নচিকেতা
বানান বিশ্লেষণ: ্+অ+চ্+ই+ক্+এ+ত্+আ।
উচ্চারণ:
no.cʃi.ke. a (নো.চি.কে.তা)

শব্দ-উৎস: বৈদিক नचिकेता (নচিকেতা)>সংস্কৃত নচিকেতা>বাংলা নচিকেতা।

অর্থ: হিন্দু ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ ও মহাভারতের চরিত্র। এই চরিত্রটি প্রথম পাওয়া যায় কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বল্লরীতে। উপনিষদ মতে, নচিকেতা ছিলেন বাজশ্রবস মুনির পুত্র। বাজশ্রবস (উদ্দালক) নিষ্ঠার সাথে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর, তিন যজ্ঞে উপস্থিত ঋত্বিক এবং সদস্যদেরকে দক্ষিণাস্বরূপ তাঁর গাভীগুলোকে ভাগ করে দেন। নচিকেতা তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করেন যে, এর দ্বারা তাঁর পিতা আনন্দহীন 'অনন্দ'-লোকে স্থান পাবেন। পিতাকে এই অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য, তিনি পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন 'আপনি আমাকে কোন্ ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দান করবেন? পিতাকে এই ভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা করার পর, পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে নচিকেতাকে বললেন, 'তোমাকে যমের উদ্দেশ্যে দান করলাম'। এরপর নচিকেতা পিতার আদেশ রক্ষার্থে- যমালয়ে যান। এই সময় যম নিজগৃহে ছিলেন না। ফলে তিনি যমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। যম তিনদিন পর গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এই তিন দিন তিনি যমগৃহে অনাহারে কাটান। যম ফিরে এসে, অতিথি নচিকতা তিন দিন অনাহরে থাকার বিষয় জানতে পেরে অনুতপ্ত হন এবং প্রতিদিনের জন্য যম তাঁকে একটি করে বর দেওয়ার কথা বলেন। এরপর নচিকেতা যমের কাছে যে তিনটি বর প্রার্থনা করেন, তা হলো-

প্রথম বর: নচিকেতাকে যমালয়ে পাঠিয়ে তাঁর পিতার যে দুশ্চিন্তা হয়েছে, তা প্রশমিত হোক, তাঁর চিত্ত প্রসন্ন হোক, নচিকেতার প্রতি ক্রোধ দূর হোক। যমের কল্যাণে ঘরে ফিরে গেলে তাঁর পিতার পূর্বস্মৃতি যেন জেগে উঠে এবং তিনি যেন নচিকেতাকে চিনতে পেরে সাদর সম্ভাষণ করেন।
 

দ্বিতীয় বর: স্বর্গলোকে কিছুমাত্র ভয় নাই, যমেরও অধিকার নাই, বার্ধক্যজনিত জরার ভয় নাই। সেখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট নাই, শোক বা মানসিক কোনো কষ্ট নাই। তাই যম যেন তাঁকে স্বর্গলোকে যাওয়ার জন্য সাধনভূত অগ্নি-বিদ্যা দান করেন। উল্লেখ্য দ্বিতীয় বর প্রদানের সময় নচিকেতার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যম তাঁকে চতুর্থ বর দেন। এই বরে বলা হয়, যম নচিকেতাকে যে অগ্নির কথা বলেন, সেই অগ্নি 'নচিকেতা অগ্নি' নামে প্রসিদ্ধ হবে।


তৃতীয় বর: আত্মার তত্ত্ব সম্পর্কে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যম এই বর প্রদানে প্রথমে অস্বীকার করেন এবং অন্য কোনো বর প্রার্থনা করতে বলেন।  উত্তরে যম বললেন, 'নচিকেতা, তুমি শতবর্ষ পরমায়ু-বিশিষ্ট পুত্র ও পৌত্রগণ, বহুসংখ্যক গব্যদি পশু, হস্তি ও অশ্ব এবং বহু পরিমাণ স্বর্ণ প্রার্থনা কর। বিস্তীর্ণ আয়তনবিশিষ্ট ভূমি অর্থাৎ সাম্রাজ্য প্রার্থনা কর, তুমি নিজেও যত বৎসর ইচ্ছা বাঁচিয়া থাক।' এছাড়াও যম তাঁকে অতিরিক্ত আরও সম্পদ ও ক্ষমতা প্রদানের অঙ্গীকার করলেন, কিন্তু নচিকেতা তাতে রাজি হলেন না। নানা বিষয়ের অবতারণার পর অবশেষে যম নচিকেতা-কে 'আত্মা' এবং 'ব্রহ্ম' বিষয়ক জ্ঞান দেন।

এরপর নচিকেতা যমালয় থেকে পিতৃগৃহে ফিরে আসেন।

 

মহাভারতের অনুশাসনপর্বের ৭১-অধ্যায়ে নচিকেতা সম্পর্কে যে কাহিনি আছে, তা কিছুটা অন্যরকম। মহাভারতের মতে-

মহর্ষি উদ্দালকি একদিন নদীর তীরে একটি নিয়মানুষ্ঠান করে এসে, তাঁর পুত্র নচিকেতাকে বলেন যে, ভুলে গিয়ে অনুষ্ঠানের কাঠ, কুশ, ফুল কলস ও খাদ্যদ্রব্যাদি ফেলে রেখে এসেছেন। সে যেনো গিয়ে ওইসব দ্রব্য নিয়ে আসে। নচিকেতা নদীতীরে গিয়ে দেখেন যে, নদীর স্রোতে ওই সকল দ্রব্য ভেসে গেছে। নচিকেতা ফিরে এসে পিতাকে এই কথা জানান। এই সময় ক্ষুধা-তৃষ্ণায় উদ্দালকি কাতর ছিলেন। তাই রেগে গিয়ে নচিকেতার উদ্দেশ্যে বলেন যে, তার 'যমদর্শন' হোক। এরপর নচিকেতার মৃত্যু হয়। এরপর পুত্রের মৃত্যুতে উদ্দালকি বিলাপ করতে থাকেন। এক দিন এক রাত্রি পর্যন্ত তাঁকে কুশাসনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ভোর বেলায় নচিকেতা আবার বেঁচে উঠেন। এই সময় উদ্দালকি সন্তুষ্ট চিত্তে নচিকেতাকে বলেন যে, মৃত্যুর পর নচিকেতা শুভলোকসমূহ দর্শন করে এসেছ এবং এই কারণে নচিকেতা নতুন জীবন এবং দেহ লাভ করেছে। নচিকেতা এরপর যমলায়ের বিবরণ দেন এবং উদ্দালকির প্রতি যমের প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবশত নচিকেতাকে কিরূপ সম্মান দেখানো হয়েছে তার বর্ণনা দেন। যম বলেন যে, নচিকেতার মৃত্যু হয় নাই। উদ্দালকি বলেছেন 'যমদর্শন হোক', তাই তাঁর প্রতি সম্মানবশত যমালয়ে দর্শনের জন্য নচিকেতাকে যমালয়ে আনা হয়েছে। এরপর যম নচিকেতাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। নচিকেতা যমের কাছে পুন্যের দ্বারা অর্জিত উৎকৃষ্ট লোকসমূহ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যম নচিকেতার এই ইচ্ছাগুলো পূরণ করেন। পরে নচিকেতা জীবনলাভ করে মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন।