ভারতীয় সঙ্গীত
বৃহদ্দেশী রচনাকাল (৫০০-৬০০ খ্রিষ্টাব্দ)

৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর জাতিরাগ, প্রবন্ধ গানের ক্রমবিবর্তনের ধারায় স্বতন্ত্র সুরশৈলী ভিত্তিক বিন্যাসে রাগ-রূপ তৈরি করেছিল। ৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রাগের এই ক্রমবিবরণের ধারা বিচয়ক কোনো সুনির্দিষ্ট রচনা পাওয়া যায় না। ফলে এই সময়ের ভিতরে মতঙ্গ রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থটি পড়ে মনে হয়, হঠাৎ করেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারায় রাগ-অধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটে গেল। প্রকৃতপক্ষে ঘটানাটি তেমন না। বৃহদ্দেশী মূলত তাঁর পূর্বর্তী সঙ্গীতগুণীদের মত এবং তাঁর সমকালীন সঙ্গীতভাবনার সংকলন মাত্র।

এই গ্রন্থের শুরুতে পাওয়া যায় মতঙ্গ ও নারদের মধ্যে সঙ্গীত-বিষয়ক কথোপকথান। এখানে নারদ অবশ্যই শিক্ষাকার নারদ নয়। কারণ নারদ মতঙ্গকে মুনিবর নামে অভিহিত করেছন।

মতঙ্গের সময় সঙ্গিত ছিল দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি হলো দেশী গান, অপরটি মার্গ গান। তিনি দেশীগানের সংজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করেছেন- 'স্ত্রীলোক, বালকগণ, রাখালগণ, রাজন্যবর্গ নিজের নিজের ইচ্ছানুসারে নিজের দেশভূমিতে অনুরাগ সহকারে যা যা গেয়ে থাকেন সেগুলিকে দেশী বলা হয়। এই  সংজ্ঞা অনুসারে সাধারণভাবে বলা যায়- আপামর জনসাধারণ নিজ নিজ দেশে যে সকল গান পরিবেশন করতেন, তাই ছিল দেশী গান। এই গান সুনির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় বিধিতে বাঁধা ছিল না। এই গানই ছিল মূলত লৌকিক গান।

অন্যদিকে মার্গসঙ্গিত ছিল শাস্ত্রীয় বিধিতে বাঁধা। এই গান ছিল দুটি ভাগে বিভক্ত। ভাগ দুটি হলো- নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ।

মার্গসঙ্গীতের প্রাণ হিসেবে নাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়ে প্রথমেই নাদকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন আধ্যাত্মিক দর্শন থেকে। তবে এখানে তিনি এই ব্যাখ্যা করা হয়েছে- নানা জনের মতানুসারে।  এই মতানুসরে বলা হয়েছে- নাদ পাঁচ প্রকার। এগুলো হলো- সূক্ষ্ম, অতিসূক্ষ্ম, ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং কৃত্রিম। 

এই গ্রন্থে বলা হয়েছে প্রথম যে ধ্বনির উৎপত্তিস্থল হিসেবে 'বিন্দু' বলা হয়েছে। এই বিন্দু থেকে উৎপত্তি হয়েছে নাদ। আবার এই গ্রন্থেই বলা নাদ থেকে বিন্দু উৎপত্তি হয়। এই গ্রন্থ মতে- নাদ ভিন্ন গীত হয় না। নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সব দিক থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়।

এরপর এই গ্রন্থে পাওয়া যায় শ্রতি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ। এখানে ধ্বনির ব্যখ্যায় তাঁর পূর্বর্তী সঙ্গীতজ্ঞ তম্বরুর মতকে উল্লেখ করেছেন। বাঁশিতে উৎপন্ন নবশ্রুতির কথা ভরতের নাট্যশাস্ত্রে পাওয়া যায়। মতঙ্গ সে মতকেই গ্রহণ করেছিলেন। তবে চূড়ান্তভাবে তিনি ২২  শ্রুতিকে গ্রহণ করেছেন।  এক্ষেত্রে শ্রুতি নিরুপণে তূল্যপ্রমাণ বীণার সাহায্ নিতে বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রথম চলবীণা ও ধ্রুববীণার বিচারে 'সরণা' ধারণা প্রণয়ন করেন। মতঙ্গের মতে- স্বর হলো শ্রুতিসমূহের পরিণাম। তিনি শ্রুতিতে স্বরের বিন্যাস, স্বরের উৎপত্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এরপর  গ্রামভেদে শ্রুতি ও স্বরের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। কোহলের উদ্ধৃতি দিয়ে মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে- পশুপাখির কণ্ঠস্বর থেকে স্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন। স্বর এবং পশুপাখিগুলো হলো- ময়ুর থেকে ষড়্‌জ, চাতক থেকে ঋষভ, ছাগ থেকে গান্ধার, ক্রৌঞ্চ থেকে মধ্যম, কোকিল থেকে পঞ্চম, বর্ষাকালের ব্যাঙ থেকে ধৈবত এবং  হাতি থেকে নিষাদ।

বৃহদ্দেশী রচনাকালে ষড়্‌জ ও মধ্যমগ্রাম ভিত্তিক মূর্ছনা এবং রাগের পরিচয় পাওয়া যায়।  সে সময়ে গ্রামভেদে স্বরের শ্রুতি ব্যবধানে পার্থক্য ছিল। যেমন- ষড়্‌জ গ্রামের শ্রুতি ব্যবধান: চতুঃশ্রতিক, ত্রিশ্রুতিক ও দ্বিশ্রুতিক। এর ভিতরে চতুঃশ্রুতিক ছিল- ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চম, ত্রিশ্রুতিক ছিল- ঋষভ ও ধৈবত, দ্বিশ্রুতিক ছিল- গান্ধার ও নিষাদ।

মধ্যম গ্রামের শ্রুতি বিভাজন: মূলত মধ্যমকে ষড়জ ধরে স্বরসপ্তক রচনা করলে, মধ্যম গ্রামের উদ্ভব হয়। এক্ষেত্রে শ্রুতি ব্যবধান ভিন্ন রূপ পাওয়া যায়। যেমন- চতুঃশ্রুতিক ছিল- ষড়্‌জ, মধ্যম  ও ধৈবত, ত্রিশ্রুতিক ছিল- ঋষভ, পঞ্চম, দ্বিশ্রুতিক ছিল- গান্ধার ও নিষাদ। বর্তমান স্বরবিন্যাস অনুসারে সেকালের মধ্যমগ্রামের স্বর বিন্যাস ছিল-

মধ্যম গ্রামের স্বরবিন্যাস

সমতূল্য স্ববিন্যাস
প (ত্রিশ্রুতিক)
দ, ধ জ্ঞ. গ
র্স
র্র
র্জ্ঞ, র্গ ণ, ন
র্ম র্স

বৃহদ্দেশীতে রাগের বাদী, সম্বাদী বিবাদি স্বরের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে

বাদীস্বর [সঙ্গীত]
ও অনুবাদী স্বরের বিন্যাসের রূপরেখা পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। যেমন-
বাদী  সম্বাদী অনুবাদী
ম,প র, ধ
স,ম,প
 
ম.প র, ধ
স,ম, প
 

গানের জাতি নির্ধারণে পূর্বর্তী নারদের মতা অনুসরণে করে ৭টি জাতি নাম (আর্চিক, গাথিক, সামিক, স্বরান্ত, উড়ুব, ষাড়ব এবং সম্পূর্ণ) উল্লেখ করা হয়েছে। ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামে সম্পূর্ণ, ষাড়ব ও ঔড়ব ভেদে মূর্ছনা ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করতো। এই হিসেবে মূর্চ্ছনার সেট হতো ৬টি।

ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রামের সম্পূর্ণ জাতির মূর্ছনার সেট নিচে দেওয়া হলো-

ষড়্‌জ গ্রামের সম্পূর্ণ জাতির মূর্ছনা

বৃহদ্দেশী নারদমত আরোহণ অবরোহণ
উত্তরমন্দ্রা উত্তরবর্ণা

স র গ ম প ধ ন

ন ধ প ম গ র স

রজনী অভিরুদ্‌গতা ন্ স র গ ম প ধ ধ প ম গ র স ন্
উত্তরা অশ্বক্রান্তা ধ্‌ ন্ স র গ ম প প ম গ র স ন্ ধ্
শুদ্ধষড়্‌জা সৌবিরী প্ ধ্‌ ন্ স র গ ম ম গ র স ন্ ধ্ প্
মৎসরী হৃষ্যকা ম্ প্ ধ্‌ ন্ স র গ গ র স ন্ ধ্ প্ ম্
অশ্বক্রান্তিকা উত্তরায়তা গ্ ম্ প্ ধ্‌ ন্ স র র স ন্ ধ্ প্ ম্ গ্
অভিরুদ্‌গতা রজনী র্ গ্ ম্ প্ ধ্‌ ন্ স স ন্ ধ্ প্ ম্ গ্ র্

মধ্যম গ্রামের সম্পূর্ণ জাতির মূর্ছনা

বৃহদ্দেশী নারদমত আরোহণ অবরোহণ
সৌবিরী আপ্যায়নী

 ম প ধ ন র্স র্র র্গ

র্গ র্র র্স ন ধ প ম

হরিনাশ্বা বিশ্বহৃতা গ ম প ধ ন র্স র্র র্র র্স ন ধ প ম গ
কলোপনতা চন্দ্রা র গ ম প ধ ন র্স র্স ন ধ প ম গ র
শুদ্ধমধ্যা হেমা স র গ ম প ধ ন ন ধ প ম গ র স
মার্জিকা কপর্দ্দিণী ন্ স র গ ম প ধ ধ প ম গ র স ন্
পৌরবী মৈত্রী ধ্ ন্ স র গ ম প প ম গ র স্ ন্ ধ্
হৃষ্যকা চন্দ্রাবতী প্ ধ্ ন্ স র গ ম ম গ র স্ ন্ ধ্ প্


বৃহদ্দেশীতে দ্বাদশ স্বর-মূর্ছনার কথা বলা হয়েছে। এই জাতীয় মূর্ছনায় ১২টি স্বর ব্যবহৃত হতো বলে- এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল তিনটি সপ্তকে কণ্ঠসাধনা করে বা সুরে বিহার করা।

ষড়্‌জ গ্রামের দ্বাদশ মূর্ছনা

বৃহদ্দেশী আরোহণ
উত্তরমন্দ্রা

ধ ন স র গ ম প ধ ন স র গ

রজনী ন স র গ ম প ধ  ন স র গ ম
উত্তরা স র গ ম প ধ ন স র গ ম প
শুদ্ধষড়্‌জা র গ ম প ধ ন স র গ ম প ধ
মৎসরী গ ম প ধ ন স র গ ম  প ধ ন
অশ্বক্রান্তিকা ম প ধ ন স র গ ম  প ধ ন স
অভিরুদ্‌গতা প ধ ন স র গ ম  প ধ ন স র

মধ্যম গ্রামের সম্পূর্ণ দ্বাদশ মূর্ছনা

বৃহদ্দেশী আরোহণ
সৌবিরী

ন স র গ ম প ধ ন স র গ ম

হরিনাশ্বা স র গ ম প ধ ন স র গ ম প
কলোপনতা র গ ম প ধ ন স র গ ম প ধ
শুদ্ধমধ্যা গ ম প ধ ন স র গ ম  প ধ ন
মার্জিকা ম প ধ ন স র গ ম  প ধ ন স
পৌরবী প ধ ন স র গ ম  প ধ ন স র
হৃষ্যকা ধ ন স র গ ম প ধ ন স র গ

এই গ্রন্থে তান ও মূ্র্চ্ছনার প্রভেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে- সপ্তকের আরোহ ও অবরোহ ক্রম হচ্ছে মূর্ছনা। আর সপ্তকের শধু আরোহক্রম হলো- তান। এই বিচারে বলা যায় অর্ধ-মূর্ছনা হচ্ছে তান। এই গ্রন্থে তানগুলোর যজ্ঞনামের উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রামভিত্তিক সম্পূর্ণ-ষাড়ব-ঔড়অব ভেদে তানগুলোর নাম ছিল-

বৃহদ্দেশী রচনাকালে- শাস্ত্রীয় গানের পাশাপাশি দেশী গান  অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বৃহদ্দেশী মতে- এই গান চর্চা করতেন- স্ত্রীলোকগণ, বালকগণ, রাজন্যবর্গগণ। অর্থাৎ এই গানের প্রচলন ছিল ব্যাপকভাবে। এই গানগুলো এঁরা নিজেদের ইচ্ছায় নিজ নিজ দেশে গাইতেন। একথা এগুলো ছিলো আঞ্চলিক গান। যা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাঁদের নিজেদের ভাষায় এবং সঙ্গীতশৈলী অনুসরণ করে পরিবেশন করতেন।

অন্যদিকে মারগ সঙ্গীত তথা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হতো শাস্ত্রীয় রীতিতে। এর দুটি রূপ ছিল। রূপ দুটি হলো-

প্রবন্ধ গানের ধারায় ধ্রুব ও ধ্রুব গানের চর্চা ছিল। এই সময়ে নাটকে ধ্রুবা গান হিসেবে মদ্রক, উল্লোপাক, অপরান্তক, ওবেণক, রোবিন্দক এবং উত্তর নামক- সপ্তগীতের ব্যবহার ছিল। আবর্তনের বিচারে মাগধী, অর্ধমাগধী, সম্ভাবিতা ও পৃথুলা'র ব্যবহার ছিল।
তথ্যসূত্র: