তান্ত্রিক মতবাদ
ধর্মীয় মতাদর্শ।
সনাতন হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য একটি স্বতন্ত্র মতবাদ হলো তান্ত্রিক
মতবাদ। এই মতে জগতের শুভ শক্তি এবং অপশক্তি বিরাজ করে। আদিম সমাজে
ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য উভয় শক্তিকে বশ করার প্রচেষ্টা ছিল। এরই মধ্য দিয়ে
প্রকৃতি পূজার যেমন বিকাশ ঘটেছিল, তেমনি বিকাশ ঘটেছিল যাদু-টোনা, মন্ত্র ইত্যাদি।
এই প্রক্রিয়াই পৌরাণিক ধর্মে এসে তান্ত্রিকতার জন্ম হয়। কালক্রমে এর অধিকাংশই
বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের অংশ হয়ে যায় এবং ধর্মের অংশ হয়ে যায়।
ভারতীয় তান্ত্রিক মতবাদে তন্ত্র-মন্ত্রের নারীশক্তিকে আদ্যা শক্তি হিসেবে স্থাপন
করা হয়েছে। এই মতে বলা হয় নারীই জগৎকারণ। তিনিই কালী, শিবানী, তারা নামে পূজিতা হন।
এই নারী শক্তিতেই শিব শক্তিমান। শিবকে উপলব্ধি করতে হলে, কালীকে জানতেই হবে।
তন্ত্রমতে মানুষের মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে ছয়টি চক্র রয়েছে। এই ছয়টি চক্র হলো-
মূলধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুরি, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র। দেহে এদের অবস্থান হলো-
আর এই ষট্চক্রের উপরে অবস্থান করে শৈবশক্তি। এর নাম সহস্রবার। যোগের মধ্য দিয়ে ঘুমন্ত কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে হয়। এরপর কুলকুণ্ডলিনীকে ঊর্ধবমুখী করে শিবের সাথে মিলন ঘটাতে পারলে, তান্ত্রিক ত্রিগুণাতীত শিবত্বকে অনুভব করতে পারে। এই সাধনার সহযোগী হিসেবে রয়েছে বায়ুসঞ্চালক নাড়ী রয়েছে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুন্মা প্রভৃতি। এ সকল নাড়ীএদের নিয়ন্ত্রণ করে, সাধনাকে লক্ষ্যের দিকে নিতে হয়। এর মধ্য দিয়েই তান্ত্রিক চরম আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছায়। তান্ত্রিক মতে কুলকুণ্ডলারূপী নারীই হলেন কালী বা উমা।
বহু দিনের চর্চার ফলে তন্ত্রমত নানাভাগে বিভাজিত হয়েছে। এর ভিতরে বীরাচার, বামাচার, চীনাচার ও কুলচার পদ্ধতিকে যথার্থ তান্ত্রিক আচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বামাচারে তান্ত্রিক সাধনায় সাধনসঙ্গীর প্রয়োজন হয়। নারীপুরুষের মৈথুন এবং বীর্যধারণের মধ্য দিয়ে সহস্রবারে অবস্থান করাটাই হলো এই তান্ত্রিক মতের লক্ষ্য। এক্ষেত্রে সাধনসঙ্গী হিসেবে নিজের স্ত্রী উপযুক্তা নন। সাধনসঙ্গী হবে পরনারী এবং জাতিতে বেশ্যা, নটী, রজকী এবং ব্রাহ্মণী উৎকৃষ্ট। এরই ভিতর দিয়ে একদিকে সনাতন ধর্মের শাখারূপে শৈব বা শাক্ত-তান্ত্রিক মতবাদ বিকশিত হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিকাশ লাভ করেছিল বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্ম।
বৌদ্ধতান্ত্রিক মতবাদ
বৌদ্ধতন্ত্রের ছক অনেকটাই শাক্তশক্তির অনুরূপ। শুধু ব্যাখ্যা এবং
সাধন স্তর ভিন্নতর। সাধারণ মানুষের মধ্য বৌদ্ধ দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গৌতম বুদ্ধ
প্রচলিত তান্ত্রিকমতবাদকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। বুদ্ধের মৃত্যুর তা একটি পৃথক
মতে পরিণত হয়েছিল।
বৌদ্ধতন্ত্রে সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি এবং পুরুষকে অভিহিত করা হয়েছে প্রজ্ঞা ও উপায় হিসেবে। বৌদ্ধতান্ত্রিকরা সনাতন ধর্মের ষট্চক্রকে চারটি চক্রে আবদ্ধ করেছিলেন। এর নাম দিলেন কায়। এই চারটি কায় হলো-
এর সাথে রয়েছে ১২টি সহায়ক বিষয়। এগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত। যেমন-
চার সাধনাঙ্গ: সেবা, উপসেবা, সাধনা ও মহাসাধনা।
চার আর্য সত্য: দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিবৃত্তি এই দুঃখ নিবৃত্তির উপায়।
চার তত্ত্ব: আত্মতত্ত্ব, মন্ত্রতত্ত্ব, দেবতাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব।
এর সাথে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছিল চার নিকায়, ষোড়শ সংক্রান্তি, চৌষট্টি দণ্ড ও চার প্রহরের সম্পর্ক। সনাতন তান্ত্রিক মতে যে সকল নাড়ির নাম পাওয়া যায়, সেগুলো ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন- বৌদ্ধ মতে-
ললনা (ইড়া) বিন্দু তথা
বীর্য বহন করে। রসনা (পিঙ্গলা) রজঃ বহন করে। উভয়ের মিলন ঘটে অবধূতে।
ললনার বিন্দু প্রজ্ঞা স্বরূপ আরা রসনার রজঃ উপায় স্বরূপ। ফলে অবধূতে বিরাজ করে
প্রজ্ঞা এবং রজঃ-এর মিলনজাত বোধিচিত্ত। বৌদ্ধ-তন্ত্রমতে অবধূত হলো সহজানন্দ
স্বরূপিনী।
যোগশাস্ত্রের হটযোগ বৌদ্ধতন্ত্রে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই যোগে বিন্দু তথা
বীর্যধারণ এবং তা ষট্চক্রের ঊর্ধে প্রেরণ করা হয়। এই সাধনায় ব্যবহার করা হয়
সাধনসঙ্গিনী। এক্ষেত্রে উপযুক্ত নারী হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডোমনী, চণ্ডালিনী ও
ব্রাহ্মণী।
বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে মন্ত্রকে বলা হয়, ধারিণী। কারণ মন্ত্রের দ্বারা কল্যাণ বা
অকল্যাণ ধারণ করা যায়। বৌদ্ধের জীবদ্দশায় মন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। সাধারণ মানুষকে
মন্ত্রের দ্বারা মুগ্ধ করে বৌদ্ধ তাঁর আদর্শ প্রচার করতে চেয়েছিল। খ্রিষ্টীয়-পূর্ব
দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নানা ধরনের বৌদ্ধমন্ত্র রচিত হতে থাকে। কালক্রমে
তন্ত্র-ভিত্তিক ক্ষান্তি-পারমিতা, দাম-পারমিতা প্রভৃতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। এ সকল
তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হয় বৌদ্ধ-তান্ত্রিক দেবী। এই সময় থেকে নানা ধরনের ধারিণী বা
বীজমন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।
সূত্র :