মৈথুনতত্ত্ব
মৈথুন হলো- দ্বৈত সত্তার সম্মিলন। আর মৈথুনতত্ত্ব হলো, দ্বৈতসত্তার সম্মিলনের প্রক্রিয়া। মৈথুন শব্দের অপর একটি অর্থ হলো নারীপুরুষের সঙ্গমক্রিয়া। এই তত্ত্ব মূলত কামশাস্ত্র। প্রকৃত মৈথুনতত্ত্ব হলো- সত্তার মিলন। এই বিচারে যে কোনো সত্তার মিলনই মৈথুনতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তাই নারীপুরুষের সঙ্গমক্রিয়া মৈথুনতত্ত্বের একটি অংশমাত্র।

মৈথুনতত্ত্বের মূল কথা হলো- নতুন কোনো সৃষ্টির জন্য দুটি সত্তার মিলনের প্রয়োজন। এই মিলন প্রক্রিয়া হলো মৈথুন। অক্সিজেনের সাথে হাইড্রোজেনের মিলনের ফলে, পানি নামক সত্তার জন্ম হয়। রসায়ন বিজ্ঞানে এই মিলনকে বলা হয়, রাসায়নিক ক্রিয়া। মৈথুনতত্ত্বে এই মিলনক্রিয়া হলো মৈথুন। নারী ও পুরুষ সত্তার মিলনে যে জীবের জন্ম হয়, কামশাস্ত্রে তাকে কামক্রিয়া বা সঙ্গম বলা হয়, মৈথুন শাস্ত্রে এই কামক্রিয়া হলো মৈথুন।

প্রকৃতিবাদীরা বলেন, প্রকৃতি তার সকল প্রজাতিকেই সন্তানের মতই ধরে রাখতে চায়। কিন্তু প্রজাতি মাত্রেই মরণশীল। তাই কোনো প্রজাতির কোনো সদস্যই অমর হতে পারে না। এই অমর হওয়াটাই হবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ প্রক্রিয়া। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মের ভিতরে প্রজাতির সন্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি রেখেছে। কিন্তু প্রজাতি কেন সন্তান উৎপাদন করবে? এর সমাধান এসেছে যৌনকামনার ভিতর দিয়ে। প্রজাতি নিজের আনন্দলাভের একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যৌনানন্দ লাভ করে, আর এর ভিতর দিয়ে সন্তান-সৃষ্টির কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়।

বিভিন্ন ধর্ম মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে রয়েছে আদি পরম পুরুষ। তাঁর স্বমৈথুনে সৃষ্টি হয়েছিল জড় জগতের। ফলে সৃষ্টির প্রথম পর্বে পরম শক্তি থেকে বস্তু সত্তা পৃথক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বস্তুসত্তার শক্তিরূপে ছিল পরমশক্তি। পরম শক্তি অবিনশ্বর হয়ে রয়ে গেল, কিন্তু বস্তু পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে অবিরত তার রূপ পরিবর্তন করতে থাকলো। এই রূপান্তরের সূত্রে তৈরি হলো প্রকৃতি। প্রকৃতির নানা অবস্থার ভিতরে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চললো নানাবিধ মৈথুনে। এক সময় জড় বস্তু থেকে জন্ম নিল জীব। আর জীবের ক্রমবিবর্তনের জন্ম নিল মানুষ। মানুষ সৃষ্টির আদিতে মানুষ নারী পুরুষ হয়ে বিভাজিত হয়েছিল। এই বিভাজন ছিল প্রকৃতির রূপান্তরেরই একটি অধ্যায়। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি ঘটেছিল আবার মানুষের পূর্ববর্তী প্রজাতির ক্রমবিবর্তনের সূত্রে।

আদি মানবীরা মূলত কৃষি-জাত পণ্যের ভিতরে মৈথুনকে আবিষ্কার করেছিল এবং তার সাথে নিজের নারী-প্রকৃতির সন্ধান করেছিল। এর ভিতর দিয়ে আদি মৈথুন তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল।
যতদিন মানুষ শিকারী ছিল, কিম্বা বনজঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করেছে, ততদিন মানুষ ছিল নিতান্তই প্রকৃতির অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রজাতি। এরপর মানুষ ধীরে ধীরে কৃষিজীবি হয়ে উঠলো।  কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীদের দ্বারা। মানুষের আদিম যুগের সূচনায়, নারীপুরুষ মিলেই বন্যপশু শিকার বা বনজ ফলমূল সংগ্রহ করতো। কিন্তু দৈহিকভাবে নারী দুর্বল হওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি সব সময় সমানভাবে শিকারে অংশগ্রহণ করতে পারতো না। নারীদের অংশগ্রহণের একটি বড় বাধা ছিল, গর্ভবতী হওয়া এবং শিশু লালনপালনএ ছাড়া ঋতুস্রাবজনীত কারণেও অনেক নারী দুর্বল হয়ে পড়তো। এই সময় ধীরে ধীরে নারী গৃহবন্দী হয়ে পড়তে থাকে। যদিও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে, সামাজিকভাবে নারী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারী ক্রমাগত গৃহবাসিনী হয়ে পড়েছিল।

পুরুষরা খাদ্যের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতো, সবই গৃহকর্ত্রীর হাতে তুলে দিতো। নারীরা সে সব খাদ্য পরিবারের সবার জন্য বণ্টন করতো এবং ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতো। পশুর মাংস দীর্ঘদিন রাখা না গেলেও ফলমূল, শস্য ইত্যাদি বনজ খাদ্য সংগ্রহ করে রাখাটা তারা রপ্ত করে নিয়েছিল। খাদ্যশস্য বাছাই করতে গিয়ে, সংগৃহীত শস্যের কিছুটা বাইরে ফেলে দিত। প্রথম দিকে মানুষের ধারণা ছিল, সবই প্রকৃতির দান। এসব তৈরি করা যায় না। এই ধারণা পাল্টাতে থাকলো, যখন তার দেখলো এই পরিত্যক্ত াদ্য শস্য থেকে নতুন গাছের জন্ম হচ্ছে এবং সেগুলো থেকে আবার ফল দান করছে। এরপর নারীরা বীজ সংগ্রহ এবং তা রোপণ করে গাছ তৈরির কলাকৌশল শিখলো। ধীরে ধীরে তারা মাটি কুপিয়ে চাষের উপযোগী ভূমি তৈরি করতে শিখলো। এরই সূত্রে নারীদের দ্বারা আদিম কৃষিবিদ্যার জন্ম হয়েছিল।

একসময় নারী শস্যের ফলন এবং নিজের সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল। তারা আপন সত্তার ভিতরে গভীরভাবে অনুভব করেছিল তাদের সাথে ভূমির একাত্মতা। তাদের চেতনায় বিকশিত হয়েছিল, পুরুষরূপ হলকর্ষণের দ্বারা নারী-স্বরূপ ভূমি গর্ভাধান উন্মুক্ত হয়। এরপর বীজবপন করলে শস্যরূপী সন্তানের জন্ম হয়। মানুষের সন্তান-উৎপাদনের সাথে তুলনা করেই ভূমিকে তারা মান্য করতে শিখেছিল 'জননী বসুন্ধরা' হিসেবে ক্রমে ক্রমে এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। পৃথিবীর আদিম মানুষের সেই ভাবনাই নানা দেশে নানা ধর্মে স্থান লাভ করেছিল।  

২৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাদে ক্রো-ম্যাগনানদের পূজিতা উইলেন্ডোর্ফের ভেনাস:

বহু আগে থেকেই প্রেম, যৌনতা, সৌন্দর্য এবং উর্বর্তার দেবী  হিসেবে নারীমূর্তি  পূজিতা হয়েছে বিভিন্ন সভ্যতায়। ভাষা এবং সংস্কৃতির কারণে এই দেবী নানা নামে নানা ভাবে পূজিতা হয়েছে। এই সূত্রে এরা তৈরি করেছিল মাতৃদেবী'র মূর্তি। বর্তমানে এসকল মূর্তিকে সাধারণভাবে ভেনাস নামে অভিহিত করা হয়। ভেনাস তথা মাতৃদেবী আদিম দশা ছিল এর শুরু হয়েছিল সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক কালে, হোমো গণের কতিপয় প্রজাতির আদিম ভাবনা থেকে। এই মাতৃদেবীর মূর্তির প্রতি ভক্তি বা পূজার সূচনা হয়েছিল সম্ভবত ৫ থেকে ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস-দের আমল থেকে।  টান-টানের ভেনাস-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

হোমো ইরেক্টাসের ভিতরেও মাতৃদেবীর পূজা ছিল। এরপর এর মাতৃদেবীর পূজা ছড়িয়ে পড়েছিল ক্রো-ম্যাগনানদের মধ্যে। পর্বর্তী সময়ে এ সকল মূর্তিগুলোকে ভেনাস  নামে অভিহিত হয়েছে। ভেনাসের ভাবনা আদিম-উত্তর মানুষকে সৃষ্টিতত্ত্বের দিকে তাড়িত করেছিল। তারা নিজেদের সমাজে বহু বন্ধ্যা নারী এবং বন্ধ্যা ভূমি দেখেছিলএরা অনুর্বর ভূমি এবং বন্ধ্যা নারীকে সমধর্মী একটি শ্রেণিতে ফেলার চেষ্টা করেছিল।নারী তার নিজের বন্ধ্যাত্ব মোচনের জন্য করতো প্রাকৃতিক চিকিৎসা। আশ্রয় নিতো নানা ধরনের তুকতাক, তন্ত্রমন্ত্রের। ভূমির বন্ধ্যাত্বের জন্যও এসব ছিল। ভূমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য বা উত্তম ফসলের জন্য তারা কল্পনা করেছিল 'উর্বরতার দেবী'কে।  ভূমির উর্বতার জন্য প্রয়োজন পানি। এর উৎস মেঘ, নদী, খাল বিল। প্রাকৃতিক কারণে, অনেক জাতিই মনে করতো- জলের উৎস নদী আর নদীতে থাকে উর্বতার দেবী। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- মানুষ এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিল যে, দেবীর কাছে সন্তান কামনা করলে দেবী তা দান করেন। অনেক সময় কুমারীরা স্বামী প্রার্থনা করতো দেবীর কাছে। এর ভিতর দিয়ে বিকশিত হয়েছিল নারী শক্তির উপাসনা।

ভারতবর্ষে নারী শক্তির উপাসনার বিকাশ
ভারতবর্ষে আগত প্রথম মনুষ্য দল হিসেবে বিবেচনা
করা হয় নেগিটোদের। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। এরপর ভারতবর্ষে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-২৫ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি  নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়ে। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারত থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল।

ভারতবর্ষ আগত মানুষের কালানুক্রমের বিচারে দ্বিতীয় দল হলো- প্রোটো-অস্ট্রালয়েড। এদের উত্তরসূরী হলো- ভারতের সাঁওতাল, হো, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা। এরা সন্তান এবং শষ্য উৎপাদনের সাথে মৈথুন ক্রিয়াকে অত্যবশ্যকীয় আচরণ হিসেবে মান্য করতে শিখেছিল। এই সূত্রে এদের ভিতরে প্রচলিত হয়েছিল মৈথুন উৎসব পালন। ভারতের সাঁওতাল, হো, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা এখনও মৈথুন উৎসব পালন করে।

হরপ্পায় প্রাপ্ত মাতৃদেবী

ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে ভারতের এলাহাবাদের কাছে। কার্বন-তারিখ অনুসারে এর ধারণা করা গেছে- এই মূর্তিটি ২০,০০০-২৩,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পূজিতা হতো। এর কাছাকাছি সময়ে উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরের কাছে আরও কিছু রঙিন পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে। এই পাথরগুলোতে রয়েছে ত্রিভুজ অঙ্কিত অবয়ব। উল্লেখ্য ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা এই জাতীয় পাথরগুলিকে দেবীজ্ঞানে পূজা করে। এই ত্রিভুজাঙ্কিত মূর্তিগুলো নারীর যৌনাঙ্গের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য, হরপ্পাতে এই জাতীয় মূর্তি পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে তান্ত্রিকদর্শনে বর্ণিত তান্ত্রিক যন্ত্রে- এই ত্রিভূজকে উর্বরতা ও প্রজননের একটি প্রধান প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতায় বিকশিত হয়েছিল শক্তিবাদী  ধর্ম। এদের খোদিত শিলালিপিতে পাওয়া যায় লজ্জা গৌরীর আদি রূপ। এই দেবী ছিলেন শস্য-সম্পদের। এই সূত্রে তিনি উর্বরতার দেবী হিসেবেও বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। আর্য ভাষাভাষীদের আমলে লজ্জা গৌরী উর্বরতা ও প্রাচুর্যের দেবী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তারা ভেবেছিল প্রকৃতি দেবী তথা মাতৃদেবী নারীর মতই রজঃস্বলা দশা অন্তে গর্ভধারণের উপযোগী হয়ে উঠে।

প্রোটো-অষ্ট্রালয়েড এবং দ্রাবিড়দের মিশ্র সংস্কৃতির সাথে আর্য-ভাষাভাষীদের  সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০-১৫০০ অব্দের ভিতরে। এই তিন ধারার ধর্মবিশ্বাসের সূত্রে জন্ম নিয়েছিল সনাতন হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক গল্পগাঁথা। ভারতের আদি মৈথুন তত্ত্বের সাথে মিল রেখে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর ঋতুমতী হয়ে উঠার বিশ্বাস। ভারতের পৌরাণিক বিশ্বাসের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল নানা ধরনের লোকাচার। এই লোকাচার অনুসারে আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে ধরিত্রী মাতা ঋতুমতী হন। এই সময়কে অম্বুবাচী হিসেবে পালন করা হয়। অম্বুবাচীর তিনদিন পৃথিবী অশৌচ অবস্থায় থাকে বলে, কোনো মাঙ্গলিক কাজ করা হয় না।
ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের কামাখ্যা দেবীর মন্দিরে প্রতি বৎসর অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয়। অম্বুবাচী'র আরম্ভের প্রথম দিন থেকে কামাখ্যা দেবীর দ্বার বন্ধ রাখা হয়। এই সময় দেবী দর্শন নিষিদ্ধ থাকে।

আদিবাসী নারীদের মতো আর্য নারীরাও নিজেদের সন্তানধারণ এবং প্রসবের অভিজ্ঞতাকে শষ্য উৎপাদনের কৌশলের সাথে কল্পনা করে মৈথুনতত্ত্বকে উপলব্ধি করেছিল। আর্য ঋষিরা এই ভাবনাকে ধর্মবোধে অঙ্গীভূত করে, উপলব্ধি করেছিল পিতার প্রতীক বীজ আর মাতার প্রতীক ভূমি। ছান্দোগ্য উপনিষদের অষ্টম খণ্ডের ৩৯৭ শ্লোকে বলা হয়েছে-

হে গৌতম, নারীই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি, তার উপস্থি হলো সমিধ (ইন্ধন), যে সম্ভাষণ করা হয় তাই ধূম, যোনিই হলো অগ্নিশিখা। মৈথুন হলো অঙ্গার। রতি সম্ভোগ স্ফুলিঙ্গ।

এর পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে,

সেই স্ত্রীরূপ অগ্নিতে দেবগণ শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকে গর্ভ সঞ্চার হয়।

হিন্দু ধরমে, মৈথুন তত্ত্বের সূত্রে এসেছে লিঙ্গপূজা। রজঃ-এর প্রতীক হিসেবে এসেছে রক্তবর্ণ ডালিম বা সিঁদুর। যোনির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পদ্ম। এসব বিশ্বাস এবং আচারানুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে জটিলতর ধর্মতত্ত্বের  উদ্ভব হয়েছিল। মৈথুনতত্ত্বে আদ্যা শক্তি নারী। সেই আদ্যাশক্তি থেকে পুরুষের উদ্ভব এবং তার অধীনে থেকে পুরুষ নতুন সৃষ্টির বীজ বপন করে। নারী ও পুরুষ সত্তার মিলনে সৃষ্টি মহাশক্তি। অর্ধনারীশ্বর ধারণা এসেছিল এই ভাবনা থেকেই। এই ভাবনা থেকেই উদ্ভব হয়েছিল শিব-শিবানী, বিষ্ণু-লক্ষ্মীর ভাবনা। প্রাচীন সাংখ্যতত্ত্বে এই মৈথুনতত্ত্বে এসেছে প্রকৃতি ও পুরুষ সত্তা হিসেবে

পৃথিবীর অন্যান্য পৌরাণিক কথকথায় মৈথুন ধর্মের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, নানা ভাবে। গ্রিক পুরাণে পাওয়া যায়, ক্যায়োস নামক আদি দেবতার কন্যা ইউরোনোমে এবং ওফিয়োন নামক সর্পের মিলনে জগতের সকল উপকরণ তৈরি হয়েছিল। জাপানি পৌরাণিক কাহিনীতে সৃষ্টিতত্ত্বে দেখা যায় সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল আদি ঈশ্বর-ঈশ্বরী। এদেরই পুত্র-কন্যা ইজানাগী এবং ইজানামী। এদের মৈথুনক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জগতের অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম সাধিত হয়। চীনা মতে ইয়াঙ এবং ইন যৌন মিলনে জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মিশরীয়রা জলপ্রপাত, উর্বরতা ও সৃষ্টির দেবতা ছিলেন ভেড়ার মাথাওয়ালা খ্‌নুম। এই দেবতা কুমোরের চাকা দিয়ে নীলনদের তীরের মাটি থেকে প্রথম মানুষ তৈরি করেছিলেন। মিশরীয় কোনো কোনো কাহিনিতে পাওয়া যায়- ন্যুট ও গেবের প্রথম কন্যা এবং হোরাসের মা আইসিস ছিলেন মাতৃত্ব, যাদু ও উর্বরতার দেবী