের শুদ্ধপঞ্চমী এবং
ষড়্জোদীচ্যবা গ্রামরাগের মিশ্রণজাত গ্রামরাগ।
-
পঞ্চমী:
মধ্যম গ্রামের মধ্যম গ্রামরাগের পঞ্চম
শুদ্ধজাতির গ্রামরাগ।
-
কৈশিকমধ্যম: ষড়্জ গ্রামের
কৌশিকী ও ষড়্জমধ্যম জাতির মিশ্রণজাত গ্রামরাগ।
-
চোক্ষসাধারিত: ষড়জ গ্রামের ষড়্জমধ্যম
জাতির গ্রামরাগ।
-
চৌক্ষকৈশিক: মধ্যম গ্রামের কৌশিকী ও কার্মারবী জাতি
মিশ্রণজাত গ্রামরাগ
-
ভিন্নকা:
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে বলা হয়েছে - শ্রুতি, জাতি শুদ্ধতা এবং স্বর ভিন্ন হলে তাকে
ভিন্ন বলা হয় [পৃষ্ঠা: ১৪৫]।
-
ভিন্নষড়্জ:
গ্রামরাগ শুদ্ধ ষাড়বকে ভিন্নভাবে প্রকাশের কারণে এর নামকরণ করা হয়েছিল
ভিন্নষড়্জ। এই গ্রামরাগটি উৎপত্তি হয়েছিল- ষড়্জ গ্রামের বিকৃত
স্বরভিত্তিক 'ষড়্জোদীচ্যবতী'
থেকে। কারণ এতে শুদ্ধ স্বরের পরিবর্তে
অন্তর গান্ধার ও কাকলী নিষাদ ব্যবহৃত
হতো।
-
ভিন্নতান:
মধ্যম গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এই রাগটি ভিন্ন গীতরীতির জাতিগান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছিল। জাতির বিচারে এই গ্রাম রাগটি মধ্যম গ্রামের
শুদ্ধ জাতির
মধ্যমা,
পঞ্চমী থেকে
উদ্ভব হয়েছিল।
-
ভিন্নকৈশিকমধ্যম: এটি ষড়্জ গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এই রাগটি ভিন্ন
গীতরীতির জাতিগান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জাতির
বিচারে এই গ্রাম রাগটি ষড়্জ গ্রামের শুদ্ধ জাতি
ষড়্জমধ্যমা থেকে উদ্ভব হয়েছিল। এটি শুদ্ধ
কৈশিকমধ্যম গ্রাম রাগের শুদ্ধ নিষাদের পরবর্তে
কাকলী নিষাদ
ব্যবহৃত হতো। এই সূত্রে এই রাগটি শুদ্ধকৈশিকমধ্যম রাগ থেকে পৃথক হয়ে
ভিন্নকৈশিকমধ্যম নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
-
ভিন্ন
কৈশিক: এটি মধ্যম গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়
শতাব্দীর দিকে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এই রাগটি ভিন্ন গীতরীতির জাতিগান হিসেবে
অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জাতির বিচারে এই গ্রাম রাগটি
মধ্যম গ্রামের বিকৃত জাতি
কর্মারবী
ও কৈশিকী
থেকে উদ্ভব হয়েছিল।
-
ভিন্ন
পঞ্চম: এটি মধ্যম গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়
শতাব্দীর দিকে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এই রাগটি ভিন্ন গীতরীতির জাতিগান হিসেবে
অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জাতির বিচারে এই গ্রাম রাগটি
মধ্যম গ্রামের শুদ্ধ জাতি
মধ্যমা
ও পঞ্চমী
থেকে উদ্ভব হয়েছিল। এটি শুদ্ধ পঞ্চম গ্রাম রাগের শুদ্ধ
নিষাদের পরবর্তে
কাকলী নিষাদ ব্যবহৃত হতো। এই সূত্রে এই
রাগটি শুদ্ধপঞ্চম রাগ থেকে পৃথক হয়ে ভিন্নপঞ্চম নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
-
গৌড়ী:
এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ওহাড়ি। এই গীতের
অন্তর্ভুক্ত রাগ ছিল ৩টি।
-
রাগগীতি: এই গীতে
ললিত গমক, প্রসন্ন ও সমপর্যায়ের অলঙ্কার ব্যবহৃত হতো। এই গীতের অন্তর্গত রাগের
সংখ্যা ছিল আটটি
- সাধারণী: এই গীতের
চলন ছিল উল্লিখিত সকল গীতের একটি সাধারণ রূপ। এই গীতের অন্তর্ভুক্ত রাগ ছিল
৭টি।
- ভাষা
: কম্পিত গমক কাকুর প্রয়োগ হতো। এই গীতের অন্তর্ভুক্ত রাগ
ছিল ১৬টি
- বিভাষা: লালিত্য,
দীপ্তি, কম্পিত পর্যায়ে গমক, বক্ষোদেশ থেকে উৎপন্ন স্বর ও সমতা থাকতো। এই রাগের
অন্তর্ভুক্ত রাগ ছিল ১২টি
তথ্যসূত্র:
বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। সম্পাদনা রাজ্যেশ্বর মিত্র।