শব্দ/ধ্বনি
ইংরেজি : sound

সাধারণ অর্থে ধ্বনি হলো শব্দের (sound) প্রতিশব্দ মাত্র। বাংলাতে ধ্বনি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে অবিকৃতভাবে। প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে তৎসম শব্দ। ধ্বনি {সংস্কৃত
ধ্বন্ (শব্দ করা) +ই, ভাববাচ্য}। ধ্বনি শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বিচারের মূল্য রয়েছে ভাষাতত্ত্বে। শব্দবিজ্ঞানে এই বিশ্লেষণ কোনো ধ্বনির কোনো প্রকৃষ্ট সংজ্ঞা উপস্থাপনে সহায়তা প্রদান করে না। শব্দবিজ্ঞানীদের অভিমত হলো কোনো কারণে যখন কোনো বস্তু কম্পিত হয়, তখন ওই কম্পন কম্পিত বস্তুর পার্শ্বস্থ মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপের কারণেই উক্ত মাধ্যমে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে উৎপন্ন তরঙ্গ তার উৎপত্তি-স্থানের সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের উপর ভর করে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই তরঙ্গই হলো হলো ধ্বনির বহমান রূপ। কম্পনের সূত্রে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত অজস্র ধ্বনির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় সকল শব্দতরঙ্গ উজ্জীবিত করে না। এই বিচারে মানুষের শ্রুত বা অশ্রুত তথা সকল শব্দতরঙ্গই শব্দ বা ধ্বনি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

মূলত যখন কোনো শব্দতরঙ্গ মানুষের কানে এসে আঘাত করলে
শব্দের প্রাথমিক অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে শব্দতরঙ্গ কান পর্যন্ত পৌঁছায় মাধ্যমের ভৌত ধর্মকে অবলম্বন করে। কিন্তু এই ভৌত সঞ্চালন থেকে প্রাপ্ত শব্দের অনুভূতি হয়ে দাঁড়ায় জৈবিক ধর্মের অংশ। কানে শব্দতরঙ্গ আঘাত করলে, তা অন্তঃকর্ণ হয়ে মস্তিষ্কের শব্দ প্রক্রিয়াকরণ অংশে পৌঁছায়। মস্তিষ্কের প্রক্রিয়াজাতের ফলে যে সার্বিক ফলাফল পাওয়া যায়, তাকেই আমরা শব্দ হিসাবে বিবেচনা করে থাকি। এক্ষেত্রে বস্তুজগতে এটি ‘শব্দ-শক্তি' হিসাবে বিবেচিত হলেও, মানুষের কাছে তা একটি অনুভূতি মাত্র।

শব্দ তৈরি এবং তা শোনার জন্য প্রয়োজন তিনটি প্রাথমিক শর্ত পূরণ। এই তিনটি শর্ত হলো
শব্দের উৎস, শব্দ প্রবাহের মাধ্যম ও শ্রবণেন্দ্রিয়। একে প্রাথমিক শর্ত বলছি এই জন্য যে, কোন বস্তু কম্পিত হলেই যে শব্দ শোনা যাবে, এমন কোন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আবার মাধ্যম ছাড়া ধ্বনি তরঙ্গ প্রবাহিত হয় না। তাই মানুষের কাছে তা শ্রবণযোগ্য হয়েঢ ওঠে না। আবার শ্রবণেন্দ্রিয়ে অক্ষমতার জন্যও মানুষ শব্দ শুনতে পারে না। এই সূত্রে সিদ্ধান্তে আসা যায়, মানুষ যত ধরনের শব্দ শুনে থাকে, তার পিছনে মৌলিক তিনটি বিষয় সক্রিয় থাকে। এই বিষয় তিনটি হলো

শব্দের উৎস, শব্দপ্রবাহের মাধ্যম এবং সুস্থ শ্রবণেন্দ্রিয়ের শর্ত পূরণ হওয়ার পরও মানুষ সকল ধরনের শব্দ বা ধ্বনি শুনতে পায় না। মানুষের শব্দ শ্রবণের এই ত্রুটির কারণে, সৃষ্টি হয়েছে মানুষের শ্রাব্যসীমা। শ্রবণেন্দ্রিয়ের এই সীমাবদ্ধতা বিচারে শব্দকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ভাগ ২টি হলো

১. শ্রাব্য শব্দ (Audible sound) : মানুষ ২০ থেকে ২০,০০০ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পারে। তাই এই শ্রবণ-সীমার মধ্যবর্তী কম্পাঙ্কের শব্দকে শ্রাব্য শব্দ বলা হয়। তবে সকল মানুষের শ্রবণক্ষমতার বিচারে এই সীমা কোনো ধ্রুবমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কারণ, ব্যক্তি বিশেষের শ্রবণ ক্ষমতার হেরফের লক্ষ্য করা যায়। তাই শ্রাব্য শব্দের  ২০ থেকে ২০,০০০ কম্পাঙ্কমান হলো মানুষের শ্রবণক্ষমতার গড়মান।

২. অশ্রুত শব্দ: ২০ থেকে ২০০০০ কম্পাঙ্কের বাইরে শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। শ্রাব্য বা শ্রুত শব্দের বাইর শব্দকেই বলা হয় অশ্রুত শব্দ। অশ্রুত শব্দকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-

১.. অবশ্রুতি বা শব্দেতর শব্দ (Infrasonic sound) : ২০ কম্পাঙ্কের নিচের শব্দকে বলা হয় অবশ্রুতি বা শব্দেতর।
১.২. শব্দোত্তর বা শ্রবণোত্তর
(Ultrasonic sound) : ২০,০০০ কম্পাঙ্কের উপরের শব্দকে বলা হয় শব্দোত্তর বা শ্রবণোত্তর। 

শব্দকম্পাঙ্ক
আগেই বলেছি বস্তু কম্পিত হওয়ার সূত্রে শব্দ সৃষ্টি হয়। কোনো বস্তুকে আঘাত করলে, বস্তুর সমগ্র অংশ বা অংশ বিশেষের কণাগুলো স্থানচ্যুত হয়। এক্ষেত্রে শুরুতেই বস্তুর আঘাত প্রাপ্ত অংশ একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু বস্তুর ভিতরের টানে অচিরেই তা আগের জায়গায় ফিরে আসে। যদি বস্তু তার আগের জায়গাতে ফিরেও আসে, তা হলে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না, বরং বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণে বস্তু বিপরীত দিকে যাত্রা করে। পরে বস্তুর ভিতরের টানে আবার তা আগের জায়গায় চলে আসে। এই ভাবে বস্তু যখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজাত প্রক্রিয়ায় একটি দোলন সম্পন্ন করে, তখন একটি পূর্ণ কম্পন বা স্পন্দনের
(Oscillation) সৃষ্টি হয়। আর প্রতি সেকেন্ডে বস্তু যতবার পূর্ণ কম্পন শেষ করে, তার সংখ্যাকে বলা হয় কম্পাঙ্ক (Frequency)। কম্পাঙ্কের একক হলো হার্টজ (Hertz)। কোন বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে ২০ বার কাঁপে তবে তাকে বলা হবে ২০ হার্টজের শব্দ। দশমিক পদ্ধতিতে হার্টজের গুণিতক মানগুলো ধরা হয় নিম্নরূপ
   
1000 Hz = 1KHz (Kilo Hertz)
    1000,000= 1000 KHz=1MHz (Mega Hertz)
 

সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে সঞ্চালিত দীঘল তরঙ্গ। সূত্র : উইকিপেডিয়া

শব্দতরঙ্গ ও তারা বৈশিষ্ট্য
আগেই বলেছি বস্তু কম্পিত হওয়ার সূত্রে শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি হয়। মূলত কোনো বস্তুকে আঘাত করলে, বস্তুর সমগ্র অংশ বা অংশ বিশেষের কণাগুলো স্থানচ্যুত হয়। এক্ষেত্রে শুরুতেই বস্তুর আঘাত প্রাপ্ত অংশ একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু বস্তুর ভিতরের টানে অচিরেই তা আগের জায়গায় ফিরে আসে। যদি বস্তু তার আগের জায়গাতে ফিরেও আসে, তা হলে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না, বরং বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণে বস্তু বিপরীত দিকে যাত্রা করে। পরে বস্তুর ভিতরের টানে আবার তা আগের জায়গায় চলে আসে। এই ভাবে বস্তু যখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজাত প্রক্রিয়ায় একটি দোলন সম্পন্ন করে, তখন একটি পূর্ণ কম্পন বা স্পন্দনের (Oscillation) সৃষ্টি হয়। আর প্রতি সেকেন্ডে বস্তু যতবার পূর্ণ কম্পন শেষ করে, তার সংখ্যাকে বলা হয় কম্পাঙ্ক (Frequency)। কম্পাঙ্কের একক হলো হার্টজ (Hertz)। কোন বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে ২০ বার কাঁপে তবে তাকে বলা হবে ২০ হার্টজের শব্দ। দশমিক পদ্ধতিতে হার্টজের গুণিতক মানগুলো ধরা হয় নিম্নরূপ
   
1000 Hz = 1KHz (Kilo Hertz)
    1000,000= 1000 KHz=1MHz (Mega Hertz)


কোনো বস্তুকে আঘাত করলে, বস্তু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে একটি কম্পাঙ্ক উৎপন্ন করবে। এই কম্পাঙ্কটি হবে বস্তুর নিজস্ব কম্পাঙ্ক। একে বলা হয়, বস্তুর স্বাধীন কম্পাঙ্ক (Free Frequency)। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো বস্তুকে আঘাত করলে, বস্তু তার স্বাধীন কম্পাঙ্ক অনুসারে শব্দ উৎপন্ন করতে থাকে। এরপর বস্তুর পার্শ্বস্থ মাধ্যমের সূত্রে একটি পর্যায়ক্রমিক কম্পাঙ্কের অধীনে চলে যায়। এরপর বস্তু তার স্বাধীন কম্পাঙ্ক হারিয়ে ফেলে পর্যায়ক্রমিক শক্তির দ্বারা স্পন্দিত হয়। বস্তু যখন এই ভাবে পর্যায়ক্রমিক শক্তির দ্বারা স্পন্দিত হতে বাধ্য হয় এবং এর দ্বারা যে কম্পাঙ্কের সৃষ্টি, তাকে বলা পরবশ কম্পাঙ্ক (Forced Frequency) ধরা যাক একটি সুরশলাকা হাতের তালুতে রেখে আঘাত করা হলো। দেখা যাবে এই অবস্থায়, সুরশলাকা থেকে জোরালো শব্দ পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই সুরশলাকাকে যদি একটি টেবিলের উপর রেখে আঘাত করা যায়, তাহলে জোরালো শব্দের সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে সুরশলাকার কম্পাঙ্ক দ্বারা টেবিল আবেশিত হয়ে কম্পিত হতে থাকবে এবং টেবিল এর দ্বারা অধিক পরিমাণ বায়ুকে আন্দোলিত করবে। এর ফলে শব্দ জোরালো হয়ে উঠবে।

পর্যায়বৃত্ত বলের প্রভাবে সৃষ্টি হয় অনুনাদ
(Resonance)। পর্যায়বৃত্ত বলের কারণে যখন কোনো বস্তুর কম্পাঙ্ক যদি বস্তুর নিজস্ব কম্পাঙ্কের সমান হয়ে যায়, তখন জোরালো কম্পনের সৃষ্টি হবে। এই জোরালো কম্পনই অনুনাদ সৃষ্টি করবে। ধরা যাক একটি ঝুলন্ত সেঁতুর উপর দিয়ে কিছু সৈন্য পার হবে। সেঁতুর একটি নিজস্ব কম্পন আছে। সেঁতুর উপর দিয়ে তালে তালে পা ফেলে সৈন্যরা যখন এগিয়ে যাবে। তখন পা ফেলার কারণে সৃষ্ট কম্পাঙ্ক যদি সেঁতুর নিজস্ব কম্পাঙ্কের সাথে মিলে যায়, তাহলে অনুনাদের সৃষ্টি হবে।

 

শব্দতরঙ্গ ও তারা বৈশিষ্ট্য
কম্পমান বস্তু তার সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে যে আন্দোলনের সৃষ্টি করে, তা থেকেই তৈরি হয় শব্দ তরঙ্গ
(Sound wave)। শব্দ দীঘল তরঙ্গ-এ সঞ্চালিত হয়। শব্দতরঙ্গ সঞ্চালিত হওয়ার সময়, মাধ্যমের কণাগুলো কোনো কোনো স্থানে সঙ্কুচিত হয়, ফলে পও স্থানে মাধ্যমের কণাগুলো ঘনীভূত হয়। আবার এই ঘনীভূত মাধ্যম দূরে সরে গিয়ে প্রসারণ ঘটায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরঙ্গের শীর্ষবিন্দু ও পাদ বিন্দুর সৃষ্টি করে। যে কোনো শব্দ সঞ্চালনের সময় প্রতিটি শব্দ তিনটি ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়।  ভাগ তিনটি হলো-

এই তিনটি ভাগের ভিতরে শব্দশক্তি হিসেবে টিকে থাকে প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। এই দুটি ভাগ শ্রোতার কানে এসে অনুভূতির সঞ্চার করে। তৃতীয় ভাগ মাধ্যম দ্বারা শোষিত হয়ে বিলীন হয়ে যায়। ফলে শব্দ-উৎস থেকে যে শক্তি তরঙ্গাকারে সঞ্চালিত হয়, তার সবটুকু শ্রোতা শুনতে পায় না। শব্দ-উৎসের কাছাকাছি যে শ্রোতা থাকে, সে শব্দ জোরে শোনে। কারণ, মাধ্যম দ্বারা শোষিত শব্দাংশ কম থাকে। অপেক্ষাকৃত দূরের শ্রোতা অপেক্ষাকৃত কম শুনবে, মাধ্যম দ্বারা বেশি শোষিত হওয়ার কারণে। বহুদূরের শ্রোতা কিছুই শুনতে পাবে না। কারণ শব্দের সকল অংশই মাধ্যম দ্বারা শোষিত হবে যাবে।


শব্দ তরঙ্গ উৎপন্নকালে একটি সর্বোচ্চ ঘাত ও একটি সর্বনিম্ন ঘাতের সৃষ্টি করে। এই সর্বোচ্চ ঘাতকে বলা হয় শীর্ষবিন্দু
(Crest), আর সর্বনিম্ন বিন্দুকে বলা হয় পাদবিন্দু (Trough)। শব্দতরঙ্গে মাধ্যমের কণাগুলো নানা অবস্থানে থাকতে পারে। কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ে কোনো তরঙ্গের অন্তর্গত কোনো মাধ্যম-কণা যে অবস্থায় থাকে, তাকে শব্দের দশা (Phase) বলা হয়। কোনো শব্দ তরঙ্গের পর্যবেক্ষণের সময় ওই তরঙ্গের অন্তর্গত কোনো কণার অবস্থান যে স্থানে প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়, তাকে আদি দশা বলা হয়। আর সময়ের সাথে দশার পরিবর্তনের হারকে কৌণিক কম্পাঙ্ক (Angular frequency) বলা হয়। যদি কোনো বস্তুর দশা পরিবর্তন
হয় এবং পূর্ণ কম্পন T হয়, তাহলে কৌণিক কম্পাঙ্ক ω = /T হবে। এর একক radian per second। এর সংক্ষেপ rad s-1

 

 শব্দতরঙ্গ কোন মাধ্যম দ্বারা বাহিত হওয়ার সময় শব্দ একটি সরল পথ ধরে অগ্রসর হয়। এই পথকে তরঙ্গের শীর্ষ ও পাদ বিন্দুর বিচারে শূন্য অবস্থান ধরা যেতে পারে। এই অবস্থান থেকে এর শীর্ষ বা পাদ বিন্দু যতটা দূরে অবস্থান করে, তার দূরত্বকে বিস্তার বলা হয় শব্দতরঙ্গের বিস্তার (Amplitude)। আর কোন তরঙ্গে দুটি শীর্ষবিন্দু বা পাদবিন্দুর মধ্যবর্তী যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য (Wave Length)। পদার্থ বিজ্ঞানে শব্দতরঙ্গের দৈর্ঘ্যকে গ্রিক ল্যামডা (λ) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একটি পূর্ণ তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য শেষ করতে যে সময় লাগে, তাকে বলে পর্যায়কাল বা দোলনকাল (Time Period)

 

 

ধ্বনি মোড়ক (sound envelope)
শব্দ তৈরি হয়, তখন এক সময় তা মিলিয়ে যায়। ধ্বনির সৃষ্টি এবং মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যে ভিতরের সময় হলো শব্দের জীবদ্দশা বা স্থায়ীদশা। শব্দের স্থায়ীদশার ভিতরে শব্দের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- শব্দ-উৎস থেকে সজোরে শক্তি নির্গত হয়। ফলে মাধ্যমের উপরে বড় ধরনের ধাক্কার সৃষ্টি করে। এই ধাক্কাকে বলা হয় শব্দাঘাত (attack)। শব্দাঘাত মূলত শব্দকে একটি উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়। এই উচ্চমাত্রা শব্দতরঙ্গের শীর্ষবিন্দু তৈরি করে। শব্দাঘাত দ্বারা সৃষ্ট শীর্ষদশায়, শব্দ বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। এরপর এর পতন হতে থাকে। একে বলা হয় শব্দ-পতন (decay of a sound)। শব্দের এই পতনের একটি জায়গায় এসে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। এই সময়কে শব্দকে সুস্থির দশা বা শব্দস্থিতি (sustain) বলা হয়। এই সুস্থির দশার পরে আসে শব্দের চূড়ান্ত পতন দশা। এই দশাকে বলা হয় শব্দমুক্তি (decay of a release)। এর পুরোটুকই শব্দতরঙ্গের বিস্তারে অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশের চিত্রে এর বিষয়টি দেখানো হলো।

যে কোন শব্দতরঙ্গে এই প্রক্রিয়াটি ছোট ছোট মোড়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ মূলত শব্দ মোড়কে বা ধ্বনিমোড়কে থাকে পর্যায়ক্রমে শব্দাঘাত, শব্দপতন, শব্দস্থিতি এবং শব্দমুক্তি। নানা ধরনের শব্দে থাকে নানা ধরনের ধ্বনিমোড়ক। এই মোড়কের সূত্রে সৃষ্টি হয় তরঙ্গরূপ।

 

শব্দতরঙ্গের চলন
যখন
কোনো শক্তি মাধ্যমের ভিতর দিয়ে তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হয়, তখন শব্দ-মাধ্যমের বাধার কারণে একইভাবে সরলগতিতে চলতে পারে না। ফলে তরঙ্গমুখে কোথাও কোথাও জটলা সৃষ্টি হয়। মূলত শব্দতরঙ্গের প্রবাহের ফলে শব্দ মধ্যমে যে চাপের সৃষ্টি হয়, সেই চাপে মাধ্যমে ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। একে বলা সঙ্কোচন দশা
(compression)। এই সঙ্কোচন অঞ্চলে শব্দ তরঙ্গ শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায়। বিষয়টি নিচের চিত্রে দেখানো হলো।

           

শব্দতরঙ্গের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে সাধারণভাবে শব্দতরঙ্গের বিস্তার বলা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দের বিস্তার বলতে সঙ্কোচন অঞ্চলকে বুঝায়। এই অঞ্চলের শীর্ষ দশাকে শব্দতরঙ্গের শীর্ষবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পক্ষান্তরে সূক্ষ্মভবন অঞ্চলে থাকে শব্দ তরঙ্গের পাদবিন্দু। শব্দবিজ্ঞানে তরঙ্গের এই বিশেষ রূপকে বলা হয় সাইন-তরঙ্গ  (sinewave)

                                
 

শব্দের শ্রবণপ্রকরণ:

বাস্তবে আমরা যত ধরনের শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা অর্জন করি, শ্রবণের বিচারে তার সবগুলোর প্রকৃতি একই রকম হয় না। শ্রবণ-প্রকৃতি অনুসারে প্রাথমিকভাবে শ্রাব্য ধ্বনিকে ৩টি ভাগে ভাগ করতে পারি। এই ভাগ তিনটি হলো- মৌলিক, যৌগিক ও মিশ্র।

 

শব্দের তীব্রতা ও উচ্চতা:
যখন
কোনো শক্তি মাধ্যমের ভিতর দিয়ে তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হয়, তখন তরঙ্গমুখের একক ক্ষেত্রফলের ভিতর দিয়ে প্রতি একক সময়ে যে পরিমাণ শক্তি প্রবাহিত হয়, তার পরিমাণকে তরঙ্গের তীব্রতা (Intensity) বলে। শব্দের ক্ষেত্রে একে বলা হয় শব্দ-উচ্চতা (Loudness) বলা হয়।

চিত্র-১


একটি শব্দ তরঙ্গের আকার বড় হয়, তখন তা জোরালো শোনা যায়। তার অর্থ হলো ওই জোরালো শব্দটির ভিতর দিয়ে শক্তিপ্রবাহের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। পাশের চিত্র-১ লক্ষ্য করুন। এখানে দুটো ধ্বনির তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য একই। কিন্তু ক সংখ্যক ধ্বনির বিস্তার বেশি বলে, এটি জোরে শোনা যাবে। পক্ষান্তরে খ সংখ্যক ধ্বনি শোনা যাবে আস্তে। কারণ ক এর শব্দতরঙ্গে শক্তির প্রবাহ খ-এর চেয়ে বেশি।

গাণিতিকভাবে শব্দের তীব্রতা প্রকাশের সূত্রটি হলো
          
I= 2f2a2ρv

            =বস্তুর দশা পরিবর্তন
            f=তরঙ্গ উৎসের কম্পাঙ্ক
           
a=তরঙ্গের বিস্তার
           
ρ=তরঙ্গের গতিবেগ
           
v=মাধ্যমের ঘনত্ব
 

সাধারণত দেখা যায়, স্রোতা শব্দের উৎপত্তিস্থলের যত বেশি কাছে থাকে, সে তত বেশি জোরে শব্দ শুনতে পায়। এর দ্বারা শব্দের শব্দোচ্চতা অনুভব করে। আবার শ্রোতা দুটি শব্দের একটির শব্দোচ্চতা থেকে অপরটির শব্দোচ্চতা কম অনুভব করে, তাহলে সে দুটি শব্দের ভিতর তুলনা করবে। শব্দোচ্চতা'র দ্বারা সে যে তুলনামূলক ধারণা পাবে, তা শব্দের তীব্রতার হ্রাসবৃদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করবে। মূলত শব্দের কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে গতিমুখে লম্বভাবে অবস্থিত একক ক্ষেত্রফলের ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শব্দশক্তি প্রবাহিত হবে, তাকে ওই বিন্দুর তীব্রতা বলা হবে।শব্দের তীব্রতা একটি ভেক্টর রাশি।

শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণসমূহ

 

চিত্র-২

শব্দ-তীক্ষ্ণতা (Pitch)
প্রতিটি ধ্বনির রয়েছে সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ। যখন শব্দের কম্পাঙ্ক বৃদ্ধি পায়, তখন শব্দ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। এই জাতীয় শব্দকে আমরা সাধারণত চিকন সুর বলে থাকি। আবার শব্দের কম্পাঙ্ক যত কমে যায়, শব্দ তত বেশি মোটা শোনায়। কম্পাঙ্ক নির্ভর শব্দের এই গুণকে বলা হয় শব্দ-তীক্ষ্ণতা
(Pitch)। পাশের চিত্র-২ লক্ষ্য করুন। প্রথম ক ধ্বনিটি মোটা শোনাবে কারণ এর কম্পাঙ্ক কম। কিন্তু নিচের খ ধ্বনিটির কম্পাঙ্ক বেশি বলে, এই ধ্বনিটি চিকন শোনাবে। যেহেতু  শ্রাব্য শব্দের  গড় মান হলো ২০ থেকে ২০,০০০ কম্পাঙ্ক, তাই এর বাইরের শব্দকে আর তীক্ষ্ণতার আওতায় আসে না। মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা ও কম্পাঙ্কের বিচারে শব্দ-তীক্ষ্ণতাকে চিহ্নিত করা যায়। যদিও ঘুরেফিরে এই দুটিই মান একই অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ যখন কেউ তাঁর জৈবিক অনুভূতির বিচারে কোনো শব্দকে বলে  'মোটা শব্দ' বলেন, তার অর্থ দাঁড়ায় শ্রাব্য-শব্দটি অল্প কম্পাঙ্কের।

মানুষের শ্রবণক্ষমতার বিচারে মোটা বা চিকন শব্দের প্রান্তীয় অংশকে শব্দতীক্ষ্ণতার নিম্নস্তর বা উচ্চস্তর নির্ধারণ করা যায়। একই বিচারে এর মধ্যস্তরও পাওয়া যায়। এই স্তরটি হলো- অতি মোটাও নয়, অতি চিকনও নয়। সঙ্গীতশাস্ত্রে এই মানকে ধরা হয় মধ্য সপ্তকের স্বরসমূহ। আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বর হলো
A4,  যাকে ভারতীয় রীতিতে মধ্য সম্পকের ষড়্‌জ বলা যেতে পারে। এর মান ৪৪০ হার্টজ। অবশ্য ভারতীয় রীতিতে ষড়্‌জ যে কোনো সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিই  হতে পারে। এখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত A4-এর তুলনামূলক উদাহরণ হিসেবে ষড়্‌জ বলা হয়েছে। A4 স্কেলের আটটি মৌলিক স্বরের (স র গ ম প ধ ন) সেটকে যদি একটি অষ্টক (Octave) বিবেচনা করা যায়, তা হলে A4-এর নিচের অক্টেভগুলোর  (A0, A1, A3) শব্দ তীক্ষ্ণতা মোটা হবে অল্প কম্পাঙ্কের সূত্রে। একইভাবে A4-এর উপরের অক্টেভগুলো (A5, A6, A7...) শব্দ তীক্ষ্ণতা চিকন হবে অল্প কম্পাঙ্কের সূত্রে।

 

আমাদের চারপাশের বধির ছাড়া সবাই শব্দ শুনতে পায় এবং প্রতিটি শ্রাব্য শব্দকে মোটামুটি পৃথকভাবে শনাক্ত করতে পারেন। এই সব মানুষের মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সঙ্গীতের স্বরগুলো পৃথকভাবে শনাক্ত করতে পারেন। অর্থাৎ সঙ্গীতের ষড়্‌জ এবং ঋষভের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না।  এটা ঘটে শব্দ-তীক্ষ্ণতার অভাবের কারণে। সঙ্গীতজগতে এদেরকে বলা হয় সুরকানা।

 

শব্দের গতি
শব্দের গতি নির্ভর করে শব্দ সঞ্চালনের মাধ্যমের উপর। বায়বীয় মাধ্যমে শব্দের গতি নির্ভর করে বাতাসের তাপমাত্রার উপর। সমুদ্রতল বরাবর ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় শব্দের গতি প্রায় ৩৪৩ মিটার/সেকেন্ড। আর একই তাপমাত্রা বিশুদ্ধ পানিতে শব্দের গতি ১,৪৮২ মিটার/সেকেন্ড। ধাতব পদার্থের ভিতর শব্দের গতি অনেক বেশি পাওয়া যায়। ইস্পাতের ভিতর দিয়ে শব্দের গতি পাওয়া যায় প্রায় ৫.৯৬০ মিটার/সেকেন্ড। উল্লেখ্য শূন্য মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ প্রবাহিত হয় না।

 

 

শব্দ-রঞ্জকতা (timbre)
যখন কোনো একক সম-তরঙ্গের একটি শব্দ ক্রমাগত একই শব্দ-উচ্চতায়, শব্দ-তীক্ষ্ণতায় বাজতে থাকে। তাহলে ওই শব্দকে সঙ্গীতোপযোগী শব্দ হবে। কিন্তু যদি এর সাথে আরও কিছু শব্দতরঙ্গ এর সাথে যুক্ত হয়, তখন দুই তরঙ্গ মিলে শ্রোতা একটি মিশ্রিত অনুভূতি লাভ করবে। এখানে মূল স্বরটি যদি f তরঙ্গের হয় এবং এর সাথে যদি 2f তরঙ্গের একটি শব্দ যুক্ত হয়, তাহলে f এবং 2f তরঙ্গ মিলে একটি মিশ্র শব্দের সৃষ্টি করবে। ফলে শ্রোতা মূল f তরঙ্গের স্বর আর 2f তরঙ্গের স্বরকে একই সাথে একই মানের, আবার ভিন্ন প্রকৃতির মনে হবে। অর্থাৎ স্বরের বিচারে, উভয় স্বরকে শ্রোতার কাছে একই মনে হবে, কিন্তু শব্দরঞ্জকতার বিচারে ভিন্নতর মনে হবে।

মূল শব্দের সাথে এইভাবে নানারকমের শব্দ তরঙ্গ যুক্ত হয়ে শব্দের গুণমান নানা রকমভাবে পাল্টে দিতে পারে। শব্দের এই জাতীয় গুণমান পরিবর্তনকে শব্দ-রঞ্জকতা বলা হয়। এই কারণে হারমোনিয়ামের ষড়্‌জ এবং বেহালার ষড়্‌জ-এর মূল স্বর একটি সাধারণ কম্পাঙ্ককে অনুসরণ করলেও উভয় যন্ত্রের ষড়্‌জের সাথে অন্যান্য কম্পাঙ্ক মিশ্রিত হওয়ার ফলে, দুটি ষড়্‌জের শব্দ-রঞ্জকতা পৃথক হবে। সে কারণেই হারমোনিয়াম এবং বেহালার ষড়্‌জ স্বরের বিচারে এক হয়েও শব্দরঞ্জকতার কারণে দুই রকম শোনাবে।

শব্দরঞ্জকতার মূলে থেকে একটি প্রধান কম্পাঙ্কের ধ্বনি। এই কম্পাঙ্ককে বলা হয় মৌলিক কম্পাঙ্ক (
fundamental frequency) আর এর সাথে যুক্ত অন্যান্য সকল কম্পাঙ্কগুলোকে বলা হয় সহযোগী কম্পাঙ্কসমূহ (additional frequencies)। এই দুই ধরনের কম্পাঙ্কের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি।

শব্দের উপরিপাতন ও শব্দের ব্যতিচার
যখন দুটি শব্দ তরঙ্গ কোনো মাধ্যমের একই বিন্দুর মধ্য দিয়ে একই সময়ে একই রেখায় প্রবাহিত হয়, তখন দেখা যায় প্রত্যেক তরঙ্গ ওই বিন্দুতে নিজ নিজ সরণ সৃষ্টি করবে। ফলে দুটি তরঙ্গের ক্রিয়ার জন্য ওই বিন্দুতে একটি লব্ধি সরণ উৎপন্ন করবে। একেই বলা হয়ে তরঙ্গের উপরিপাতন। টমাস ইয়ং ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে এই উপরিপাতনের ব্যাখ্যা করেন। এই উপরিপাতনের সূত্র শব্দ, দৃশ্যমান আলোক রশ্মি, এক্সরে রশ্মি ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

 

ইয়ং-এর সূত্রানুসারে উপরিপাতনে একসময় তরঙ্গের বিস্তার বৃদ্ধি পাবে, কখনো কমে যাবে। কিন্তু তরঙ্গ দুটি পরস্পরের বাধাগ্রস্থ হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু যখন দুটি তরঙ্গ পরস্পরকে ছেদ করবে, তখন তরঙ্গস্থিত কণার বিস্তার কম বা বেশ হতে পারে। এর ফলে শব্দের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে। উপরিপাতনের ফলে যখন শব্দের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধিকে বলা হয়, শব্দের ব্যতিচার (Interference of sound) 

শব্দের উপরিপাতনের কারণে সৃষ্ট শব্দের তীব্রতার হ্রাস ব্যতিচারকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। উপরিপাতনের ফলে যখন শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, তখন তাকে বলে গঠনমূলক ব্যতিচার
(constructive interference), পক্ষান্তরে উপরিপাতনের ফলে যখন শব্দের তীব্রতা হ্রাস পায় তখন তাকে বলে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার (destructive interference)।


বায়ুস্তম্ভঘটিত শব্দ
কোনো কাচের শিশিতে ফুঁ দিলে ধ্বনি তৈরি হয়। এই শব্দ তৈরি হয় বায়ুস্তম্ভের স্থির তরঙ্গ উৎপন্ন হওয়ার জন্য। এই স্থির তরঙ্গের কারণেই বাঁশিতে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি তৈরি হয়। স্থির তরঙ্গ তৈরি হতে পারে একমুখ বন্ধ বা উভয় মুখ খোলা নলাকার বস্তুতে। উভয় ক্ষেত্রে বায়ুস্তম্ভের স্থির তরঙ্গ তৈরি হলেও প্রক্রিয়ার দিক থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে।

ধ্বনি ও নাদ
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীততত্ত্বে ধ্বনির আদি রূপ হিসেবে নাদকে বিবেবচনা করা হয়েছে। এই বিচারে নাদকে ধ্বনির নামান্তর বলা যায়। ভারতীয় ধর্মদর্শনে 'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর' হলেন নাদস্বরূপ। তাই নাদের তাৎপর্য আরও গভীর অধ্যাত্মদর্শনকে স্পর্শ করে। আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে বস্তু কম্পিত হলে, শক্তির প্রকাশ ঘটে। এই শক্তির দ্বারাই ধ্বনির সৃষ্টি হয়। বস্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা আপনা আপনি কম্পিত হতে থাকে এবং এর দ্বারা ধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে অনাহত নাদ। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যখন শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা অনুভব করেন, তা আহত নাদ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না।
নাদকে প্রাচীন ভারতের সঙ্গীতগুরুরা নানা ধরনের কাল্পনিক রূপ ধরে নির্দেশিত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন অবস্থানের বিচারে নাদের পাঁচটি প্রকরণ আছে। এগুলো হলো-

ধ্বনিশক্তির ভিত্তিতে বলা যায় সঙ্গীতজগতে অনাহত নাদের কোনো স্থান নেই। কিন্তু মানসলোকে অনাহত নাদ রয়েছে। মানুষের মনের ভিতরে যে সুর আপনা-আপনি ধ্বনিত হয়, তা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য নয়। তা আপন অনুভূতিতে জাগ্রত হয়ে উঠে, তাই অনাহত নাদ মাত্রে নৈশব্দ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে এই স্রষ্টার সাথে যে নৈশব্দ ভাবের বিহার ঘটে। জালালউদ্দীন রুমি বলেছিলেন- নৈশব্দ হলো আল্লাহর ভাষা।

মূলত কোনো সঙ্গীতশিল্পী যখন কোনো সুরকে প্রকাশ করতে চান, তখন তাঁর মনের ভিতরে প্রথম বেজে উঠে অনাহত নাদের সুর। সে সুর নৈঃশব্দের বলেই, আর দশজন শ্রোতা তা শোনেন না। শিল্পী মনের ভিতরে সৃষ্ট অনাহত সুর যখন কণ্ঠে বা যন্ত্র প্রকাশিত হয়, তখন তা হয়ে যায় আহত নাদের সুর। একইভাবে মনের  ভিতরে তৈরি হয় অনাহত ছন্দ। ফলে যে কোনো সুর শৈল্পিক প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি স্তর অতিক্রম করতেই হয়।
 

  • প্রথম স্তর: অনাহত নাদের ভিতর দিয়ে সুর ও ছন্দের জন্ম সৃষ্টি হয়।
  • দ্বিতীয় স্তর: অনাহত নাদ আহত রূপ নিয়ে ভৌত জগতে প্রকাশ ঘটে।

ভৌত জগতর আহত নাদ সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি হিসেবে গানের মৌলিক উপকরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই ধ্বনি মানুষের মনকে স্নিগ্ধ করে এবং একই সাথে মোহিত করে। এর ভিতর দিয়ে মানুষের মনে আনন্দের সৃষ্টি হয়। আর বহুবিধ আনন্দের সুসমন্বয়ে সৃষ্টি হয় সুর-সৌন্দর্য। যখন এই সুর-সৌন্দর্য মানুষের আবাগানুভূতিকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে উঠে রসময় এর ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় রসের। আর এর সাথে যখন যুক্ত হয় অলঙ্কার, সঙ্গীত শ্রীময়ী হয়ে উঠে। তাই বলা যায়, সব মিলিয়ে ধ্বনি-সঙ্গীত হলো- নৈশব্দ, শব্দ, সৌন্দর্য রসের সুসম্বন্বিত ধ্বনিময় প্রকাশ।

 সঙ্গীতজগতের ধ্বনি বা নাদের অবস্থান বেশ সংকীর্ণ। একে ধারানুক্রমে শ্রেণিকরণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো-