ধর্ম (দর্শন)
শব্দরূপ দেখুন : ধর্ম (অভিধান)
সংস্কৃত ক্রিয়ামূল ধৃ । এর ভাবগত অর্থ হলো 'ধারণ করা'। এর সাথে ম (মন্) , প্রত্যয়যোগে সৃষ্টি হয় ধর্ম্ম। আধুনিক বাংলা বানান হলো ধর্ম। ধর্ম শব্দের এই রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যেই রয়েছে ধর্ম শব্দের মূল সংজ্ঞা।

যেকোনো সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়, তার নিজস্ব কিছু গুণাবলির মাধ্যমে। পানি তরল, খুব শীতল হলে বরফ হয়ে যায়, বেশি গরম করলে বায়বীয় রূপ ধারণ করে। এরূপ নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি সত্তা তার পরিচয় প্রকাশ করে। যেসব গুণাবলি সত্তা ধারণ, তার সমষ্টিগত নাম হলো ধর্ম। আগুনের ধর্ম থেকে পানির ধর্ম আলাদা বলেই এই দুটি সত্তাকে আলাদা করে চেনা যায়।

সমস্যা হলো, যখনই ধর্মের কথা সাধারণভাবে বলা হয়, তখন গোড়াতেই ধরে নেওয়া হয়, মানুষের বিশ্বাসগত ধর্মের কথা বলা হচ্ছে। সেটা খুব দোষণীয় নয়। কিন্তু এইরকম ভাবনার কিছু অসম্পূর্ণতা আছে। মানুষের ধর্ম শুধু বিশ্বাসের নয়, যতকিছু দ্বারা মানুষকে
Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) হিসেবে চেনা যায়, তার সবকিছু মিলেই মানুষ। প্রাথমিকভাবে মানুষের চোখে পড়ার মতো দুটি ধর্ম আমাদের কাছে প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়। এই ধর্ম দুটি হলো−
১. জড়ধর্ম: মানুষের একটি শরীর আছে, এই শরীরের ওজন আছে, জায়গা দখল করে। এর একটি বিশেষ আকার আছে। যা দেখে অন্যান্য বস্তু থেকে মানুষকে আলাদা করা যায়। এই রূপগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই একটি মানুষের মূর্তি বা পুতুলকে মানুষের আদলেই দেখি। কোনো খোলা মাঠের ভিতরে বহু জীবজন্তুর ভিতরেই আকার দেখে মানুষকে আলাদা করা যায়। মানুষের বুদ্ধি, কার্যক্রম এখানে গৌণ। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা পাগল, এমন মানুষকে মানুষই বলি তার আকার দেখে।
২. জীবধর্ম: জীবজগতে মানুষের একটি প্রজাতিগত নাম আছে, তা হলো
sapiens(স্যাপিয়েন্স)। আর গণের বিচারে (হোমো)। দুইয়ে মিলে জীবজগতে মানুষের পৃথক পরিচয় দাঁড়িয়েছে Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স)। এই নামের ভিতরে মানুষের কিছু অহঙ্কার লুকিয়ে আছে। কারণ ল্যাটিন থেকে আগত sapiens শব্দের অর্থ হলো- বিচার-বুদ্ধি রয়েছে। হোমো গণের বিচার-বুদ্ধি করার ক্ষমতা আছে, এমন প্রজাতিই হলো− Homo sapiens অর্থাৎ মানুষ।

জীব হিসেবে মানুষের প্রাণ নামক সত্তা আছে। জন্মগ্রহণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি জীবনচক্রের ভিতরে মানুষ আবদ্ধ। শরীরের ক্ষয় হয় এবং তা পূরণের জন্য মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে। মানুষের প্রজনন ক্ষমতা আছে। ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে জীব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা কিছু দ্বারা মানুষ জীব হিসেবে পরিচিতি পায়, তার সব মিলিয়ে প্রকাশ পায়, মানুষে জৈবধর্ম।
জীবজগতে অন্যান্য সকল জীবেরই এই দুটি ধর্ম আছে। প্রতিটি জীবই এই দুটি ধর্মের বাইরে একটি ধর্ম জীবের থাকে। সেটি হলো অনুভব করার ক্ষমতা। এই অনুভবকে সে ধারণ করে। এই অনুভবকে দিয়ে সে কি করবে বা তার কি করার ক্ষমতা আছে, তা জীবের জিনকোড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে জীব থেকে জীবের অনুভব ক্ষমতা যেমন পৃথক হয়, তেমনি অনুভব থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ব্যবহারও ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়।

মানুষের জিনকোড এবং মস্তিষ্কের গঠনের বিচারে, মানুষের অনুভব, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ইত্যাদি অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে ভিন্নতর হয়। এরই ভিতর দিয়ে মানুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়ে গেছে। সকল মানুষের সমান বিচারবুদ্ধি একই রকমের হয় না। কিন্তু গড় মানে মানুষের বিচারবুদ্ধির যে নমুনা পাওয়া যায়, তা মানুষের বুদ্ধি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মানুষ হতে গেলে, তাকে অবশ্যই জড়ধর্ম এবং জীবধর্মের অধীনেই থাকতে হবে। একটি রোবোটের বুদ্ধি মানুষের মতো হলেও তাকে মানুষ বলা যাবে না, কারণ, রোবোট জড়ধর্ম এবং জৈবধর্মের বিচারে মানুষের মতো নয়।

আদিম মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রাকৃতিক সঙ্কট ছিল মূলত তিনটি। এগুলো হলো- নিজেদের চেষ্টায় এ সকল সঙ্কট থেকে উদ্ধারের কোনো উপায় আদিম মানুষের উপায় জানা ছিল না। অসহায় মানুষ নিরুপায় হয়ে অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো শক্তির কাছে নিজেদেরকে ছেড়ে দিতো। কাকতালীয় কখনো কখনো এ জাতীয় সঙ্কট থেকে তারা উদ্ধার পেতো। মানুষ এই অলৌকিক বিশ্বাসকেই তার সৃজনশীল ক্ষমতার দ্বারা ধর্মীয় উপখ্যান ভিত্তিক বিধিতে পরিণত করেছিল। এর বাইরে সৃজনশীল মানুষ ভেবেছে নিজের জীবন ও মরণ নিয়ে। মানুষ এবং তাঁর পরিবেশ, প্রাকৃতিক নানা উপকরণ নিয়ে ভেবেছে। এসকল ভাবনা থেকে উদ্ভুত প্রশ্নের কিছু জবাব তারা পেয়েছে অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু বেশিরভাগই অজানা থেকে গেছে। তারা জানতে চেয়েছে মৃত্যুর পর তার কি হবে। এই জগৎ সংসার কে তৈরি করলো, তার সাথে মানুষের সম্পর্ক কি? ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আদিম মানুষ হাতড়িয়ে মরেছে। এর ভিতর দিয়ে মানুষের মনে কিছু বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে। আদিম মানুষ যখন দেখেছে, শান্ত পাহাড় গুম গুম শব্দ করে, এর সাথে ভূমি কাঁপে। এর ব্যাখ্যা তারা জানতো না। এরা এর পিছনে কোনো অলৌকিক কোনো শক্তির কথা ভেবেছে। এই অলৌকিক শক্তি একসময় দেবতা হয়ে গেছে। রাগান্বিত মানুষকে প্রশস্তি এবং উপহার দিয়ে শান্ত করা যায়, এই বোধ থেকে আদিম মানুষ দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য, শ্লোক রচনা করেছে আবার উপহার দিয়ে পূজা করেছে। এর সাথে কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ পুরোহিতের ভূমিকায় নেমে, বিধি তৈরি করেছে। সাধারণ মানুষ দেবতার জন্য যে, ভোগ নিবেদন করতো, তা ভোগ করেছে পুরোহিতরা। কালক্রমে এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের বিশ্বাসের ধর্ম। নানা ভাবে নানা দেশে নানা জাতিতে মানুষের ভিতরে নানান ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে। যে বিশ্বাসের শুরুটা ছিল প্রকৃতি নির্ভর, তাই কালক্রমে লোকগাঁথার সাথে যুক্ত হয়ে পৌরাণিক ধর্মে পরিণত হয়েছিল। বহুদেবতার গণ্ডি পেড়িয়ে একেশ্বরবাদে পৌঁছাতে মানুষকে অনেক বিশ্বাসের সংঘাতের ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে। অনেকে আবার কোনো ধরনের স্রষ্টাকেই বিশ্বাস করেন না। একালে মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসের যে রূপ পাওয়া যায়। তার শ্রেণি বিভাজনটা নিচের মতো হতে পারে।