। সাধারণভাবে
বলা যায়, একটি সত্তা যে সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তাই ওই সত্তার বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম।
এই সূত্রেই আমরা বলে থাকি আগুনের ধর্ম, পানির ধর্ম বাতাসের ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু
বস্তুকে অনুভব করা হয়, শুধু এর নিজস্ব গুণ দিয়ে নয়, অন্য কোনো সত্তার কাছে তা
কিভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, তার দ্বারা। এই বিচারে প্রত্যক্ষ সংবেদন হয়ে উঠে কোনো
বিশেষ সত্তার দ্বারা অন্য সত্তার অনুভবের বিষয়। এই অনুভবের বিষয়টি নানা ভাবে সংঘটিত
হতে পারে।
প্রতিটি সত্তার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য বস্তু
থেকে পৃথক করে। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয় অন্য সত্তার শনাক্ত করার ক্ষমতার দ্বারা।
সত্তার ধর্মের প্রকাশ ঘটে সত্তা এবং সত্তা পর্যবেক্ষকের পারস্পরিক তথ্য-যোগাযোগের
সূত্রে। একটি সত্তা যত ধরনের গুণাবলি ধারণ করে, তার সবটুকু পর্যবেক্ষকের কাছে যদি
ধরা না পড়ে, তাহলে পর্যবেক্ষক ওই সত্তার ধর্ম সম্পর্কে আংশিক ধারণা করতে পারে
মাত্র। সেই কারণে একাধিক ব্যক্তি একই সত্তা একই রকমভাবে অনুভব করতে পারে না। ধরা
যাক একটি আলোকিত ঘর। এই ঘরের একটি গুণ হলো আলোকিত দশা। একজন অন্ধলোকের কাছে এই ঘরটির আলোকিত গুণটি ধরা পড়বে না। অন্ধ লোকের বিচারে সবই অন্ধকার। তার অর্থ এই নয়, আলোকিত ঘর হতে পারে না। কোন বর্ণান্ধ মানুষ হয়তো লাল রঙ ধরতে পারে না। সুতরাং একজনের জন্য লাল ফুল, বর্ণান্ধের জন্য তা অন্য রঙের ফুল। সর্দি হলে, আমরা অনেক সময় অনেক গন্ধ পাই না। তার অর্থ এই নয় যে, ওই বস্তুটি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। তাই কোনো সত্তার প্রকৃত গুণ কি, সেটা কোনো সুনির্দিষ্ট মান প্রদান করে না। এই বিচারে মানুষ বা মানবেতর প্রাণী বাস্তবে অন্যকোনো সত্তার ধর্ম সম্পূর্ণ জানতে পারে না তার তথ্যগ্রহণের অক্ষমতার কারণে।
কোনো সত্তার ধর্ম যখন কারো কাছে প্রকাশিত হয়, তখন সত্তার কিছু গুণ বা উপলব্ধি-কৃত গুণের মানের বিচার চলে আসে। একই সাথে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বিচারের বিষয়টি চলে আসে। সাধারণভাবে এই জাতীয় বিষয়গুলো যে ভাবে বিচার করা হয়, তাই হবে সত্তার গুণমানের বিচার। যেমন―
- সত্তার গুণ-তীব্রতা: কেউ যখন কোনো সত্তার গুণকে নিজের মতো করে অনুভব করে, তখন সে এর গুণের তীব্রতা
(Intensity)
বিচারও করে। ধরা যাক কেউ একটি বিশেষ বস্তুকে ‘বল’ বলছে। এখানে দর্শক বলটির আকারের একটি বিশেষ গুণকে বিশেষ মূল্য দিচ্ছে। একই সাথে সে আকারের গুণমানকেও তুলনা করবে, বলটি ছোটো না বড়। আকার, গন্ধ, স্পর্শকাতরতা ইত্যাদি সংবেদনের বিচারে গুণের তীব্রতার বিচার করা হয়। এই বিচারে গুণের তীব্রতার তুলনা করার বিষয়টি নির্ধারিত হয় দুটি প্রক্রিয়া সূত্রে। এর একটি ইন্দ্রিয়গত অপরটি ভাবগত।
- ইন্দ্রিয়গত: ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সকল অনুভব মানুষের মনে উৎপন্ন হয়, তার তীব্রতা নিরূপিত হয়, ইন্দ্রিয়ের সংবেদন মানের বিচারে। তাই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বিচারে গুণ-তীব্রতা নিরূপিত হবে। যেমন―
- দর্শনগত বিচার: কোনো সত্তাকে যেভাবে দেখা যায়, তার বিচারে গুণসত্তার তীব্রতা নিরূপিত হয়। ত্রিমাত্রিক জগতের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এর মূল মাপকাঠি। এর দ্বারা অবয়গত লম্বা, খাটো, মোটা, চিকন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা করা হয়। এর সাথে থাকতে পারে আলো এবং দর্শনেন্দ্রিয়ের সংবেদন গুণ। উভয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি হবে আলোর ও রঙের তীব্রতা। বস্তুর অবস্থানের বিচারে সৃষ্টি হবে ছোটো বা বড়র আকার। বস্তুর অন্য গুণমানের তীব্রতাও সৃষ্টি হয়। স্পর্শ না করেই যেমন অনুভব করা যায় তরল, কঠিন, স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ ইত্যাদি।
- শ্রবণগত বিচার: সাধারণভাবে শ্রাব্য ধ্বনিসমূহের প্রাথমিক বিচার করা হয়, শব্দের তীব্রতা, উচ্চতা, শব্দ-উৎসের দূরত্ব। এরপরে একে একে বিচারে আসে কর্কশ, সুরেলা, বিরক্তিকর, সুখকর ইত্যাদি বিষয়। এছাড়া কোন বস্তুর কম্পনে শব্দ তৈরি হয়, তাও বিবেচনায় আসে। যেমন― শব্দটির বস্তুগত রূপ হতে পারে ধাতব, জলজ, চামড়াজাত ইত্যাদি। আধুনিককালে শব্দ ভৌতধর্মী না বৈদ্যুতিক সেটাও বিবেচনা করা হয়।
- স্পর্শগত বিচার: স্পর্শের দ্বারা বস্তুর কার্কশ্য, মসৃণতা, তাপ, তারল্য, কাঠিন্য ইত্যদি অনুভব করা যায়। এর কোনটি কমবেশি তার বিচার হয় তীব্রতার দ্বারা। এর দ্বারা আমরা অনুভব করি কম গরম, বেশি গরম, কম মসৃণ, বেশি মসৃণ ইত্যাদি। এর বাইরে স্নেহের স্পর্শ, প্রণয়ের স্পর্শ, আঘাতের স্পর্শের তীব্রতা অনুসারে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি।
- আস্বাদনগত বিচার: মিষ্টি, টক, লোনা, তিতা এই চারটি মৌলিক আস্বাদনের অনুভবের তীব্রতা বিচার অহরহ করে থাকি। আস্বাদনে বেদনার দ্বারা সৃষ্টি হয় ঝাল। এছাড়া একাধিক আস্বাদনের মৌলক উপাদানের মাধ্যমে তৈরি হয় নানারূপ মিশ্র অনুভব। আর অনুভব সৃষ্টি হলেই চলে আসে তীব্রতার প্রশ্ন। তুলনামূলক বিচারে কম মিষ্টি, বেশি মিষ্টির মতো বিষয় এই বিচারে থাকেই।
- ঘ্রাণগত বিচার: বস্তু থেকে আগত উদ্বায়ী অংশ যখন আমাদের নাকে এসে পৌঁছায়, তখন নানারকম গন্ধ অনুভূত হয়। একই সাথে মনোজগতে এর বিচার করা হয় গন্ধটা কম না বেশি।
- ভাবগত বিচার: ইন্দ্রিয় দ্বারা বস্তুর গুণ অনুভব করে যে ধরনের তীব্রতা অনুভব করা যায়, ভাবগত অনুভবের তীব্রতা সেরূপ। একটি গান শুনে ভালো না খারাপ লাগছে, তার সাথে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক থাকলেও, এর ভিতরে অতীন্দ্রিয় রূপ আছে। গানের ধ্বনিরূপ সুরেলা কি সুরেলা নয়, শব্দমান মৃদু কি উচ্চ সেটা ইন্দ্রিয়গত। কিন্তু গানের ভাবগত রূপ যা ভিন্নতর অনুভবের সৃষ্টি করে। এই অনুভবের তীব্রতা আমাদেরকে বিমোহিত করে কিংবা বিরক্তির সৃষ্টি করে, তার সাথে অবশ্যই ভাবের তীব্রতার সম্পর্ক থেকেই যায়।
যে কোন সত্তার ধর্মের
সাথে গভীরভাবে মিশে আছে-বিশ্বাস।