সুফিবাদ
ইসলাম ধর্মের একটি বিশেষ পন্থা বা
আধ্যাত্মিক দর্শনকে
সুফিবাদ বলা হয়। এই শব্দের আরবি শব্দমূল হলো সুফ্।
সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ,
প্রথম খণ্ডের, ৪৫২
পৃষ্ঠায়, সুফি শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, 'সুফ
অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্সু’স-সুফ)- অতঃপর
মরমীতত্ত্বের সাধনায় কাহারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি
নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।'
ধারণা করা হয়, ইসলাম ধর্মের প্রচারের প্রথম দুই শতাব্দীর ভিতরে সংসারের ভোগ-বিলাস
ত্যাগ করে, কিছু সাধক সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় এঁরা কর্কশ ও মোটা পশমের
কাপড় পরিধান করতেন। কালক্রমে সুফ্-ধারী অর্থে এই সব সাধকরা সুফি নামে অভিহিত
হয়েছিলেন। সুফিদের মতাদর্শ হিসেবে ইসলাম ধরমের একটি বিশেষ শাখাকে সুফি ধর্ম বলা হয়।
সুফিধর্মকে অনেক সময়, ইসলামের আধ্যত্মিকতার রহস্যময় বা অতীন্দ্রয়বাদ বলা হয়।
ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে বলা হয় তাসাওউফ। এর অর্থ হলো আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান।
এই তত্ত্বজ্ঞানে বলা হয় মানুষের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা তথা আল্লাহর যে গভীর
সম্পর্ক, তাতে বাধা দেওয়াই হলো শয়তানের কাজ। মূলত আল্লাহ শয়তানকে নিয়োজিত
করেছেন মানুষের ইমানের পরীক্ষার জন্য। মানুষ শয়তানের ইচ্ছাকে পরাজিত করে, আত্মার
পরিশুদ্ধি ঘটাবে এবং আল্লাহর সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক স্থাপন করবে। এর ভিতর দিয়ে
আল্লাহকে জানার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হবে। মূলত জ্ঞান ও ধ্যানের ভিতর দিয়ে আল্লাহকে
জানার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার সাধনাই হলো সুফিবাদ।
এই সাধনায় আল্লার পথে সাধক তাঁর লক্ষ্য স্থির
করেন। সেই নির্ধারিত লক্ষ্যে স্থিতি লাভ করাই সুফির সাধনা। এই স্থিতিকে বলা হয়
মোকাম। সার্বিকভাবে সকল ধরনের স্থিতি বা মোকামকে বলা হয় মোকাম-মঞ্জিল।
উল্লেখ্য
মঞ্জিল-এর
আক্ষরিক অর্থ প্রাসাদ বা বাসভবন। লক্ষ্য যে
মঞ্জলি-এ স্থিতি লাভ করে, তার উপর ভিত্তি করে মোকাম-মঞ্জিলকে
কয়েকটি স্তর রয়েছে। এই স্তরগুলো হলো-
শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারফত।
এই সাধনায় নিজের আত্মাকে আগে পবিত্র করতে হবে সততার দ্বারা। এছাড়া সার্বক্ষণিক
আল্লাহকে স্মরণের মাধ্যমে আত্মা বা কল্বকে কলুষমুক্ত করতে হয়। একই সাথে পবিত্র
আত্মা নিয়ে মানুষকে আল্লার সাথে সহবস্থানে থাকার সাধনা করতে হয়। এরূপ অবস্থানকে বলা
হয়েছে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা)।
চারটি মঞ্জিলে উন্নীত হওয়া বা ফানাবিল্লাহ-য় পৌঁছানোর পর, সাধক আল্লাহর সাথে অভিন্ন
দশায় পৌঁছার সাধনা করেন। এই মোকামকে বলা হয় হাহুত। একে বলা হয় সর্বশ্বৈরবাদ।
এই মঞ্জিলে সাধক সকল কিছুর ভিতরে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করেন। স্রষ্টা এবং সাধক এমন
একটি দশায় উপনীত হন, যার ভিতর দিয়ে সাধক আল্লাহ এবং নিজের মধ্যে কোনো অভিন্নতা পান
না। এই পর্যায়ে সাধক নিজকে 'আনাল হক' বা 'আমিই আল্লাহ' বলে মনে করেন। এই পর্যায়ের
অবস্থাকে সুফি সাধকরা বাকাবিল্লাহ বলে থাকেন।
সুফিদর্শন মতে এই পর্যায়ে সাধক ঐশ্বরিক কিছু ক্ষমতা লাভ করেন। এই সময় সুফি
সার্বক্ষণিক এক ধরনের প্রশান্তিতে বিরাজ করেন।
সুফিবাদে
মনে করা হয়, যেহেতু আল্লাহ মানুষকে নিজের রূপেই সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের শরীরে
আল্লাহ জ্যোতিরূপে দেহে ও মনে অবস্থান করেন। ধ্যানরত অবস্থায় আল্লাহর জ্যোতি
এই সব স্থানে অবতীর্ণ হয়। এই অবস্থানকে বলা হয়
লতিফা। অবস্থানের বিচারে মানবদেহে
১০টি
লতিফা রয়েছে। এগুলো হলো- কলব, রুহ,
শিররুন, খাফি, আকফা, নাফস, আব, আতস, খাক ও বাদ। মানুষের সাথে সকল সময় থাকে
আব, আতস, খাক ও বাতাস। মূলত এই
লতিফা হলো পঞ্চভূতের চারটি। দেহের চালিকা শক্তি বা
ভিত্তি হিসেবে এই চারটি লতিফা বিরাজ করে। বাকি ছয়টি
লতিফা হলো সাধনার। তাই সাধকরা
ছাড়া এই
লতিফার সাধনা করতে পারেন না।
সুফিদের এই সাধনার কয়েকটি পথ রয়েছে। এই পথগুলো কোনো না কোনো বিশিষ্ট সুফিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সুফিবাদে এই পথকে বলা হয় তরিকা। বিভিন্ন সুফিদের বহুবিধ তরিকার জন্ম হলেও, চারটি তরিকাকে প্রধান হিসেবে মান্য করা হয়। এগুলো হলো-
১. কাদেরিয়া তরিকা। হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর পথ
২. চিশতিয়া তরিকা। হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি (র.)-এর পথ
৩. নকশবন্দিয়া তরিকা। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (র.)-এর পথ
৪. মুজাদ্দিদিয়া তরিকা। হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সারহিন্দী (র.)-এর পথ।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টীয় এগারো শতাব্দীর
মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার
হয়েছে । এই সময় আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে
সুফিরা এসে বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রচার করেছিলেন। খ্রিষ্টীয়
এগারো-বারো শতাব্দীর দিকে শাহ সুলতান রুমী (র.), বাবা আদম শহীদ (র.), শাহ সুলতান
বলখী (র.), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশেকন (র.), শাহ মখদুম রূপস (র.), শেখ ফরিদউদ্দিন
শক্করগঞ্জ(র.), মখদুম শাহ দৌলা শহীদ (র.) প্রমুখ সুফি সাধকরা ইসলাম ধর্ম প্রচার
করেন। এঁদের অসাধারণ জ্ঞান, বাগ্মিতা ও মানবপ্রেমের কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ
সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এভাবে ক্রমশ বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রসার লাভ করে।
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বাংলার পশ্চিমাঞ্চল দখল করে। এরপর অন্যান্য
মুসলমান শাসকরা কালক্রমে সমগ্র বঙ্গদেশে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। এই সময় ইসলামের
শরিয়ত ও মারিফত উভয় ধারারই প্রচার ঘটে। এক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন,
তাঁরা হলেন—
শেখ জালালুদ্দীন তাব্রিজি (র.),
শাহ জালাল (র.), শেখ আলাউল হক (র.), খান জাহান আলী (র.), শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা
(র.), শাহ ফরিদউদ্দীন (র.) প্রমুখ।
সুফিবাদের এই প্রভাব মধ্যযুগীয় কাব্য-সাহিত্য এবং লোকসঙ্গীতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
বিশেষ করে সুফি দর্শনের সূত্রে তৈরি হয় বাউল, মারফিত, মুর্শিদি ইত্যাদি লোকগান।
এছাড়া গাজীর গান, গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমীসাহিত্য, মাদার পীর ও
সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি পীর-দরবেশকে কেন্দ্রিক গানেরও সূচনা করেছিল সুফিবাদ।